প্রিয় এবং অপ্রিয় বর্ণনা by মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম

১৯৭৫ সাল ঘটনাবহুল ছিল। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘটনা নিম্নরূপ। প্রথম : ২৫ জানুয়ারিতে বাকশাল কায়েম। দ্বিতীয় : ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত এবং বঙ্গবন্ধুরই দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও বিদ্যমান মন্ত্রিসভার অন্যতম জ্যেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন।


তৃতীয় : ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর তৎকালীন সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর-উত্তমের নেতৃত্বে, খন্দকার মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে একটি সেনা অভ্যুত্থান সংঘটন, যুগপৎ তৎকালীন সেনাবাহিনীপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমকেও বন্দি করে ফেলা। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর প্রথম মুহূর্ত থেকেই সাধারণ সৈনিকদের নেতৃত্বে একটি সেনাবিপ্লব সংঘটিত হওয়া। দিনেরবেলা ঢাকা মহানগরীর জনগণ কর্তৃক সৈনিকদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা ও সরেজমিনে বিপ্লবে অংশগ্রহণ।
৭ নভেম্বরের প্রসঙ্গে যেকোনো আলোচনা করতে গেলে সেখানে দুটি আঙ্গিক উদ্ভাসিত হতে বাধ্য। একটি হচ্ছে চাক্ষুষ ঘটনার বর্ণনা, আরেকটি হচ্ছে তার প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য। যেহেতু একটি পত্রিকার কলাম সীমিত আকারের হতে বাধ্য, সেহেতু অনুরূপ আজকের এই নিবন্ধে বিস্তারিতভাবে কোনো আঙ্গিকই তুলে ধরা যাবে না; তাই উভয় আঙ্গিকেরই অতি সীমিত আলোচনা করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু-সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী রাজনৈতিক দল ছিল ১৯৭২-এর অক্টোবরে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। তারা রাজপথে সরকারের বিরোধিতা করা শুরু করে। তাদের আন্দোলন গতি পেয়েছিল, জনজীবনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পেরেছিল; কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। তখন জাসদও চিন্তা করেছিল যে শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মতো এত বড় প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে অবস্থানচ্যুত করা সম্ভব হবে না; অতএব সেনাবাহিনীর কোনো অংশকে যদি বন্ধু হিসেবে পাওয়া যায় তাহলে ভালো। এ মোতাবেক তারা, অর্থাৎ জাসদ সেনাবাহিনীর মধ্যে বন্ধু খোঁজার কাজে লিপ্ত হয়। ইতিমধ্যে কিছুসংখ্যক পাকিস্তান ফেরত এবং কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক তৎকালীন সরকারের কর্মকাণ্ডের চরম বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশে একটি গোপন সৈনিক সংস্থা গঠন করেছিলেন। ওই গোপন সংস্থাও রাজনৈতিক মিত্রের সন্ধানে ছিল। বিবিধ প্রক্রিয়ায় এবং ঘটনার মাধ্যমে জাসদের সঙ্গে গোপন সৈনিক সংস্থার পরিচয়, বন্ধুত্ব ও সংহতি সৃষ্টি হয়। সেই সময় জাসদের অন্যতম নেতা ছিলেন আ স ম আবদুর রব, মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের বীর-উত্তম, হাসানুল হক ইনু প্রমুখ। ১৯৭৪-৭৫ সালে এই রাজনৈতিক শক্তি (জাসদ) এবং সৈনিক শক্তির (গোপন সৈনিক সংস্থা) সমন্বয়ে প্রস্তুতি চলে রাজনৈতিক-সৈনিক বিপ্লবের উদ্দেশ্যে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা এবং ১৯৭৫-এর নভেম্বরের ৩ তারিখের ঘটনা তাদের হিসাবের মধ্যে ছিল না। অতএব, এই যুগ্ম শক্তি দ্রুতগতিতে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা যদি নিষ্ক্রিয় বসে থাকে তাহলে আবারও কোনো কিছু এমন ঘটে যেতে পারে, যেটা তাদের অভীষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনকে বিঘি্নত করবে। অতএব, তারা সিদ্ধান্ত নেয় বিপ্লব সাধনের। তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দিন ও ক্ষণ ছিল ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টা তথা ৭ নভেম্বরের প্রথম মুহূর্ত।
