বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৬১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম অতুলনীয় এক অধিনায়ক ১৯৭১ সালে খালেদ মোশাররফ ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫৭ পদাতিক ব্রিগেডের মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।


১৯ মার্চ তাঁকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসেবে বদলি করা হয়। এর অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। ২২ মার্চ তিনি সেখানে যোগ দেন। ২৪ মার্চ ভারত থেকে তথাকথিত নকশালদের অনুপ্রবেশ রোধের কথা বলে তাঁকে এক কোম্পানি সেনাসহ মৌলভীবাজারের শমশেরনগরে পাঠানো হয়।
খালেদ মোশাররফ ২৫ মার্চ সেখানে পৌঁছেন এবং রাতেই গণহত্যার সংবাদ পান। ২৬ মার্চ তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত তাঁর ইউনিটের ডেল্টা (‘ডি’) কোম্পানির অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিলের (বীর বিক্রম, পরে কর্নেল) সঙ্গে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। তিনি তাঁকে বিদ্রোহ করার জন্য উদ্যোগ নিতে বলেন।
এরপর খালেদ মোশাররফ মূল দলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য শমশেরনগর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু পথে ছিল অসংখ্য ব্যারিকেড। ফলে তিনি সময়মতো পৌঁছাতে পারেননি। এর মধ্যে (২৭ মার্চ সকালে) শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালির সেনারা বিদ্রোহ করেন। খালেদ দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছেন এবং রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই খালেদ মোশাররফ ঢাকা-কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার ইপিআর সেনা, পুলিশ-আনসারসহ ছাত্র-যুবক ও সাধারণ জনতাকে সংগঠিত করেন। তাঁর দলে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করে বিরাট এক বাহিনী গড়েন। এ বাহিনীর অধীন মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও এর আশপাশ এলাকায় শক্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে।
প্রতিরোধ যুদ্ধকালে খালেদ মোশাররফ অত্যন্ত দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তাঁর অধীন মিশ্রবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে পুনরায় সংগঠিত হয়ে তিনি বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা বাহিনী (ক্র্যাক প্লাটুন) গড়ে তোলেন। ক্র্যাক প্লাটুন ঢাকা মহানগরের প্রাণকেন্দ্রে একের পর এক অপারেশন করে পাকিস্তানিদের ভিত্তি কাঁপিয়ে তোলে।
এর মধ্যে (জুন মাসে) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক রূপ পায়। তখন মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে খালেদ মোশাররফকে ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। পরে (সেপ্টেম্বর) তিনি নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘কে’ ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান। তিনি দুই দায়িত্বই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন।
২ নম্বর সেক্টর ও ‘কে’ ফোর্সের আওতাধীন এলাকা ছিল ঢাকা মহানগরসহ জেলার দক্ষিণাংশ, ফরিদপুর জেলার পূর্বাঞ্চল, রাজবাড়ী জেলা, বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা (আখাউড়া-আশুগঞ্জ রেলপথের উত্তরাংশ বাদে) এবং নোয়াখালী, চাঁদপুর ও ফেনী জেলা (মুহুরী নদীর পূর্ব অংশ বাদে)।
সামরিক ও অবস্থানগত দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধকালে এ এলাকার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর আওতায় ছিল ঢাকা মহানগর, অর্থাৎ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের রাজধানী এবং কুমিল্লা সেনানিবাস।
খালেদ মোশাররফের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় ২ নম্বর সেক্টরের নিয়মিত বাহিনী ও স্বল্প প্রশিক্ষণ পাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য অপারেশন করেন। তাঁর সার্বিক নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধও সংঘটিত হয়। এর মধ্যে সালদা নদীর যুদ্ধ অন্যতম। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার অন্তর্গত সালদা নদী। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল কসবায় প্রথাগত (কনভেনশনাল) আক্রমণ চালায়। কসবার বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান। পাকিস্তানিদের সব প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল সুরক্ষিত ও মজবুত বাংকার। আক্রমণের আগে ভারত থেকে অসংখ্য ফিল্ড ও মিডিয়াম আর্টিলারির গোলাবর্ষণ করা হয়। এরপর কসবার চারদিক থেকে পরিচালিত হয় সাঁড়াশি আক্রমণ। পাকিস্তানি সেনাদের পালানোর পথ ছিল না।
খালেদ মোশাররফ নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে (সালদা নদী রণক্ষেত্রে) উপস্থিত থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। রণাঙ্গনে তাঁর উপস্থিতির ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। সেদিন গোটা কসবা এলাকায় ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে সালদা নদী দখল করা সম্ভব হয়নি। তবে কসবার বিরাট এলাকা স্থায়ীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যুদ্ধের একপর্যায়ে খালেদ মোশাররফ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলার স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হন। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য খালেদ মোশাররফকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ০৭।
খালেদ মোশাররফ স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনায় ৭ নভেম্বর তিনি আরও দুই জনসহ (কর্নেল নাজমুল হুদা বীর বিক্রম ও মেজর এ টি এম হায়দার বীর উত্তম) নিহত হন। তাঁকে ঢাকার সামরিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
খালেদ মোশাররফের পৈতৃক বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার মোশাররফগঞ্জ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মোশাররফ হোসেন, মা জামিলা খাতুন। স্ত্রী সালমা খালেদ। তাঁদের তিন মেয়ে। স্ত্রী বর্তমানে ঢাকায় বাস করেন।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

সংশোধনী: গতকাল (৬ নভেম্বর, মঙ্গলবার) এ কলামে প্রকাশিত গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান বীর বিক্রমের প্রতিবেদনে তাঁর মা ও স্ত্রীর নাম এবং ছেলেমেয়ের সংখ্যা ভুল ছাপা হয়েছে। মার নাম সৈয়দা আফুজা খানম, স্ত্রী মুনিরা মোর্শেদ খান। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। অনিচ্ছাকৃত এ ক্রটির জন্য আমরা দুঃখিত।

No comments

Powered by Blogger.