সময়ের প্রতিধ্বনি-বিএনপির ভারতনীতি এবং বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন সমীকরণ by মোস্তফা কামাল

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভারত সফর নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ভারত সরকারের মূল চালিকাশক্তি কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করতে না পারলেও রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।


এসব বৈঠকে তিনি প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার অঙ্গীকার করেন। তিনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আশ্বাস দিয়েছেন, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। তাঁর এই আশ্বাসের ফলে শান্তিকামী উভয় দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের 'স্বস্তি' ফিরে এসেছে।
আমরা জানি, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ওই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমাতে হিমশিম খাচ্ছে সে দেশের সরকার। এ ইস্যুতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ভারতকে বিশেষভাবে সহযোগিতা দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও একই ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস ভারতকে দিয়েছে। উভয় দেশের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকলে সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে।
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপি সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোট ও ভারতে হিন্দুত্ববাদী দল হিসেবে পরিচিত বিজেপি তখন সে দেশে ক্ষমতায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, আমেরিকার রিপাবলিকান, ভারতের বিজেপি ও বাংলাদেশের বিএনপির মধ্যে এক ধরনের সখ্য রয়েছে। তারই সূত্র ধরে বিজেপি সরকারের আমলে বিএনপি সরকার কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কার্যত তার উল্টো হয়েছে। ভারতে বিজেপি এবং বাংলাদেশে বিএনপি সরকারে থাকলেও দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল।
দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান তখন দিলি্ল সফর করেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র ও উপপ্রধানমন্ত্রী এল কে আদভানির সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে মোরশেদ খান বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে আমাদের ব্রিফ করেন (তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে দিলি্লতে গিয়েছিলাম)। তিনি তখন বলেছিলেন, 'আমি আদভানির রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি ভীষণ উত্তেজিত। বারবার বলছেন, আপনারা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দিচ্ছেন। অনেক ক্যাম্প সেখানে রয়েছে। আমাদের কাছে তালিকা রয়েছে। আমি বারবার তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করি। তাঁকে এ-ও বলি, আপনাদের মিডিয়া সদস্যদের বাংলাদেশে পাঠান। আমরা হেলিকপ্টার দেব। তাঁরা ঘুরে দেখবেন। যদি কোনো ক্যাম্প পাওয়া যায়, তাহলে তার জন্য যে মূল্য দিতে হয়, আমরা দেব। কিন্তু তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইলেন না।' সেই থেকেই দুই দেশের মধ্যে আস্থার সংকট প্রকট হয়ে ওঠে।
দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে এই অবিশ্বাস কিছুতেই দূর করা সম্ভব হয়নি। তবে এ জন্য বিএনপির কিছু অতিউৎসাহী নেতা দায়ী। কোনো কোনো নেতা তখন বলেছিলেন, আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারত যেমন সহযোগিতা দিয়েছে, তেমনি আমাদেরও উচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থন জোগানো। ব্যস, যা হওয়ার তা-ই হলো! দুই দেশের আস্থার অভাব আরো প্রকট হয়ে উঠল। ফলে বিএনপি শাসনামলে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে ছিল না। বাংলাদেশের দিক থেকে কূটনৈতিক পর্যায়ে অনেক চেষ্টা-তদবির করেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়নি।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতেও একটা কথা চালু আছে। সেটা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ভারতের পছন্দের দল। আবার বিএনপিকে ভারতবিদ্বেষী দল হিসেবে মনে করা হয়। এর কারণও অবশ্য আছে। বিএনপির ক্ষমতায় আসার অন্যতম 'ট্রাম্পকার্ড' ছিল ভারত-বিরোধিতা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশ ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হবে, আর বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা হবে- এমন বক্তৃতা দেশের মানুষ লুফে নিয়েছিল।
