৭ই নভেম্বরের তাৎপর্য by ড. এমাজউদ্দিন আহমদ

বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে ৭ নভেম্বরের তাৎপর্য স্মরণযোগ্য। বাংলাদেশ রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধারা সুনির্দিষ্ট হয়েছে তার জন্মলগ্ন থেকেই। এর স্বতন্ত্র প্রকৃতি রয়েছে। রয়েছে এর নিজস্ব সুর-ছন্দ। এর নিজস্ব বাণী।


নিজস্ব ব্যঞ্জনা। এ ধারণার বিপরীতে গেলে তা দুর্যোগকবলিত হতে বাধ্য। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার সরব উচ্চারণ তারই প্রতিফলন। এ সুর আত্মপ্রত্যয়ের। এ বাণী জাতীয়তাবাদের। এ ব্যঞ্জনা আত্মনির্ভরশীলতার।
তিনজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে ৭ নভেম্বরের অধ্যায়। ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এক সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। সশস্ত্র বাহিনী বঙ্গভবন ছাড়া প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে চিফ অব আর্মি স্টাফের পদ থেকে পদচ্যুত এবং বন্দি করা হয়। খালেদ নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সামরিক বাহিনীরপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। খন্দকার মোশতাক আহমদ পদত্যাগ করলে তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দান করেন। মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করেন। জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সামরিক শাসন জারি করেন তিনি। মেজর হাফিজের মাধ্যমে ১৫ আগস্টে অভ্যুত্থানকারী মেজরদের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া করেন। স্থির হয়, তখনো বঙ্গভবনে অবস্থানকারী ১৫ আগস্টে অভ্যুত্থানকারী মেজররা ৪ নভেম্বর নিরাপদে দেশত্যাগ করবেন। অস্ত্রশস্ত্র তখন ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আসবে। ৪ নভেম্বর মেজররা দেশত্যাগ করলেন বটে, কিন্তু ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর। খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সারা দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তাঁর এ অভ্যুত্থান কিন্তু ছিল অত্যন্ত স্বল্পকাল স্থায়ী। মাত্র চার দিনের মাথায় ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সিপাহি-জনতার বিপ্লবে খালেদ মোশাররফের সব পরিকল্পনার অবসান ঘটে। সিপাহি-জনতার বিপ্লবের গভীরতায় তিনি হন হকচকিত। ঢাকা ত্যাগ করার সময় শেরেবাংলা নগরের উপকণ্ঠে বিপ্লবী সৈনিকদের দ্বারা তিনি হন নিহত। পরবর্তী পর্যায়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হলেন। খালেদ মোশাররফ একজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধা। ২ নম্বর সেক্টরে তাঁরই নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। তাঁর নামের আদ্যাক্ষর ধারণ করেই কে ফোর্স (K-Force) সংগঠিত। তাঁর মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে কেন গেলেন? অভ্যুত্থানে তাঁর লক্ষ্য কী ছিল? তিনি কী পেতে চেয়েছিলেন?
