বিজয় ভাষণে ওবামা যা বললেন

ইলিনয়ের শিকাগো নগরীতে সমর্থকদের উদ্দেশ্য ভাষণ দিতে উপস্থিত হন পরপর দ্বিতীয়বারের মত নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সমর্থকরা বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালিসহ জাতীয় পতাকা নাড়িয়ে তাদের প্রিয় প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানান।

নিজের ভাষণে তিনি প্রথমে আমেরিকার জনগণকে ধন্যবাদ জানান। এরপর ধন্যবাদ জানান নিজের রানিংমেট জো বাইডেনকে। নিজের স্ত্রী ও দুই সন্তানকেও ধন্যবাদ জানান তিনি। সমর্থকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আমরা আমেরিকানরা সবাই এক পরিবার, আমরা একসঙ্গে বাঁচবো, এক সঙ্গে মরবো।”
তাকে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাকে আবারও বিশ্বাস করে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।”

তিনি বিশেষ করে ধন্যবাদ জানান নির্বাচনী প্রচারণায় অক্লান্ত পরিশ্রম করা তার প্রচারণা কর্মীদের।

একই সঙ্গে যুদ্ধ শেষ করে শান্তির পথে নতুন যাত্রা শুরুরও অঙ্গীকার করেন তিনি।

সব ভেদাভেদ ভুলে যুক্তরাষ্ট্রের এখন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া জরুরি বলে এসময় উল্লেখ করেন ওবামা।

তিনি অঙ্গীকার করে বলেন,“আমি এবার হোয়াইট হাউজে যাবো আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে, কাজ করবো সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে।”

“আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের করা অঙ্গীকার রক্ষা করবো” উল্লেখ করে ওবামা রিপাবলিকান দলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার জন্য ডেমোক্রেট দলীয় সমর্থকদের আহবান জানান।

ওবামার ভাষণের সময় তার সঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন স্ত্রী মিশেল ওবামা। এছাড়া তার রানিংমেট জো বাইডেনও মঞ্চে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন।

দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে জিতে আত্মবিশ্বাসী ওবামা তার ভাষণে দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেন, “আমেরিকানদের জন্য আরও ভালো সময় অপেক্ষা করছে।”

প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রচারণা ক্যাম্পেইন পরিচালনার জন্য পরাজিত প্রার্থী রমনিকে অভিনন্দন জানিয়ে ওবামা বলেন,“আমি মিট রমনির সঙ্গে একত্রে বসার পরিকল্পনা করছি।” দেশকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে তিনি রমনির সহযোগিতা কামনা করেন।

ভাষণে নিজের সফলতার পেছনে স্ত্রী মিশেলের অবদান স্মরণ করে ওবামা বলেন, “আমি যে নারীকে বিয়ে করেছি তাকে ছাড়া আজকের মানুষে কখনও পরিণত হতে পারতাম না।”

বিরোধী দলের উদ্দেশ্যে শুভকামনা জানিয়ে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক ভিন্নমত সত্ত্বেও আমাদের উদ্দেশ্য একই।”

নির্বাচনে তাকে সমর্থন না করা ভোটারদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আপনাদের ভোট না পেলেও আমি আপনাদের কথা শুনবো”

পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও বসার পরিকল্পনা করছেন উল্লেখ করে বলেন, “আমরা তাদের কথা শুনতে চাই।”

“আমি এর আগে কখনই আমেরিকাকে নিয়ে এত বেশি আশাবাদী হইনি” উল্লেখ করে তিনি বলেন,“প্রগতির পথে আমাদের যা অর্জন তা এগিয়ে নিতে পারবো বলে আমি আশাবাদী”।

সবশেষে তার নির্বাচনী লড়াইয়ের পুরোটা পথ তার সঙ্গে থাকা এবং তার কথায় বিশ্বাস স্থাপনের জন্য সব আমেরিকানের প্রতি ধন্যবাদ জানান তিনি।

