ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ী by আবু এন এম ওয়াহিদ

ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক অর্থশাস্ত্রের আওতাভুক্ত একটি বিষয়। অর্থনীতির ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে এটা বোঝা ও বোঝানো আমার দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এটা যে পত্রিকার পাঠকদের জন্য কলামের একটি বিষয়বস্তু হতে পারে, তা কখনো ভাবিনি।


কেন এবং কিভাবে এ কলাম লেখার সূত্রপাত, সে কথায় একটু পরে আসছি। তার আগে আমাদের ছোট মেয়ে নায়লাকে নিয়ে একটি প্রাসঙ্গিক মজার গল্প পাঠকদের সঙ্গে আজ শেয়ার করতে চাই। গল্প নয়, ঘটনাটি আসলে সত্যি। নায়লার বয়স যখন মাত্র চার কি পাঁচ, তখন সে একদিন তার মায়ের সঙ্গে আমাদের বাড়ির কাছের শপিং মলে গেছে। যাওয়ার আগে কাপড়-চোপড় পরে তার কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছে একটি ছোট্ট পিঙ্ক হ্যান্ডব্যাগ। ব্যাগের ভেতরে করে তার সঞ্চিত দুটি ডলার নিতে ভোলেনি সে। তার ইচ্ছা, দোকানে গিয়ে পছন্দ করে নিজ হাতে কিছু কিনবে নিজের টাকায়।
মলে গিয়ে মাকে নিয়ে প্রথমে ঢুকেছে এক খেলনার দোকানে। অনেক বাছাবাছির পর সে ঠিক করেছে, পাখির পালক লাগানো একটি রঙিন কলম কিনবে। কিনেছেও তাই। নিজ হাতে ব্যাগ থেকে এক ডলার বের করে দিয়েছে কলমের দাম। খুব খুশি মনে দোকান থেকে বের হলো; কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তার মুড বদলে গেল। এক হাতে তার নতুন কলম আরেক হাতে হ্যান্ডব্যাগ থেকে অবশিষ্ট ডলারটি বের করে কাঁদো কাঁদো স্বরে মাকে বলল, 'আমার আরেক ডলার গেল কোথায়?' তার মা বললেন, 'ওটা দিয়ে তুমি কলম কিনেছ।' তখন সে মাকে বলল, 'কলম নিলে টাকা দিতে হবে কেন? আমি আমার ডলার ফেরত চাই।' মা বললেন, 'তাহলে তোমার কলম দোকানিকে ফিরিয়ে দিতে হবে।' নায়লা কোনোভাবেই মানতে রাজি নয়, জিনিস নিলে টাকা কেন দিতে হয়? সে গিফট বোঝে, দেওয়া-নেওয়া বোঝে, কিন্তু কেনাবেচার ধারণা তখনো তার মাথায় আসেনি। কেনার সময় পণ্য নিলে যে দাম দিতে হয়, এটা তার বোঝার বাইরে। ছোট্ট মেয়ে তার সঞ্চিত ডলারটি কোনোক্রমেই হাতছাড়া করতে রাজি হলো না। অবশেষে সে কলমটি ফেরত দিয়ে ব্যাগের ডলার ব্যাগে নিয়েই বাড়ি ফিরল। ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের মধ্যে এঙ্চেঞ্জ বা বিনিময় যে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা নায়লা সে বয়সে বোঝেনি। আমি অনেক বড় হয়েও তা বুঝতাম না।
অনেক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যখন অর্থনীতি ক্লাসে ভর্তি হলাম তখন আস্তে আস্তে জানলাম, ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক তিনটি স্তরে বিভক্ত। প্রথমত, দরকষাকষি, এরপর চুক্তি, এরপর বিনিময়। প্রথম পর্যায়ে ক্রেতা কী মূল্যে কী পণ্য বা সেবা পাবে তা নিয়ে দুজনের মধ্যে হয় দরকষাকষি, এর মাধ্যমে তারা দুজন পৌঁছায় দ্বিতীয় পর্যায়ে, অর্থাৎ চুক্তিতে। চুক্তি হবে নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে ক্রেতা নির্দিষ্ট পরিমাণ, নির্দিষ্ট গুণের ও মানের, নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাবে বিক্রেতার কাছ থেকে। এই চুক্তি হতে পারে মৌখিক, হতে পারে লিখিত। চুক্তির পর, চুক্তি অনুযায়ীই হবে বিনিময় বা লেনদেন। অর্থাৎ ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করবে এবং বিক্রেতা পণ্য বা সেবা ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেবে। এ হলো ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যকার অর্থনৈতিক বা বৈষয়িক সম্পর্কের ধরন। এর বাইরেও যে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের মধ্যে আরেকটি মাত্রা থাকতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। এটা আবিষ্কার করলাম মাত্র সেদিন। আমি আমার এক বন্ধু মোশাররফ হোসেনকে নিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় সপরিবারে খেতে গেছি আমাদের শহরের, অর্থাৎ ন্যাসভিলের ও'চার্লিজ রেস্টুরেন্টে। ও'চার্লিজ ন্যাসভিল-ভিত্তিক একটি চেইন ক্যাজুয়াল ডাইন ইন রেস্টুরেন্ট। ও'চার্লিজের একটি বিশেষত্ব হলো- তারা সাধারণত হিমায়িত মাছ-মাংস কাস্টমারদের সার্ভ করে না। তাদের প্রতিটি রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন তাজা মাছ, মাংস, তরিতরকারি ও ফলমূল সরবরাহ করা হয়। এটা তাদের বিজনেস পলিসি। এ জন্য এটা আমাদের প্রিয় খাবার দোকানের মধ্যে অন্যতম।
যাই হোক, ও'চার্লিজের লবি থেকে ডাইনিং হলে ঢোকার সময় দরজার ওপর বড় বড় হরফে একটি লেখা চোখে পড়ল। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। মোশাররফকেও দেখালাম। লেখা আছে, 'এভরি ওয়ান হু এন্টারস থ্রু দিস ডোর, ইজ অ্যা ফ্রেন্ড অব মাইন।' অর্থাৎ 'এ দরজা দিয়ে যে-ই ঢুকবে সে-ই আমার বন্ধু।' কথাটি রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বা কোনো কর্মচারীর নয়, খোদ চেইন রেস্টুরেন্টের মালিক চার্লি ওয়াটকিনসের কথা। অর্থাৎ দোকানের মালিক ব্যবসা ও লেনদেন করার আগেই তার প্রত্যেক কাস্টমারকে নিজের বন্ধু হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছেন এবং নিতান্তই আপন বলে বরণ করে নিচ্ছেন। ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের মধ্যে এখানে আমি পেলাম এক নতুন মাত্রা। আমার কাছে নতুন হলেও এটা আসলে নতুন নয়। এখানে একটি প্রশ্ন যে কারো মনে দানা বাঁধতে পারে। চেনা নেই, জানা নেই এমন কাস্টমারদের চার্লি কেন তাঁর বন্ধু বলছেন? কারণ কাস্টমার ছাড়া তো তার রেস্টুরেন্টের ব্যবসা চলবে না, কাস্টমার ছাড়া তো রেস্টুরেন্ট টিকবেই না। কাস্টমাররাই রেস্টুরেন্টের জান, রেস্টুরেন্টের প্রাণ। কাস্টমারদের সেবা করার জন্যই ব্যবসা। কাস্টমাররা প্রতিদিন রেস্টুরেন্টে আসে, খায়, পান করে, আড্ডা দেয়, ভালো সময় কাটায়। রেস্টুরেন্টের পরিবেশকে মাতোয়ারা করে রাখে। তারা ব্যবসাকে রাজস্ব দেয়, মুনাফা দেয়। ব্যবসায়ীর কাছে এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? আর তাই তার কাছে কাস্টমারদের ছাড়া আর আপনজন, বড় বন্ধু কে আছে? তাই তো চার্লি ঠিকই বলেছেন, 'আমার প্রত্যেক ক্রেতা আমার বন্ধু।' কথাটি শুধু ও'চার্লিজ রেস্টুরেন্টের বেলায়ই সত্যি নয়, এটা পৃথিবীর সব দেশের সব সমাজের তাবৎ ব্যবসার বেলাই সমানভাবে প্রযোজ্য।
