আমি কী ভাবছি- কিশোরী তোমার জন্য by ডা. সাঈদা খান

স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে ‘বাংলাদেশ ব্রেস্ট ক্যানসার সাপোর্ট গ্রুপ’ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের ছাত্রীদের, মায়েদের ও মেয়েদের জন্য সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করে থাকে। এসব অনুষ্ঠান শেষে দেখা যায়, বয়স্ক নারীদের তুলনায় কমবয়সী মেয়েরাই উৎকণ্ঠার সঙ্গে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য অনুরোধ করে বেশি;


যদিও তাদের বেশির ভাগ সমস্যা ও উপসর্গ হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকালের স্তন গঠনের স্বাভাবিক পরিবর্তন নিয়ে। যেমন—স্তন ভারী বোধ হওয়া, স্ফিত হয়ে যাওয়া (বিশেষ করে মাসিকের আগে), স্তনে ব্যথা, চাকা বা দলা দেখা দেওয়া ইত্যাদি।
স্তন গঠন ও পরিপূর্ণ হওয়ার সময় কিশোরীদের স্তনে যেসব পরিবর্তন হয়, সেগুলো স্বাভাবিক হলেও তাদের তা জানা নেই। অজ্ঞতার কারণে তারা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। ভুল ধারণা, ভয়ভীতি ও অজানা আশঙ্কায় তারা নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকে, কাউকে খুলে বলতে পারে না।
আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরের তিন হাজার স্কুল-কলেজের মেয়েদের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখা গেছে, তাদের বেশির ভাগেরই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসকের কাছে স্তনের মতো সংবেদনশীল ও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলা সম্ভব হয় না। প্রায় ৯০ শতাংশ মা চান তাঁদের মেয়েদের সঙ্গে স্তন গঠনের প্রক্রিয়া ও এর স্বাস্থ্য সম্পর্কে কথা বলতে। কিন্তু প্রচলিত সামাজিক প্রথার কারণে বা অজ্ঞতার কারণে খুব অল্পসংখ্যক মা এ ব্যাপারে কথা বলতে পারেন। ৩০ শতাংশ মেয়ে স্তনের স্বভাবিক পরিবর্তনকে স্তন ক্যানসারের লক্ষণ বলে মনে করে। ২০ শতাংশ কিশোরী ভাবে, স্তনে ব্যথা, ইনফেকশন ও দুশ্চিন্তার কারণে বা জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ খেলে স্তন ক্যানসার হয়ে থাকে। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই স্তন ক্যানসারের জন্য ঝুঁকির কারণ নয়।
স্তন ক্যানসার কিশোরী বা তরুণীদের সাধারণত হয় না। এর জন্য বয়স একটি বিবেচ্য বিষয়। বয়স যত বাড়তে থাকে, স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি তত বেশি হতে থাকে। ৫০ বছর বয়সে স্তন ক্যানসারের যে ঝুঁকি, ৮০ বছর বয়সে সে ঝুঁকি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। স্তন ক্যানসারে ৮২ শতাংশ আক্রান্ত নারীর বয়স ৫০ বছরের ওপরে। অতএব, কৈশোরে স্তন ক্যানসার হতে পারে—এমন দুর্ভাবনার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রয়োজন রয়েছে স্তনের গঠনপ্রক্রিয়ার স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে জানার এবং স্তন পরিচর্যায় যত্নশীল হয়ে ক্যানসার প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার।
কৈশোরে বা বয়ঃসন্ধিকালে স্তন গঠনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ১০ বছরেরও বেশি সময় লাগে। স্তনে ব্যথা সাধারণত মাসিকের কয়েক দিন আগে শুরু হয় এবং মাসিকের পর ব্যথা কমে যায়। মাসিক ছাড়াও অনেক কারণে স্তনে ব্যথা হতে পারে। কিশোরী-তরুণীদের মাসিকের সঙ্গে সম্পর্কিত স্তনে ব্যথা কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে। তবে ব্যথার সঙ্গে স্তনে অন্য কোনো উপসর্গ না থাকলে তেমন কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। ব্যথা বেশি হলে ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালে এসব পরিবর্তনের কোনোটিই স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় না। তবে এ ধরনের সমস্যায় একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞেরে পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় একজন ব্রেস্ট সার্জনের পরামর্শ মিলে। সাময়িক এই সমস্যাগুলো থেকে স্বস্তি পেতে কয়েকটি ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে:
ক. এ সময়ে ভালো সাপোর্ট দেওয়া ব্রা পরা উচিত। স্পোর্টস ব্রা ব্যবহার এ সময়ে আরামদায়ক, রাতে অপেক্ষাকৃত ঢিলেঢালা ব্রা ব্যবহার করা ভালো।
খ. স্তন ভারী বোধ হলে এবং সঙ্গে ব্যথা থাকলে বোতলে হালকা গরম বা ঠান্ডা পানির সেঁক দেওয়া যায়।
গ. বয়ঃসন্ধিকালে স্তনকোষ অত্যন্ত সংবেদনশীল থাকে। এ সময়ের খাদ্যদ্রব্য, পানি, আলো-বাতাস, মোটকথা যে পরিবেশে কিশোরীর বেড়ে ওঠা, তার ওপর নির্ভর করেই গড়ে ওঠে স্তন গঠনের ভিত। তাই খাদ্যদ্রব্য হতে হবে সুষম। সুষম বলতে চাল, ডাল, মাছ, মাংস পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি এবং বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফল থাকতে হবে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়। এ সময় চা, কফি, আইসক্রিম ও চকলেট খাওয়া বাদ দিতে হবে। বেশি লবণযুক্ত খাবার খাওয়াও বাদ দিতে হবে।
ঘ. শরীরের ওজন সঠিক রাখতে সুষম খাবার ও পছন্দমতো যেকোনো ধরনের ব্যায়ামের (হাঁটা, দড়ি লাফ, সাঁতার, সাইক্লিং ইত্যাদি) অভ্যাস তৈরি করতে হবে।
স্তন ক্যানসার সম্পর্কে সব ভয়ভীতি ও অজ্ঞতা, সর্বোপরি নেতিবাচক উপলব্ধিকে শিক্ষা ও সচেতনতা দিয়ে দূর করতে হবে। স্তন ক্যানসার একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। সচেতন থাকলে প্রতিরোধ করা যায়। বয়ঃসন্ধিকালের সাধারণ সমস্যাগুলো ভবিষ্যতে যাতে কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলতে না পারে, সে জন্য কিশোরী বয়সেই স্তন পরিচর্যায় মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিক সহযোগিতা থাকলে তারুণ্যের নিজস্ব শক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে স্তন ক্যানসারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের উদ্যোগ তারা নিজেরাই নিতে পারবে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ব্রেস্ট ক্যানসার সাপোর্ট গ্রুপ

No comments

Powered by Blogger.