এরপর সমর্থক ও নিজের প্রচারণা কর্মীদের আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে বিজয় ভাষণ শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে আসেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ওবামা।

উৎফুল্ল সমর্থকরা এসময় তীব্র হর্ষধ্বণিতে মাতিয়ে তোলে পুরো সমাবেশস্থল। এসময় কারও কারও চোখে দেখা দেয় আনন্দাশ্রু।

২০০৮-এর নির্বাচন বিজয়ী ভাষণে যা বলেছিলেন ওবামা

২০০৮-এ প্রথমবারের মত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর বারাক ওবামা তার নিজ শহর শিকাগোর গ্রান্ট পার্কে যে ভাষণ দেন তা ছিল এক অসাধারণ বিজয়-ভাষণ। ২০০৮ এর নভেম্বরের ৪ তারিখ রাতে দেওয়া ওই ভাষণের প্রত্যক্ষ শ্রোতা ছিল প্রায় আড়াই লাখ। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়ে টিভি, ইন্টারনেট আর রেডিওতে তা দেখেছেন-শুনেছেন কোটি কোটি মানুষ।

আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মত নির্বাচিত একজন অস্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ওবামার সেই সারাজাগানো ভাষণে আলোচিত হয় যুক্তরাষ্ট্র আর বিশ্বের তখনকার মূল সমস্যাগুলো। ওবামা তার ভাষণে নির্বচনী স্লোগান ‘পরিবর্তনের‘ প্রসঙ্গ টানেন বারবার। তিনি রিপাবলিকান ভোটার যারা তাকে ভোট দেননি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি আপনাদেরও প্রেসিডেন্ট হব। এসময় তিনি আবেগমথিত কণ্ঠে তার পরলোকগত নানীর প্রসঙ্গও টানেন যিনি ওই নির্বাচনের মাত্র দুই রাত আগে পরলোকগমন করেন।

৪ বছর পর ২০১২ সালের ৬ নভেম্বরের নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মত নির্বাচিত ওবামা প্রমাণ করেছেন, তিনি আমেরিকার সবার প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছেন। নয় তো দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়া তার পক্ষে অতটা সহজ ছিল না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে এটি ছিল কঠিনতম এক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের নজির।

এখানে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর দেওয়া ওবামার ভাষণটির বাংলা রূপান্তর তুলে ধরা হলো।
  
‘এ রাত আপনাদের প্রশ্নগুলোর জবাব নিয়ে এসেছে’
obama-voice-sm
পরিবর্তন সূচিত হল
আজ আপনাদের মাঝে এমন কেউ উপস্থিত আছেন কি যিনি এখনো সন্দেহ পোষণ করেন আমেরিকা সব সম্ভবের দেশ কি না, এমন কেউ যিনি দ্বিধায় আছেন যে আমাদের প্রতিষ্ঠাতাদেদর স্বপ্নগুলো  এখনো বেঁচে আছে কি না, এমন কেউ যিনি এখনো আমাদের গণতন্ত্রের সক্ষমতাকে সন্দেহের চোখে দেখেন? তাদের সব প্রশ্নের  জবাব হচ্ছে আজকের এই রাতটি।

স্কুল আর চার্চগুলোকে ঘিরে দাঁড়ানো বিস্তৃত লাইনগুলো যা আমাদের জাতি এর আগে কখনো দেখেনি, এই জবাব দিয়েছে, তিন-চার ঘণ্টা ধৈর্য ধরে দাঁড়ানো মানুষগুলোর এই রায়, এদের অনেকেই জীবনের প্রথমবারের মত এই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ তারা বিশ্বাস করেছিলেন এবারকার সময়টা হবে অন্যরকম যেখানে তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণতা পাবে।