ওই সব প্রশ্নের উত্তর একেকজন বিশ্লেষক একেকভাবে দিয়েছেন। কেউ বলেন, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল এক ধরনের পাল্টা-অভ্যুত্থান। শেখ মুজিবের ভাবমূর্তি এবং তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রবর্তিত করার লক্ষ্যেই এটির আয়োজন। খালেদ, শাফায়াত উভয়েই ছিলেন মুজিবভক্ত। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁদের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এমনকি তাঁদের কোনো কোনো নিকটাত্মীয় শেখ মুজিবের একদলীয় ব্যবস্থা, বাকশালের সদস্য ছিলেন। ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই অভ্যুত্থানের পরে যে মিছিল সংগঠিত হয় তার কিছু কিছু স্লোগানে শেখ মুজিবকে 'জাতির পিতা' হিসেবে স্বীকৃতি এবং ১৫ আগস্টে অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও ছিল। কেউ বা বলে, একজন প্রফেশনাল সৈনিক হিসেবে ১৫ আগস্ট মেজরদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে তিনি ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হন এবং এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পদ সোপান, প্রত্যক্ষ নির্দেশসূত্র এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। তখনো আটটি ট্যাংক এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মেজররা বঙ্গভবনে অবস্থান করছিলেন। সেনাবাহিনী ছিল দ্বিধাবিভক্ত। এক অংশ বঙ্গভবনে, অন্য অংশ ক্যান্টনমেন্টে অসহায়, দায়িত্বহীন, অকর্মণ্য যেন। তাই তিনি সামরিক বাহিনীকে শৃঙ্খলার ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে তাঁর হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন।
কারো কারো মতে, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল প্রতিনিয়ত অতি সঙ্গোপনে তথ্য সংগ্রহকারী ভারতীয় 'র' (RAW)-এর সহযোগিতায় ভারতপন্থী এক অভ্যুত্থান। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ভারতের জন্য শুধু মারাত্মক ছিল না, তা ছিল ভয়ংকর রূপে অপমানসূচকও। বিশেষ করে খন্দকার মোশতাকের পাকিস্তানপন্থী, প্রো-চায়নিজ এবং আমেরিকাঘেঁষা নীতির জন্য। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের মৃত্যুতে ভারত শুধু যে এক বিশ্বস্ত বন্ধুকে হারায় তা-ই নয়, এরপর বাংলাদেশে ভারতঘেঁষা কোনো কিছুর অবশিষ্ট ছিল না। ভারতীয় পত্রপত্রিকা ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে যেভাবে চিত্রিত করে এবং ভারতের বিভিন্ন অংশে ভারতীয় জনগণের যে আনন্দ-উল্লাস পরিলক্ষিত হয়, তা এ মতবাদকে সমর্থন করে। বাংলাদেশের কোনো কোনো পত্রপত্রিকায়ও এর আভাস মেলে। Bangladesh Times পত্রিকার ৮ নভেম্বরের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, '৩ নভেম্বরের পাল্টা-অভ্যুত্থানে বিদেশি হস্তক্ষেপের আভাস রয়েছে।'
বিশ্লেষকদের এসব যুক্তির কোনো কোনোটি খণ্ডনযোগ্য। আওয়ামী লীগের প্রতি খালেদ মোশাররফের দুর্বলতা হয়তো ছিল। তিনি হয়তো বা মুজিবভক্তও ছিলেন। কিন্তু ১৯৭২-৭৫ আমলের আওয়ামী লীগ শাসনকে, বিশেষ করে বাকশালকে পুনরুদ্ধারের কোনো সংকল্প তাঁর ছিল না। আওয়ামী লীগ শাসন পুনঃপ্রবর্তনের কোনো লক্ষ্য থাকলে তিনি মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করতেন না। ভেঙে দিতেন না জাতীয় সংসদ। সামরিক শাসন জারিরও কোনো চিন্তাভাবনা করতেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে মিছিলটি সংগঠিত হয় এবং মিছিল থেকে যে স্লোগান দেওয়া হয় তাতেও তিনি খুশি হননি। জানা যায়, ওই মিছিলের পরে তিনি বলেছিলেন, 'আমি শেষ হয়ে গেলাম।' ওই মিছিল সংগঠনের জন্য আওয়ামী লীগ যতটুকু তৎপর ছিল, মণি সিংয়ের কমিউনিস্ট পার্টি এবং মোজাফ্ফর আহমদের ন্যাপও তেমনি তৎপর ছিল। তেমন হলে খালেদ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় চার নেতার জীবন রক্ষা করে অবিলম্বে তাঁদের জাতির সামনে আনতে পারতেন। তাও তিনি করেননি। এমনকি চার নেতার মৃত্যুর পর তাঁদের মরদেহ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে তিন জাতীয় নেতার মাজারের পাশে দাফন করার যে প্রস্তাব তিনি পেয়েছিলেন তাতেও রাজি হননি। আওয়ামী শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আগ্রহী থাকলে ৩ নভেম্বর অথবা অনতিবিলম্বে তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের সমন্বয়ে একটা মন্ত্রিপরিষদও গঠনের উদ্যোগ নিতে পারতেন। এগুলোর কোনোটির দিকেই তিনি যাননি।