আজ ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের এ নতুন মাত্রা নিয়ে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমি পাঠকদের সঙ্গে দু-একটি কথা শেয়ার করতে চাই। চার্লি তাঁর প্রত্যেক কাস্টমারকে বন্ধু বলে বরণ করে নিচ্ছেন। শুধু মুখে মুখে নয়, কাজেও। কিভাবে কাজে, সে ব্যাখ্যা না হয় আরেক দিন দেব। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী বা বিক্রেতারা গ্রামগঞ্জে, শহর-নগরে অসংখ্য ক্রেতা বা ভোক্তাকে কি একইভাবে তাদের বন্ধু ভাবেন? না, ভাবেন না। তবে কদাচিৎ দু-একজন সহৃদয় ব্যবসায়ী মনে করলে করতেও পারেন, কিন্তু বেশির ভাগের মধ্যে এ ধারণা নেই, এ সংস্কৃতির চর্চাও নেই। আর নেই বলেই বেশির ভাগ ব্যবসায়ী তাদের ক্রেতা বা ভোক্তাদের ওজনে কম দেন, পণ্যে ভেজাল দেন, কথায় কথায় মিথ্যা বলেন, প্রতারণা করেন, কারণে-অকারণে দাম বাড়ান ইত্যাদি। এ জন্য সাধারণ মানুষের অর্থাৎ আমজনতার দৈনন্দিন জীবনে হয়রানি ও বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। এখানে আমার একটি ছোট্ট পুরনো অভিজ্ঞতার কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকের কথা। আমি গ্রীষ্মের ছুটিতে সপরিবারে দেশে গেছি। উঠেছি মোহাম্মদপুরে আমার শ্বশুরবাড়িতে। ওই সময় একদিন দুপুরবেলা মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারে গিয়েছি আম কিনতে। রাস্তার পাশে এক আমওয়ালা থরে থরে বড় বড় আম সাজিয়ে বসে আছে। তাজা আমগুলো দেখে খুব লোভ হলো। দামদর ঠিক করে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আম মিষ্টি হবে তো?' এ রকম প্রশ্নের উত্তরে অনেক সময় আমওয়ালারা ছুরি দিয়ে কেটে একচিলতে আম খেতে দেয়, কিন্তু ওই আমওয়ালা তা করল না। সে উল্টো আমাকে মিষ্টি সুরে বলল, 'বলেন কী সাব? আমার আম মধুর মতো মিষ্টি হবে। বাড়িতে নিয়ে যান, কেটে খান, যদি আম টক হয়, নিয়ে আসবেন, টাকা ফেরত দেব, সঙ্গে রিকশা ভাড়াও।' অভিজ্ঞতা না থাকলে এমন কথায় কারো বিশ্বাস না হয়ে পারে? বাড়িতে এনে দেখা গেল আম এতই টক যে মুখেই দেওয়া যাচ্ছে না। জুলাই-আগস্টের ওই দিনটি ছিল ভীষণ গরম, না হলে ঠিকই রিকশা ভাড়ার জন্য আমের ছালা নিয়ে বাজারে ফিরে যেতাম।
আমি জানি, চোরা না শোনে ধর্মের কথা, তবু সেসব অসৎ বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীর বিবেকের উদ্দেশ্যে দু-একটি কথা বলেই আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই। আমার প্রিয় ব্যবসায়ী ভাইয়েরা, আপনারা কখনো ভেবে দেখেছেন? যেসব ক্রেতা বা ভোক্তা হরহামেশা আপনাদের দোকানে বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আসেন, আপনাদের থেকে পণ্য কিংবা সেবা কেনেন, আপনাদের ব্যবসা দেন, মুনাফা দেন, তাঁদের চেয়ে বড় উপকারী আপনাদের কাছে আর কেউ কি হতে পারে? তাঁরা আপনাদের আপনজন, হৃদয়ের বন্ধু। তাঁদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করুন। তাঁদের ঠকানোর চেষ্টা করবেন না, তাঁদের প্রতারিত করবেন না। মনে রাখবেন, তাঁদের জন্যই আপনারা ব্যবসায় টিকে আছেন, মুনাফা কামাই করছেন, শান-শওকতের সঙ্গে জীবনযাপন করছেন, বাড়ি বানাচ্ছেন, গাড়ি হাঁকাচ্ছেন। স্মরণ করুন, খলিফা ওমর (রা.)-এর সময়ের সেই ছোট্ট মেয়েটির কথা, যাকে তার মা বলেছিল, 'আজ দুধে পানি মিশিয়েছিস'? মেয়েটি বলেছিল, 'না, মেশাইনি'। 'রাতের আঁধারে এই কুঁড়েঘরে ওমর দেখতে পাবে না, মেশা, জলদি পানি মেশা'। বলেছিল মা। মেয়েটি তখন উত্তর দিয়েছিল, 'মা, ওমর দেখতে না পেলেও আল্লাহ যে দেখবেন!'
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি;
সম্পাদক, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
Awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.