নারীর ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকার- কথা রাখছে না সরকার by মানসুরা হোসাইন

নারীর ক্ষমতায়ন, সম-অধিকার আদায়ে কথা দিয়ে ঠিকমতো কথা রাখছে না সরকার। বৈষম্যমূলক আইনগুলো বাতিল বা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল নির্বাচনী ইশতেহারে। কিন্তু সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময়ে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।


বৈষম্যমূলক আইনের সংস্কার বা সিডও সনদ থেকে আপত্তি তোলার ক্ষেত্রেও দোদুল্যমানতায় ভুগছে। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
নারী ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, এ সরকারও নারীর অধিকার আদায়ে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি, বরং গুটি কয়েক মৌলবাদী গোষ্ঠীর হুমকি ও নির্বাচনকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেওয়া অঙ্গীকারও পালন করছে না।
অবশ্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন ভিন্ন কথা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘যতটুকু অগ্রসর হওয়া সম্ভব, তা সরকার করছে। তবে সরকারের এক মেয়াদে নারী আন্দোলনের সব প্রত্যাশা হয়তো পূরণ করা সম্ভব হবে না।’
মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি করেছে গত বছর। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য কর্মকৌশলই তৈরি করতে পারেনি। তাঁর মতে, সরকারের মেয়াদ আছে এক বছরের কিছু বেশি সময়। কিন্তু সরকার এখনো অনেক পদক্ষেপ নেয়নি বা যেগুলো নিয়েছে, তারও বাস্তবায়ন সেভাবে করেনি।
বৈষম্যমূলক আইন সংশোধনে রাখঢাক: নির্বাচনী ইশতেহার, নারী উন্নয়ননীতিতে সরকার বৈষম্যমূলক আইনের সংস্কার বা সংশোধনের ঘোষণা দিয়েছে। ২০১০ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ পালন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, নারীদের প্রতি যেসব বৈষম্যমূলক আইন চালু আছে, তা বাতিল করা হবে। প্রয়োজনে সংশোধন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ক্ষেত্র বিশেষে ব্যতিক্রম ছাড়া সম্পদে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা ঘোষণাই থেকে গেছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, নারী উন্নয়ননীতিতে পাদটীকায় সরকার বলে দিয়েছে, নীতিতে যা-ই থাকুক না কেন, কোরআন সুন্নাহর বিপরীতে কোনো আইন বা নীতি সরকার বাস্তবায়ন করবে না। আয়শা খানম বলেন, ‘এ নীতিতে সরকার এ ধরনের পাদটীকা যোগ করেছে, তা গত মে মাসের আগে জানতেও পারিনি।’
সিডওর ক্ষেত্রেও সরকার গতানুগতিক: সিডও সনদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারা থেকে আপত্তি তুলে নেওয়ার ব্যাপারে সরকার কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে সরকার এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
তবে প্রতিমন্ত্রী গত বছরের ২৫ জানুয়ারি জেনেভায় সিডও কমিটির কাছে আপত্তি তুলে নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতার কথা জানিয়ে এসেছিলেন।
সিডও সনদে আপত্তি বা সংরক্ষণ দিয়ে রাখা ২ নম্বর ধারায় বলা আছে, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের সংস্কার করবে। ১৬.১(গ) ধারায় বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। ১৯৮৪ সালে সরকার সিডও সনদের দুটি ধারায় আপত্তিসহ অনুসমর্থন দেয়।
সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সালমা খান প্রথম আলোকে বলেন, সিডও থেকে আপত্তি তোলার ক্ষেত্রে সরকার গুটি কয়েক মৌলবাদী গোষ্ঠী ও নির্বাচনে বিষয়টি প্রভাব ফেলবে কি না, তা নিয়ে ভয় পাচ্ছে।
আইন-নীতি আছে, বাস্তবায়ন নেই: নারী নীতির মতো সরকার ২০১০ সালে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন করলেও আইনটির বিধিমালা এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি।
তবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সচিব তারিক উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালা এবং পারিবারিক সহিংসতা আইনের বিধিমালা তৈরির কাজ প্রক্রিয়াধীন। কর্মপরিকল্পনা বা বিধি তৈরি না হলেও বিভিন্ন কাজ হচ্ছে।
পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে ‘আমরাই পারি’ ক্যাম্পেইনের কো-চেয়ারপারসন এম বি আখতার প্রথম আলোকে বলেন, পারিবারিক আইনের বিধিমালা তৈরি হয়নি বলে মাঠপর্যায়ে এ আইনটি তেমনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আইনটি প্রচারেরও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
সরাসরি নির্বাচনে নেই পদক্ষেপ: জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে সরকার কোনো উদ্যোগই নেয়নি।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৯ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হন এবং ৪৫ জন সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পান। পরে সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বাড়িয়ে ৫০ করেছে।
তবে সাংসদ তারানা হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে বেশি খুশি হতাম।’
ইশতেহারে সরকার সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলেছে। ইশতেহারে ২০২১ সাল নাগাদ ‘কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই’ অংশে বলা হয়েছে, সংসদে প্রত্যক্ষ ভোটে নারীর জন্য ১০০ আসন সংরক্ষিত করা হবে।
হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন, বড় হোঁচট: বিবাহ নিবন্ধনের বিধানটি ঐচ্ছিক রেখে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন পাস করেছে সরকার। হিন্দু নারীরা বিয়ের প্রমাণ হিসেবে কাগজ দেখাতে পারেন না বলেই নির্যাতনের শিকার হন। তাই এ বিধানটি ঐচ্ছিক রাখায় নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা বেশ খানিকটা হোঁচট খেয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম প্রথম আলোকে বলেন, ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সিগনেচার ক্যাম্পেইনে ৯০ হাজার নারীর সই সংগ্রহ করে সরকারের কাছে জমা দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ হিন্দু আইনের দাবি জানিয়ে আইনটির খসড়াও তৈরি করে দেয় বেসরকারি সংগঠন।
নেই আরও কিছু: যৌন নির্যাতন বন্ধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেই। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীরা বেশি অক্ষরজ্ঞানহীন হলেও সরকার তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ছাত্রীদের জন্য ডিগ্রি পড়া অবৈতনিক করার ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়লেও ভৌত অবকাঠামো বাড়ানো এবং অভিবাসী নারীশ্রমিকদের জন্যও উল্লেখযোগ্য কিছু করেনি সরকার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের সদিচ্ছা ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয় নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিলেও তার বাস্তবায়নও দুর্বল।

No comments

Powered by Blogger.