এই জবাবটা উচ্চারিত হয়েছে তরুণ এবং বৃদ্ধ, ধণী এবং দরিদ্র,  ডেমোক্রেট আর রিপাবলিকান, কৃষ্ণাঙ্গ, শে^তাঙ্গ, ল্যাটিন, এশিয়, আদি আমেরিকান, সমকামী, বিষমকামী, প্রতিবন্ধী আর প্রতিবন্ধী নয় এমন সব আমেরিকানদের কাছ থেকে যারা সারা দুনিয়াকে এ কথা জানিয়ে দিয়েছে যে আমরা কখনোই শুধুমাত্র লোহিত আর নীলাভ কয়েকটি রাজ্যের সমষ্টি ছিলাম না: আমরা হচ্ছি, এবং সব সময়েই তা থাকবো, আমরা হাচ্ছি ইউনাইটেড স্টেট্‌স অব আমেরিকা।

এটা সেই উত্তর যা সেইসব লোককে তাড়িত করেছে যাদেরকে অনেককাল ধরে অনেকেরই কাছ থেকে আমাদের অমিত সম্ভাবনা বিষয়ে যা নৈরাশ্যকর, ভীতিকর এবং সন্দেহজনকসহ নানান নেতিবাচক অভিধা সহ্য করতে হয়েছে। অথচ আমাদের এই অর্জন দিয়েই ইতিহাসের চাকাকে আরো একবার ঘুরিয়ে দিতে পারা যায় অনাগত স্বর্ণালী দিনের প্রত্যাশায়।

আজকের এই রাতটা পর্যন্ত আসতে আমাদের অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। কারণ, আমরা দিনের বেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যা করেছি-- এই ফয়সালাকারী মুহৃর্তে, এর ফসল হল: আমেরিকায় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।

যাত্রাপথের সঙ্গীরা
এইমাত্র আমি সিনেটর ম্যাককেউনের কাছ থেকে একটি সহৃদয় বার্তা পেয়েছি। এই নির্বাচনী লড়াইয়ে তিনি দীর্ঘ এবং কঠিন এক প্রতিদ্বন্দ্বীতার নজির সৃষ্টি করেছেন, এবং তিনি এরচেয়েও দীর্ঘতর এবং কঠিনতম লড়াই এর আগে করেছেন তার প্রিয় স্বদেশভূমির জন্য। তিনি আমেরিকার জন্য যে সমস্ত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা আমাদের মধ্যে অনেকে কল্পনায়ও আনতে পারি না, আমরা এই সাহসী আর নিঃস্বার্থ বীরকে তাঁর অবদানের জন্য শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

আমি তাঁকে এবং গভর্নর পালিনকে তাদের যাবতীয় অর্জনের জন্য অভিনন্দিত করছি। আমি আশা করছি এই জাতির প্রত্যাশার নবায়নে আগামী দিনগুলোতে তাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাবো।

এই সুযোগে আমি আমার সফর সঙ্গীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তিনি এমন একজন মানুষ যিনি প্রচারণা চালিয়েছেন হৃদয়াবেগ মিশিয়ে, কথা বলেছেন সেইসব নারী-পুরুষের পক্ষে যাদের সঙ্গে তিনি বেড়ে উঠেছেন তার রাজ্যের সড়ক পথে, এবং তাদের সঙ্গে একই সঙ্গে ট্রেনে চড়ে ডিলাওয়ারের বাড়িতে ফিরেছেন, তিনি ইউনাইটেড স্টেট্‌সের সদ্য নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট, জো বাইডেন।

আজ যে এখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি তা হয় তো সম্ভবই হতো না বিগত ১৬টি বছর ধরে আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুর নেপথ্য সমর্থন ছাড়া। এই বন্ধুটি আমাদের পরিবারের মূল ভিত্তি এবং তিনি আমার জীবনের ভালোবাসা, তিনি আমাদের পরবর্তী ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা। শাশা এবং মালিয়া, আমি তোমাদের দুজনকেই অসম্ভব ভালোবাসি, আজ তোমরা নতুন এক পাপ্পিকে অর্জন করেছো যে হোয়াইট হাইসে আমাদের সঙ্গী হবে।
আর যদিও তিনি আর এখন আমাদের মাঝে নেই, তারপরেও আমি জানি আমার নানী আমাদেরকে আজ দেখছেন, এবং আমার পরিবার যারা আমাকে আজকের আমি হিসেবে নির্মাণ করেছেন। আজ রাতে আমি তাদের অভাব বেশ অনুভব করছি, আমি জানি তাদের কাছে আমার ঋণ কোনো কিছুতে পরিমাপের অতীত।