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক হোঁচট খায়। কারণ খন্দকার মোশতাক আহমেদ ভারতপন্থী ছিলেন না। সুতরাং ভারতের অনুকূলে সম্পর্ককে পুনঃ স্থাপন করা জরুরি ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেকেই এবং তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানটিকে ভারতপন্থী অভ্যুত্থান হিসেবে মূল্যায়িত করে। যেহেতু তৎকালীন সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ওই অভ্যুত্থানের সঙ্গে মতপার্থক্যে ছিলেন, তাই ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীরা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি করেছিলেন। এই বন্দি করার ঘটনাটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অতি বৃহদাংশের সাধারণ সৈনিকদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল এবং এ কারণে তাঁরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ সৈনিকরা বিক্ষুব্ধচিত্তে অপেক্ষা করছিলেন কী নিয়মে আসলে ভারতপন্থী হোক বা না হোক কিন্তু তাৎক্ষণিক মূল্যায়নে ভারতপন্থী মনে হওয়া খালেদ মোশাররফ বীর-উত্তমের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহকে নস্যাৎ করা যায় এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু জাসদপন্থী গোপন সৈনিক সংস্থার সদস্যদের মতো সাধারণ সৈনিকরা আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠিত ছিলেন না। এ কারণে ৭ নভেম্বর প্রথম মুহূর্ত থেকেই সব সৈনিককে সাধারণভাবে একটি পাল্লায় বা একই মাপকাঠি দ্বারা মূল্যায়ন করা অসম্ভব ও অবাস্তব।
জাসদ ও গোপন সৈনিক সংস্থার সিদ্ধান্ত ছিল ৭ নভেম্বরের প্রথম মুহূর্তে বিপ্লব শুরু করবে সাধারণভাবে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অবস্থিত কোনো না কোনো স্থাপনার ওপর আক্রমণ করত। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত ছিল, যেখানে যেখানে সম্ভব সেখানে সেখানে অফিসারদের হত্যা করা। কারণ অফিসাররা ব্যতিক্রমী কোনো বিপ্লবের পক্ষে নন। জাসদ এবং গোপন সৈনিক সংস্থার এই সিদ্ধান্তগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য সেনানিবাসের অভ্যন্তরে বসবাসরত সৈনিক ও অন্যদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা প্রয়োজন ছিল। সেই জন্য ৬ তারিখ সারা দিন বিভিন্ন মাধ্যমে ও ছত্রছায়ায় সেনানিবাসের অভ্যন্তরে লিফলেট বিতরণ করা হয়। কিছু কিছু লিফলেটের শিরোনাম ছিল এ রকম : সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই। এরূপ লিফলেট ও প্রচারণা সম্বন্ধে আমি ৬ তারিখ সন্ধ্যাবেলায় মাত্র অবগত হই। কারণ ৫ নভেম্বর দিন ও দিনগত রাত এবং ৬ নভেম্বর বিকেল ৪টা পর্যন্ত আমি ঢাকা মহানগরীর বাইরে ছুটিতে ছিলাম। ৬ নভেম্বর বাদ-মাগরিব সমাগত রাত্রিকালের সম্ভাব্য বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা পাই। একলা কোনো কিছু করার ছিল না। শুভাকাঙ্ক্ষী অন্যান্য অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাই। অতএব আমি নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে সংকট মুহূর্তে আমি আমারই পেরেন্ট-ব্যাটালিয়ন অর্থাৎ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে অবস্থান নেওয়া উচিত। কারণ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের একটি স্বাভাবিক প্রত্যয় থাকত এই মর্মে যে সৈনিকরা ও অফিসাররা একাত্ম। অতএব কোনো বিশৃঙ্খলা হবে না। রাত ১২টায় আমি আমার আবাসস্থল ত্যাগ করে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উদ্দেশে রওনা দিই। রাত ১২টা থেকে ঢাকা সেনানিবাসের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছিল গুলির আওয়াজে এবং আকাশে প্রজ্বলিত হয় এমন গুলির আলো যেগুলোকে সামরিক পরিভাষায় বলা হয় ট্রেইসার-বুলেট। এরূপ গোলযোগের মধ্য দিয়ে ব্যাটালিয়নে উপস্থিত হই। তৎকালীন মেজর কামরুল ও ক্যাপ্টেন এনামকে ব্যাটালিয়নে পাই। ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান, মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার নুরুল আনোয়ার প্রমুখ অন্যদের নিয়ে আমার পরামর্শ মোতাবেক চলতে তাৎক্ষণিকভাবে সম্মত হয়। ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে পাকিস্তান আমলের তোফায়েল কলোনি নামে পরিচিত, বাংলাদেশ আমলে শহীদ আজিজ পল্লী নামে পরিচিত, এলাকায় দ্বিতীয় বেঙ্গলের অধিনায়ক সপরিবারে বসবাস করতেন। পুরো আজিজ পল্লী এলাকা বিদ্রোহীদের আক্রমণের শিকার হয়। অধিনায়ক বের হতে পারেননি। আমি একান্ত অনানুষ্ঠানিকভাবেই পাঁচ ঘণ্টা সময় দ্বিতীয় বেঙ্গলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করি। সারা রাত ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে কাটাই। সকাল ৫টায় আমার হুকুমে এবং অনুমতিতে, সবার সম্মিলিত পরিকল্পনায়, দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকরা নিজেদের গাড়ি-ঘোড়াতে করেই সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিপ্লবে যোগ দেয়। ইতিমধ্যে মধ্যরাতের কিছু পরেই সৈনিকদের উদ্যোগে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা হয় এবং তিনি আবার সেনাবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু সূর্যোদয়ের প্রাক্কাল পর্যন্ত আসলে পরিষ্কার ছিল না যে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীদের শক্তি কতটুকু অবশিষ্ট আছে বা তাদের পরবর্তী লক্ষ্য কী? বাস্তবে যা ঘটেছিল তা হলো সূর্যোদয়ের অব্যবহিত আগেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং অন্য সঙ্গী নেতারা গোপনে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। তাঁরা আশ্রয় পেয়েছিলেন; কিন্তু নিরাপত্তা পাননি। আনুমানিক সকাল ৯টায় তাঁদের লাশ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পেঁৗছায়। ৩ নভেম্বরের কাহিনী এখানেই শেষ। ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ অব্যাহত থাকে।
জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার পর পরই দৃশ্যপট বদলে যায়। জাসদপন্থী সৈনিকরা চাচ্ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাক। অন্যপক্ষে সাধারণ সৈনিকরা চাচ্ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাক। জেনারেল জিয়াউর রহমান অন্য শুভাকাঙ্ক্ষী জ্যেষ্ঠ অফিসারদের পরামর্শে এবং সৈনিকদের আগ্রহে, দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির (সংক্ষেপে সেকেন্ড ফিল্ড নামে পরিচিত) অবস্থানে গিয়ে নিজের জন্য একটি অতি সাময়িক কমান্ড হেড কোয়ার্টার সৃষ্টি করেন। ৬ নভেম্বর দিবাগত রাতের শেষাংশ তথা ৭ নভেম্বর সূর্যোদয়ের এক-দুই ঘণ্টা আগের ঘটনা অনেক ধরনের রহস্যের আড়ালে এখনো আবৃত। যেটা সুনিশ্চিত সেটা হলো জিয়াউর রহমানের প্রতি অনুগামী সৈনিকরা গোপন সৈনিক সংস্থার সৈনিকদের পরাভূত করেন এবং সেনানিবাসে ও ঢাকা মহানগরীতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
৭ নভেম্বরের বিপ্লবের তাৎপর্য হলো এই যে সাধারণ সৈনিক ও জনগণের একাত্মতার কারণে একটি বামপন্থী রক্তাক্ত বিপ্লবী নাটকের মঞ্চায়ন থেকে বাংলাদেশ রক্ষা পায়। ৩ নভেম্বরের সেনা বিপ্লবে ভারতপন্থী প্রবণতা দেখা যাওয়ায় সেই প্রবণতাও রুদ্ধ করা হয়। দেশ বাঁচে। চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী হিসেবে আবির্ভূত হন জনগণের ও সৈনিকদের সম্মিলিত নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। ৭ নভেম্বর এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান অবিচ্ছেদ্য। এক প্রকার বলতে গেলে ৭ নভেম্বর স্বাধীনতা রক্ষার পুনঃ নিশ্চিতকরণ দিবস এবং এর মহানায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে অনেক কথা বলা যায়নি স্থান অভাবে, স্বচ্ছতার অভাবে নয়। প্রাসঙ্গিক অনেক পুস্তকের মধ্যে আগ্রহী পাঠক যেমন ইচ্ছা তেমন বেছে পড়তে পারেন। একটি পুস্তকের নাম 'মিশ্র কথন', প্রকাশক 'অনন্যা' (ফেব্রুয়ারি ২০১১)।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.kallyan-ibrahim.com

No comments

Powered by Blogger.