আমার মনে হয়েছে, খালেদের ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল একটা 'ভেটো ক্যু' বা 'প্রি-এম্পটিভ ক্যু' (Veto or Preemtive Coup)। দুটি কারণে তিনি পূর্বাহ্নেই আঘাত হানতে চেয়েছিলেন। তখন সামরিক বাহিনীর অবস্থা সন্তোষজনক ছিল না। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা সামরিক বাহিনীর মৌল নির্দেশ সূত্র ছিন্ন করে শৃঙ্খলাবোধ যে তার প্রাণ তা নিঃশেষ করতে চেয়েছিল বঙ্গভবনে অবস্থানের মাধ্যমে। দ্বিতীয় কারণটি ছিল আরো জরুরি। সেনা ও বিমানবাহিনীর মধ্যে তখন বহুসংখ্যক বিপ্লবী সংস্থা গঠন করে প্রচুরসংখ্যক বিপ্লববাদী সৈনিক প্রস্তুত হচ্ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তগত করতে। তাদের লক্ষ্য ছিল, শ্রেণীহীন সশস্ত্র বাহিনীকে আরো তীক্ষ্নধার করে তার মাধ্যমে সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন। এই অবস্থায় খালেদ মোশাররফ সম্ভবত চেয়েছিলেন ক্যুর মাধ্যমে দুই গ্রুপকেই একসঙ্গে নির্মূল করে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে সনাতন সশস্ত্রবাহিনীর আদলে পুনর্গঠন করতে।
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি তাঁর কথা এ প্রসঙ্গে এসে যায়। তিনি কর্নেল তাহের। একজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধা। কর্নেল তাহের ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। কামালপুরের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তিনি পা হারান। মুক্তিযুদ্ধে শৌর্য প্রদর্শনের জন্য তিনি হন বীর উত্তম। তিনি শুধু একজন কৃতী ও দক্ষ সৈনিক ছিলেন না, তাঁর চিন্তা-ভাবনা ছিল বৈপ্লবিক। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তাই তিনি ভাবতেন, সামরিক বাহিনীকে সৃজনমুখী, উৎপাদনক্ষম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ এক জাতীয় প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে এবং সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের নিমিত্তে এ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে। আর একজন মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল জিয়াউদ্দীনের চিন্তা-ভাবনাও ছিল প্রায় অনুরূপ। কর্নেল তাহের এ লক্ষ্যে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আন্ডারগ্রাউন্ড শাখা বিপ্লবী শক্তিগুলোর সমন্বয়ে মনোযোগী হন। সেনা ও বিমানবাহিনীতে প্রচুরসংখ্যক বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সংগঠিত হয়।
৩ নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলে কর্নেল তাহের একদিকে ওই অভ্যুত্থানকে ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে তার দুর্বল ভিত্তিকে আরো শিথিল করার দিকে যেমন মনোযোগী হন, তেমনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সৈনিকদের সংগঠিত করার প্রয়াস গ্রহণ করেন। ৫ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টগুলো হাজার হাজার লিফলেটে ছেয়ে যায়। সামরিক কর্মকর্তাদের অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থানে সাধারণ সৈনিকদের কোনো আগ্রহ নেই, এ যেমন বলা হয়, তেমনি জানিয়ে দেওয়া হয় যে বিপ্লবকে সফল করার জন্য সৈনিকরা যেন তৈরি থাকে। ৬ নভেম্বর রাতে কর্নেল তাহেরের সভাপতিত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় ৭ নভেম্বরের সকাল ৯টায় গুরুত্বপূর্ণ অভ্যুত্থান সার্থক করার জন্য কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা, সশস্ত্র বাহিনী পরিচালনার জন্য এক বিপ্লবী সামরিক পরিষদ গঠন করা, সব দলের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিদান, বাকশাল ব্যতীত অন্যান্য দলের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি বাস্তবায়ন করা। এভাবে ৭ নভেম্বর বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয় এবং বিপ্লবের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হন।