আমার ক্যাম্পেইন ম্যানেজার ডেভিড ট্রাউফি, আমার প্রধান কৌশলবিদ ডেভিড অ্যাক্সেলরড এবং বিশ্বের এযাবতকালের নির্বাচনী ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্রচারণা দল-- আপনাদের বলছি, আপনারা এটা করে দেখিয়েছেন, আর আমি আপনাদের কাছে চিরঋণী হয়ে রইলাম এই দুরূহ কর্ম সাধনে আপনারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার জন্য।

জনগণের বিজয়
তবে সবকিছুর উর্দ্ধে, আমি এটা কখনোই ভুলবো না সত্যিকারার্থে কারা এই বিজয়ের হকদার-- এই বিজয়ের মালিক আপনারা।
obama-03201
হোয়াইট হাউসের জন্য আমি খুব একটা জুতসই প্রার্থী ছিলাম না। আমি খুব একটা টাকা পয়সা বা সম্বল নিয়ে এই অভিযান শুরু করিনি। আমাদের নির্বাচনী প্রচারণা ওয়াশিংটনের কোনো শানদার মিলনায়তনে শুরু হয়নি-- এর সূচনা ডেস মইন্স-এর পেছনের বারান্দায় এবং কনকর্ডের লিভিংরূমে, আর চার্লসটনের সামনের আঙ্গিনায়।
এই বিজয়কে নির্মাণ করেছেন শ্রমজীবী মানুষেরা। তারা তাদের সীমিত সঞ্চয়ের মধ্য থেকেও কুঁড়েখুঁড়ে আমাদের বিজয় সোপান নির্মাণে পাঁচ, দশ কিংবা বিশ ডলার উৎসর্গ করেছেন।

এই অভিযান পুষ্ট হয়ে উঠেছে তরুণদের মধ্য থেকে যারা তাদের প্রজন্মকে বেষ্টন করে থাকা নিষ্পৃহতার আবরণকে ত্যাগ করে জেগে উঠেছে, এরা সেইসব তরুণ যারা কাজের জন্য ঘর-পরিবার ছেড়ে ছেড়েছে, সেই কাজে তাদের মজুরী স্বল্প আর ঘুমের সময় কম হওয়া সত্ত্বেও। আমাদের এ বিজয় নির্মিত হয়েছে সেইসব কিশোরের দ্বারাও যারা হুল ফোটানো শীত আর চামড়া ওঠানো গরমকে উপেক্ষা করে অচেনা জনের দ্বারে দ্বারে গিয়েও ভোট চেয়েছেন। আমাদের এই সাফল্য এসেছে অজুত-নিযুত সেইসব আমেরিকানের কাছ থেকে যারা স্বেচ্ছাসেবী হয়ে আমাদের প্রচারণাকে সংগঠিত করেছেন এবং এর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, দুই শতাধিক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য নিবেদিত একটি সরকারের বাস্তবতা এখনো অস্তমিত হয়ে যায়নি ধরাধাম থেকে।
আর তাই এই বিজয় আপনাদেরই।

সামনে অপেক্ষমান কর্তব্যের সারি
আমি জানি স্রেফ একটা নির্বাচনে জয়ী হতেই আপনারা এসব করেননি, আর আমি এটাও জানি যে শুধু আমাকে জেতানোর জন্যই আপনারা তা করেননি। আপনারা এটা ঘটিয়েছেন কারণ আপনারা বুঝতে পেরেছেন আমাদের সামনে কী বিশাল দায়িত্ব অপেক্ষা করছে। যদিও আজ রাতটা আমরা আনন্দে উদযাপন করছি, কিন্তু আমরা জানি আগামীকাল যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে সেগুলো আমাদের সারাজীবনকালের সবচেয়ে বড় দায়-- দু-দু’টি যুদ্ধ, ধ্বংসোম্মুখ এই পৃথিবী, শতাব্দীর জঘন্যতম অর্থনৈতিক সংকট।