১৯৯১ সাল থেকেই দেখে আসছি, বিএনপির রাজনীতির মূলমন্ত্রই ছিল ভারত-বিরোধিতা। আওয়ামী লীগবিরোধীরাই মূলত ভারতবিরোধী নীতির সমর্থক। ভারত-বিরোধিতা ছাড়া আওয়ামী লীগ-বিএনপির আদর্শগত তেমন কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। আমরা যদি বিগত নির্বাচনগুলোর দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের মনে পড়বে, ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি জাতীয় নির্বাচনেই ভারত-বিরোধিতা ছিল রাজনৈতিক ট্রাম্পকার্ড।
প্রতিটি নির্বাচনী সভা-সমাবেশেই বলতে শুনেছি, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে দেশের এক-তৃতীয়াংশ ভারত হয়ে যাবে। মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে। এসব কথা তখন সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছিল বিএনপি। এর কারণও অবশ্য আছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা অংশ প্রচণ্ডভাবে ভারতবিরোধী। এ ক্ষেত্রে তারা কোনো যুক্তি মানে না। এ ধরনের মানুষের মনোভাবকে পুঁজি করেছিল বিএনপি। ফলে ১৯৯১-এর নির্বাচনের শুরুর দিকে নির্বাচনী হাওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকলেও নির্বাচনের আগে আগে বিএনপির পক্ষে এক ধরনের গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। ওই নির্বাচনে আগের সব ধরনের জরিপ প্রতিবেদন ভুল প্রমাণিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৬ কিংবা ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিএনপি নেতারা ভারতবিরোধী বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন।
২০০৯ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভারত-বিরোধিতা নতুন ভোটারদের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। বরং সরকার থেকে সদ্যবিদায়ী দল বিএনপির শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। তবে এটাও ঠিক, নির্বাচনে প্রভাব না পড়লেও দেশের একটা বড় অংশের মানুষ এখনো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দিতে বিএনপির কোনো বিকল্প নেই। এই শ্রেণীর মানুষ বিএনপি ছাড়া অন্য কোনো দলকে ভোট দেয় না।
অন্যভাবে বললে, সংখ্যালঘু ভোটারদের আওয়ামী লীগের 'ভোটব্যাংক' হিসেবে ধরা হয়। আবার ভারতবিদ্বেষীদেরও বিএনপির 'ভোটব্যাংক' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বিএনপির ভারতনীতিতে আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে রাজনীতিতে নতুন ধরনের মেরুকরণ শুরু হয়েছে। শুধু বিএনপির সমর্থকই নয়, শরিকদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির ভারতবিরোধী অংশটি কিছুতেই খালেদা জিয়ার এই নতুন উদ্যোগ মেনে নিতে পারেনি। জোটের শরিক ইসলামপন্থী দলগুলো নতুন জোট করার কথা ভাবছে। এর ফলে বিএনপির 'ভোটব্যাংক'-এর কী হবে, তা নিয়ে নিশ্চিত নন দলের অনেকেই।
অবশ্য বিএনপির মধ্যপন্থী নেতারা বেজায় খুশি। তাঁরা বরাবরই বলে আসছিলেন, ভারত-বিরোধিতা এখন সেকেলে ইস্যু। এই ইস্যুতে নতুন ভোটারদের মন জয় করা যাবে না। বিএনপিকে একটি মডারেট (না ডান, না বাম) দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দলগুলোকে পরিত্যাগ করতে হবে। তাহলে সব মহলের সমর্থন পাওয়া যাবে। সেটাই বিএনপির বড় পুঁজি হবে। ভারতবিদ্বেষী ভোটব্যাংক হারালেও নতুন ভোটব্যাংক তৈরি হবে।
বলতে দ্বিধা নেই, খালেদা জিয়া দেরিতে হলেও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে ভারতবিরোধী ট্রাম্পকার্ড দিয়ে আর নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে না। ভারত নিকট প্রতিবেশী বৃহত্তর দেশ। ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রেখে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। বিএনপি যেহেতু ক্ষমতার রাজনীতি করে সেহেতু ভারতের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতেই হবে। তা ছাড়া ভারত-ইস্যুতে বাংলাদেশের দুটি বড় দলের ঐকমত্য না থাকলে শেষ পর্যন্ত দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পারস্পরিক আস্থাহীনতার কারণে দুই দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। নেতৃত্বের ভুলের খেসারত দিচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সংগত কারণেই বিএনপি নেত্রীর ভারতনীতিতে আমূল পরিবর্তনের নতুন উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এর ফলে দেশের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ শুরু হবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিএনপিকে সঠিক ধারায় পরিচালনা করতে সক্ষম হলে নিশ্চয়ই প্রত্যাশার নতুন সূর্য উদিত হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.