আন্তর্জাতিক ফোন কলে দুর্নীতি-দুদককে সর্বোচ্চ সহায়তা দিন

আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ দেশের বাইরের অন্য কোনো স্থান থেকে কোনো আত্মীয় বা পরিচিতজন ফোন করেছে মোবাইলে- বোঝার উপায় নেই কে ফোন করল। মনিটরে ভেসে উঠেছে একটি অচেনা নম্বর।


কখনো সেখানে ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো মোবাইল অপারেটর বা ল্যান্ডফোনের নম্বর, আবার কখনো অদ্ভুত একটি ফোন নম্বর ভেসে উঠছে মনিটরে। এটা হচ্ছে অবৈধ ভিওআইপি কল আসার সর্বশেষ কৌশল। দীর্ঘদিন ধরে এই ভিওআইপিসহ নানা প্রযুক্তির মাধ্যমে অবৈধভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার যে দুর্নীতি চলে আসছে, সে সম্পর্কে জনমনে এরই মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ধারণা জন্মেছে। এ দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ সরকার বৈদেশিক মুদ্রায় হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তা নিয়ে বহু বছর কথা হচ্ছে। সংবাদপত্রে অনেক লেখালেখি হয়েছে, সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি মোবাইল ফোন কম্পানি টেলিটক ও বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) বিরুদ্ধে অবৈধ ভিওআইপিতে জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। কারণ অবৈধ ভিওআইপির সঙ্গে সব সরকারের ভিআইপিরা জড়িত। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অবৈধ ভিওআইপিতে সংশ্লিষ্টতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ পুরনো। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অন্য সব ব্যাপারের মতোই ভিওআইপির দুর্নীতি নিয়ে কোনো সরকারের ঘুম ভাঙেনি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক কল নিয়ে পাঁচটি মামলা করেছে। বিটিসিএলে অনিয়ম ও দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছে কমিশন, যেখানে কোটি কোটি টাকার ঘাপলা রয়েছে। তবে দুদক আপাতত শুধু টাকা বাকি রেখে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া ক্যারিয়ারগুলোর বিষয়েই তদন্ত সীমাবদ্ধ রাখছে। অবৈধ ভিওআইপির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। মামলার বাইরেও আরো ক্যারিয়ার রয়েছে এবং সেসব ক্যারিয়ারের কাছে বিটিসিএলের পাওনার পরিমাণ হাজার কোটি টাকা। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক এঙ্চেঞ্জের কল ডিটেইল রেকর্ডার বা সিডিআর দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর রেখে বিটিসিএলের হিসাবের বাইরে প্রতিদিন ১০ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। আমেরিকা, জাপান, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু ক্যারিয়ারের নামে বিটিসিএলের যোগসাজশে যে শত শত কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বৈদেশিক টেলিযোগাযোগে দুর্নীতি সাধারণত প্রযুক্তিনির্ভর। আমরা সেই পারিভাষিক তথ্য-প্রমাণের দিকে নাইবা গেলাম। সেগুলো অবশ্যই দেখবেন সরকারের এ-সংক্রান্ত প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও দুদকের তদন্তকারীরা। যারা দেশকে অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রায় প্রাপ্য হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ববঞ্চিত করেছে, তাদের অবশ্যই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। এটা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ বলে বিবেচিত হতে পারে। আমরা জানি, বিভিন্ন সময় টেলিকম খাতে ব্যবসা করতে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তা নিয়ে পত্রপত্রিকায়ও বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু এ দুর্নীতিতে যারা জড়িত তাদের দুদক অন্তত রাজনৈতিক বিবেচনায় নিস্তার দেবে না বলে আমরা আশা রাখি।
সারা বিশ্বে টেলিকমিউনিকেশন বিস্ময়কর রকম বিস্তার লাভ করেছে। প্রতিদিন লাখ লাখ বৈদেশিক কল বৈধ চ্যানেল এড়িয়ে বাংলাদেশে আসছে। এ খাতকে অচিরেই স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করে তোলা না গেলে একদিকে সরকার যেমন বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হতেই থাকবে, অন্যদিকে এ সুযোগে প্রাপ্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসবে না। সরকার যদি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শুধু বদলি করাকে শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে এ খাতের দুর্নীতি কমানো সম্ভব হবে না। দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে দুদককে সব ধরনের সহায়তা দেবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.