যদিও আজ এমরা এখানে উৎসবের আনন্দে সমবেত হয়েছি, কিন্তু আমরা জানি এই মূহৃর্তে ইরাকের মরুভূমি আর আফগানিস্তানের পার্বত্যভূমিতে আমাদের সাহসী জওয়ানরা আমাদের জন্য জীবন হাতে নিয়ে বিনিদ্র রজনী পার করছেন।

এখানে অনেক অভিভাবকই আছেন যারা রাতের বেলা সন্তানরা ঘুমিয়ে পড়ার পরও নিজেরা জেগে থাকেন দুশ্চিন্তায়, একথা ভেবে যে কীভাবে তারা বন্ধকী সম্পত্তি ছাড়াবেন ব্যাংকের দেনার দায় থেকে, কিংবা চিকিৎসা ব্যয়ই মেটাবেন কী করে, অথবা সন্তানদের পড়ালেখার ব্যয় মেটাতে পর্যাপ্ত সঞ্চয়ই-বা কিভাবে করবেন! এজন্য আমাদের নয়া জ্বালানি ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে নয়া কর্মক্ষেত্রও; নতুন নতুন অনেক স্কুল গড়ে তুলতে হবে, মোকাবেলা করতে হবে ঝুঁকির আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শীতল হয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলো উষ্ণ করে তুলতে হবে।

জাতির পুনঃনির্মাণ
আমাদের সামনের রাস্তা অনেক দীর্ঘ। আমাদের ডিঙ্গোতে হবে অনেক চড়াই-উৎরাই। আমরা এক বছরে কিংবা এক মেয়াদে হয় তো লক্ষ্যে পৌঁছাতে নাও পারি, কিন্তু বিশ্বাস কর আমেরিকা-- সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে আজ রাতে আমি যতটা আশাবাদী এতটা এর আগে কখনোই ছিলাম না, আমরা সেখানে পৌঁছাবোই। আমি আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমরা সবাই সেই চূড়ায় উঠবোই।

আমাদের চলার পথে ব্যর্থতা আর ভুলের কাঁটা থাকবেই, অনেকেই থাকবেন যারা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নেওয়া আমার প্রতিটি সিদ্ধান্ত আর নীতিকেই সমর্থন করবেন না, আর আমরা জানি যে সরকার সবগুলো সমস্যারই সমাধানে সক্ষম নয়। তবে যে কোনো সমস্যা-সংকট মোকাবেলায় আমি আপনাদের কাছে সৎ থাকবো, সব সময়। আমি আপনাদের কথা মন দিয়ে শুনবো, বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে মতেদ্বৈততার সৃষ্টি হবে।

এবং সবকিছুর ঊর্দ্ধে আমি আপনাদের আহ্বান জানাই এই জাতির পুনঃনির্মাণ কাজে আমার সঙ্গে হাত মেলাতে সেইভাবে, শুধুমাত্র যে কায়দায় বিগত ২২১ বছরের পথচলায় আমেরিকায় তা হয়ে এসেছে-- কাঠামোর পর কাঠামো দিয়ে, ইটের পরে ইট দিয়ে, শক্ত হাতের সঙ্গে শক্ত হাতের বন্ধনে।

এক জাতি, একই মানস
একুস মাস আগের কঠিন শীতের মৌসুতে একদিন যার সূচনা হয়েছিল তার যবনিকা আজকে শরতের এই রাতেই শেষ হয়ে যাক, তা চাই না। আমরা যে পরিবর্তনের আরাধনায় আছি স্রেফ এই বিজয়টিই তার পরিমাপক নয়-- এটা মুধুমাত্র সেই পরিবর্তনটা ঘটানোর পথে একটি সুযোগ মাত্র। আর এই পরিবর্তনটা আদপেই সূচিত হবে না যদি আমরা আগে যেভাবে চলছিল সেই ধারায় ফিরে যাই। আর আপনাদের অংশগ্রহণ ব্যতিত পরিবর্তনটা আসবেও না।