জেনারেল জিয়া ছিলেন একজন খ্যাতনামা সৈনিক। ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে কৃতী যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধে ১ নম্বর সেক্টরে তিনি নেতৃত্ব দেন। জেড ফোর্স (Z-Force) তাঁরই পূর্ণ নাম ধারণ করে। বীর উত্তম অভিধায় জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করে। ১৯৭২ সালে তিনি হন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট তিনি হন সামরিক বাহিনীর প্রধান। ৩ নভেম্বর রাত ১টায় তাঁকে খালেদ মোশাররফ বন্দি করেন। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে তিনি শুধু মুক্তই হলেন না, তিনি এলেন জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে।
কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনা কেন সফল হলো না, তার পর্যালোচনা এ পরিসরে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় জেনারেল জিয়ার সাফল্যের মূলে কোন কোন উপাদান কার্যকর হয়েছিল। শুধু এটুকু বলা প্রয়োজন, ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে জেনারেল জিয়া হয়ে ওঠেন জাতীয় আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। ভারতবিরোধী মানসিকতার কেন্দ্রবিন্দু। বাকশালবিরোধী চেতনার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি। আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের প্রত্যক্ষ নিদর্শন। জিয়া এই সন্ধিক্ষণে সিপাহি-জনতার সামনে দাঁড়ালেন ত্রাতা হিসেবে। নতুন যুগের পথপ্রদর্শক হিসেবে। বাংলাদেশের অধ্যাত্ম সত্তার রূপকার হিসেবে। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব এ কারণে এ জাতির কাছে এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন।
কর্নেল তাহেরের স্বপ্ন ছিল, সামরিক বাহিনীকে পুনর্গঠিত করে তার মাধ্যমে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা। শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের পূর্ণ সত্তার বিকাশ সাধন করা। জিয়া চেয়েছেন, জনগণের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার বিন্ধ্যাচল উল্লঙ্ঘন করতে। পরনির্ভরশীলতার সব বাধা দুমড়ে-মুচড়ে, জাতীয়তাবাদী চেতনার আগুনে সব বৈষম্য ও অনাচার ঝলসে জাতীয় সংহতির মূল সুদৃঢ় করতে। তিনি চেয়েছেন, বাংলাদেশ নিজের ওপর আস্থা রেখে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। বাংলাদেশের জনগণ স্বীয় সত্তায় বিশ্বাসী হয়ে মাথা উঁচু করুক সগৌরবে। তখন ভারতবিরোধী মনোভাবের মতো স্থূল প্রবণতা অথবা ভারতের ওপর নির্ভরশীলতার মতো হীনম্মন্যতা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে আর ব্যাহত করবে না। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার উত্তরণ এই চেতনারই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অনুরণন।
৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মৌল সূত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিপ্লবী চেতনা দুই ধারায় ছিল প্রবাহিত। এক খাতে ছিল সমাজ পুনর্গঠনের জন্য বিপ্লবী চিন্তাস্রোত। অন্য খাতে প্রবাহিত হয়েছিল ভারতবিরোধী ও ভারতবিদ্বেষী চেতনা। চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতবিরোধী মনোভাব, বিশেষ করে আত্মনির্ভরশীলতার দুর্দমনীয় স্পর্ধাই জয়ী হয় এবং তারই শীর্ষে অবস্থান করেছিলেন জেনারেল জিয়া। এ দেশের রাজনীতির গতিধারায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর যা ঘটেছিল, বাংলাদেশের রাজনীতির মৌলপ্রকৃতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটলে, ৫০ বছর পরও এমনি অবস্থায় এই সুর ছন্দিত হবে। উচ্চারিত হবে তেমনি বাণী। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই স্রোতের বিপরীতে চললে নিজের বিপদই শুধু ডেকে আনবে তা-ই নয়, সমাজে বিপ্লবের শিখা আবার প্রজ্বলিত করবে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.