তাই আসুন, আমরা দেশপ্রেমের এক নতুন মন্ত্রে বলীয়ান হই, সেবা আর কর্তব্যবোধের ভূমি যেখানে আমাদের সবাই একই মেলবন্ধনে গ্রন্থিত হয়ে কঠোর পরিশ্রমে রত হয়ে নিজেদের নিয়েই বিব্রত হয়ে রইবো না, প্রত্যেকেই অন্যের স্বার্থকে সংরক্ষণ করবে। বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা যদি আমাদের কিছু শিক্ষা দিয়ে থাকে তাহলে আসুন সেই কথাটা স্মরণ করি-- মেইন স্ট্রিটকে রুগ্ন রেখে আমরা কখনোই একটি তেজি ওয়াল স্ট্রিট পেতে পারি না। এই দেশটায়, আমাদের উত্থান-পতন যাই হয় তা হয় একটি জাতি হিসেবে, একটি একক সত্ত্বা হিসেবে।

চলুন আজ আমাদের মধ্যকার পুরনো দলবাজি, ক্ষুদ্রচিন্তা আর অপরিপক্কতার সেইসব প্রবৃত্তিকে দমন করি যা আমাদের রাজনীতিকে দীর্ঘতর কাল যাবৎ বিষিয়ে রেখেছে। আসুন আজ আমরা স্মরণ করি প্রথম যে ব্যক্তি হোয়াইট হাউসে রিপাবলিকান ঝাণ্ডা ওড়ান তাকে, তিনি এই রাজ্যেরই লোক ছিলেন- সেই পার্টির ঝাণ্ডা যার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আত্ম-নির্ভরশীলতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা আর জাতীয় ঐক্যর মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে।

সেইসব মূলমন্ত্র আমরা সবাই ধারণ করি, আর তাই যখন ডেমোক্রেটিক পার্টি এক বিশাল বিজয় অর্জন করেছে আজ রাতে, আমরা সেইসব বুকে ধারণ করে বিনয়াবণত চিত্তে এবং সপ্রতিজ্ঞ মনে শ্বাস্বত নেই মূলনীতির স্মরণ নিতে চাই আমাদের মধ্যকার সেইসব বিভেদ মুছে ফেলবার অভিপ্রায়ে যা আমাদের অগ্রগতিকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। লিংকন এর চেয়েও কয়েক গুণ বেশি বিভাজিত এক জাতিকে সেদিন বলেছিলেন, “আমরা পরষ্পর শত্রু নই, উপরন্তু বন্ধু... আমাদের মধ্যকার দুঃখাবেগ হয়তো একটা চরম সীমায় পৌঁছে গেছে কিন্তু তা যেন আমাদের মধ্যকার প্রীতির বন্ধনকে ছিন্ন না করে দেয়।”

আর সেইসব আমেরিকানদের বলছি, যাদের সমর্থন আমাকে সামনের দিনগুলোতে অর্জন করতে হবে-- আমি আনাদের ভোট হয় তো অর্জন করতে পারিনি সত্য, কিন্তু আমি আপনাদের কন্ঠস্বর ঠিকই শুনতে পাচ্ছি, আপনাদের সাহায্য আমার প্রয়োজ আছে, এবং আমি আপনাদেরও প্রেসিডেন্ট হবো।

বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
এবং আজ রাতে আমাদের উপকূল থেকে অনেক দূরে বসে যারা আমাদেরকে দেখছেন-শুনছেন, কোনো পার্লামেন্ট বা প্রাসাদ থেকে নিয়ে আমাদের ভুলে যাওয়া পৃথিবীর কোনো প্রান্তে যারা রেডিও ঘিরে বসে আছেন, তাদের বলছি, আমাদের প্রত্যেকের গল্পই যার যার মত, কিন্তু আমাদের গন্তব্য পরষ্পর অবিচ্ছিন্ন, এবং আমেরিকান নেতৃত্বের এক নবপ্রভাতের সূচনা করাই আমাদের এখনকার কাজ।

আর যারা এ দুনিয়াকে তছনছ ছিন্নভিন্ন করতে চাইছেন তাদের বলছি, আমরা পরাজিত করবো আপনাদের। আর যারা শান্তি আর নিরাপত্তা সন্ধানী-- তাদেরকে সমর্থন দেব আমরা।

আর যারা এই ভেবে এখনো উদ্বেগ বোধ করেন যে আমেরিকান বাতিঘরের আলোকবর্তিকা এখনো রোশনাই ছড়ায় কি-না, তাদেরকে বলছি, আজ রাতে আমরা আবারো একথাটার প্রমাণ দিয়েছি যে আমাদের প্রকৃত শক্তি নিহিত আছে আমাদের বিপুল সমরশক্তিতে বা সম্পদের বিশালত্বে নয়, এটার উৎস হচ্ছে আমাদের আদর্শগত সহনশীলতার শক্তিতে, টেকসই গণতন্ত্রে, অবারিত সুযোগে, আর অনুচ্চারিত প্রত্যাশায়।

এটাই হচ্ছে আমেরিকার সত্যিকারের চমৎকারিত্ব-- যে আমেরিকা বদলাতে পারে। আমাদের এই যুক্তরাষ্ট্র আরো পরিশীলিত হতে পারে। এবং এরই মধ্যে আমরা যা অর্জন করেছি তা আমাদেরকে আগামীদিন আমরা কি অর্জন করতে পারি কিংবা অবশ্যই অর্জন করবো তার আশা যোগায়।

সংগ্রামের এক ইতিহাস
এই নির্ভাচনে অনেক কিছুই প্রথমবারের মত সংঘটিত হয়েছে, এর অনেক কাহিনীই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কথিত হবে। তবে আমারে মনে এসব ঘটনার মধ্যে যেটা সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে তা হলো আটলাটন্টায় ভোট দিতে আসা এক নারীর, ভোটের মাধ্যমে নিজেদের আত্মার বাণী জানাতে আসা লক্ষ কোটি আমেরিকানদের সঙ্গে তাঁর খুব একটা অমিল নেই, শুধু একটি বিষয় ছাড়া- অ্যান নিক্সন কুপার নামের ওই নারীর বয়স ১০৬ বৎসর।

তিনি যখন জন্মান, তার মাত্র আগের প্রজন্মই দেখেছে কৃতদাস প্রথা, এমন একটা সময় যখন রাস্তায় গাড়ি আর আকাশে বিমানের প্রচলন হয়নি, সেই সময়টায় তার মত কেউ দু’টো কারণে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারতেন না-- এক তিনি নারী হওয়া আর দ্বিতীয়টি তার গায়ের রঙ।

এবং আজকের রাতটি, আমি ভাবছি তাঁর দেখা আমেরিকার বিগত এক শতাব্দীকালের কথা, আশাভঙ্গের মরম বেদনা আর নয়া আশায় বুক বাঁধার কথকতা, টিকে থাকার সংগ্রাম আর এগিয়ে যাওয়ার গল্প, যখনি বলা হত আমরা পারবো না তখনি আমোরকান মতবাদে বিশ্বাসী সেই জনতা প্রবলভাবে রুখে উঠে উচ্চকিত হত: হ্যাঁ, আমরা পারি।

একটা সময় যখন নারীদের কণ্ঠকে দাবিয়ে রাখা হতো আর তাদের আশা-আকাংখাকে মারা হতো গলা টিপে, অ্যান নিক্সন কুপার বেঁচেছিলেন সেই সব ভূলুণ্ঠিত আশা আর চেপে রাখা কণ্ঠের জেগে উঠে ব্যালটের মাধ্যমে সরব হওয়া দেখতে। হ্যাঁ, আমরা পারি!

যখন নৈরাশ্যের অন্ধকূপ গ্রাস করেছিল আমাদের, মন্দায় ছেয়ে গিয়েছিল দেশ, তিনি দেখেছেন এই জাতি নব উদ্যমে কীভাবে নয়া নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি আর এক নতুন সার্বজনীন স্বার্থকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরে কীভাবে এই ভয়কে জয় করেছে। হ্যাঁ, আমরা পারি!

যখন আমাদের বিমানঘাঁটিতে বোমা হামলা হয়েছিল আর দুনিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল স্বৈরাচার, তিনি দেখেছেন বিভাবে একটি প্রজন্ম মহৎ কর্ম সাধনে জেগে উঠেছিল, এবং আমাদের গণতন্ত্র রক্ষা পেয়েছিল। হ্যাঁ, আমরা পারি!

তিনি মন্টগোমারির বাস, বার্মিংহামের মোজা, সেলমার ব্রিজের নির্মাণ এবং আটলান্টার সেই ধর্মপ্রচারক যখন এক লোককে বলছিলেন, “আমরা বিপদ কাটিয়ে উঠবোই”, এসব দেখা এবং শোনার জন্য বেঁচেছিলেন। হ্যাঁ, আমরা পারি!

চাঁদের মাটিতে মানুষের পদচ্ছাপ পড়েছে, বার্লিনের প্রাচীর ধরাশায়ী হয়েছে, আমাদের নিজস্ব বিজ্ঞান আর কল্পনার সূতোয় গ্রন্থিত হয়েছে এক নয়া বিশ্ব। আর এ বছর, অ্যান নিক্সন কুপার এই নির্বাচনে তিনি একটি পর্দায় তার অঙ্গুলি স্পর্শের মাধ্যমে তার রায় জানিয়েছেন, কারণ ১০৬ বৎসর কাল পরে আমেরিকার শ্রেষ্ঠতম এবং হীনতম সময়গুলোর মধ্য দিয়ে পরিভ্রমণে তিনি জেনেছেন, আমেরিকা কীভাবে বদলে যেতে পারে। হ্যাঁ, আমরা পারি!

এটা আমাদের কাল
আমেরিকা, আমরা অনেক এগিয়েছি, আমরা অনেক কিছু দেখেছি। কিন্তু এখনো আমাদের অনেক কিছুই করার বাকি আছে। তাই আসুন আজ রাতে আমরা আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করি- পরবর্তী শতাব্দী দেখার জন্য আমাদের সন্তানদের বেঁচে থাকার কি দরকার আছে? আমার মেয়েরা যদি অ্যান নিক্সন কুপারের মত দীর্ঘজীবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে, কী পরিবর্তন তারা দেখবে? কী প্রগতি আমরা রচনা করবো তাদের জন্য?
এখন আমাদের সেই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সুযোগ এসেছে। এটা আমাদেরই সময়।

এখন সময় এসেছে আমাদের লোকজনকে কাজে ফিরিয়ে নেওয়ার এবং শিশুদের জন্য একের পর এক সুযোগ-সুবিধার দ্বার উম্মোচন করে দেওয়ার, সমৃদ্ধির ধারাকে বেগবান করার আর শান্তি পুনঃস্থাপনের; আবারো আমেরিকার স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলার এবং সেই মৌলিক সত্যকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা যে-- অনেকের মাঝে আমরাও একজন; যখন আমরা শ্বাস-প্রস্বাস নেই, কোনো আশায় বুক বাঁধি, এবং যেখানে আমরা বিশ্বজুড়ে নিন্দার মুখে পড়ি, কখনো হই সন্ধিগ্ধ, এবং যখন কেউ কেউ বলে ওঠে আমরা নাকি পারি না, সেই অমর-অজর কালোত্তীর্ণ মতবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে জেগে উঠবো একক সত্ত্বা হিসেবে যাতে ধ্বণিত হবে: হ্যাঁ, আমরা পারি!
ধন্যবাদ, ঈশ্বর আপনাদের আশীর্বাদ করুন, এবং ঈশ্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওপরেও রহমত বর্ষণ করুন।

ভাষান্তর: আহ্‌সান কবীর। বাংলানিউজ

No comments

Powered by Blogger.