৭ নভেম্বর-যিনি দেশকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছেন by মোহাম্মদ আলী

৭ নভেম্বর ১৯৭৫। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ব্রিটিশ ভারত থেকে শুরু করে বাংলা অঞ্চলে এটাই প্রথম সশস্ত্রভাবে বামপন্থিরা ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা। ভারতবর্ষে এ ধরনের সশস্ত্রপন্থায় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা


কেবল চারু মজুমদারের নেতৃত্বে নকশালবাড়ী আন্দোলনের মাধ্যমে হয়েছিল। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্ব এবং শ্রীলংকায় বিজয় রুহানাও শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে এ ধরনের ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। কিন্তু অন্য সব ঘটনাকে ৭ নভেম্বর ছাপিয়ে গেছে। সিপাহি-জনগণ সেই বিপল্গবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে যে সিপাহি বিপল্গব সংঘটিত হয়, লেনিনীয়পন্থায় এটাই ছিল শেষ সশস্ত্র বিপল্গবী প্রচেষ্টা। সেটা সফল বা ব্যর্থ হয়েছে, এখানে সে প্রশ্ন অবান্তর।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। তাৎপর্যের দিক দিয়ে সেটি ছিল নিছক একটি সামরিক ক্যু। এ নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে, খালেদ মোশাররফ ভারতপন্থি ছিলেন। তিনি ভারতপন্থি হন আর মুজিবপন্থি হন কিংবা পন্থি নিরপেক্ষই হন, তার অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য আর কর্নেল আবু তাহেরের অভ্যুত্থান করার উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। খালেদ মোশাররফ ছিলেন উচ্চাভিলাষী সেনা অফিসার এবং একজন নিছক ক্যুদেতা। কর্নেল তাহের একজন নিছক উচ্চাভিলাষী সামরিক ক্যুদেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক ও যথার্থই বিপল্গবী।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন। আটকাপড়া কর্নেল তাহের অনেক চেষ্টার পর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি প্রচলিত সামরিক কায়দায় যুদ্ধে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই তাড়াহুড়ো করে মুক্তিযুদ্ধ শেষ করা, ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতা গ্রহণ করা_ এসব প্রশ্নে কর্নেল তাহের প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধবাদী ছিলেন। তিনি দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর কামালপুর যুদ্ধে তার একটি পা হারান। তাকে হেলিকপ্টারে করে ভারতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে পুনা আর্টিফিশিয়াল লিম্ব সেন্টার থেকে কৃত্তিম পা লাগিয়ে তিনি দেশে ফিরে প্রথম অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর দুর্নীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি পদত্যাগ করেন। তিনি মনে করতেন, স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনী যেন জনগণের বোঝা না হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তার কাজের মূল্যায়ন না করে তাকে গুরুত্বহীন পদে বদলি করেন।
৭ নভেম্বরের সফল অভ্যুত্থানে তিনি নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের কারণে দ্রুতই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়। ওই সময়ের ঘটনা প্রসঙ্গে কর্নেল তাহের আদালতের কাঠগড়ায় জবাবন্দিতে বলেন, 'চৌঠা নভেম্বর বিকেলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমার কাছে খবর পাঠান। ... আমি যেন... তাকে মুক্ত করি ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করি।' জিয়াকে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ যেন মরা সাপের জীবন পাওয়ার মতো। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি কর্নেল তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তারপর থেকেই তিনি অন্য এক জিয়াউর রহমানরূপে আবির্ভূত হন। এক অশুভ রাজনৈতিক খেলায় মেতে ওঠেন। জলিল-রবসহ অধিকাংশ জাসদ নেতাকে জিয়ার নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়। ২৪ নভেম্বর জিয়ার কাছে নিয়ে যাওয়ার নাম করে পুলিশ কর্নেল তাহেরকে জিপে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকেই তাহের কারাগারে বন্দি ছিলেন ফাঁসির আগ পর্যন্ত। তাই তো ট্রাইব্যুনালকে কর্নেল তাহের এক পর্যায়ে বলেন, 'জিয়া শুধু আমার সাথেই নয়, বিপল্গবী সেনাদের সাথে, সাতই নভেম্বরের পবিত্র অঙ্গীকারের সাথে, এক কথায় গোটা জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।' কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সরকার উৎখাতের জন্য অভিযোগ আনা হয়েছিল। এমনও বলা হয়েছিল, তিনি নাকি ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে সরকার উৎখাতে চেষ্টা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাহের আদালতে বলেন, '... কিন্তু মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করেছিল কারা? ... এখানে অভিযুক্তদের কেউ কি এসব ঘটিয়েছিল? নাকি এখানে উপবিষ্ট আপনারা এবং তারা_ যাদের আজ্ঞা আপনি পালন করে যাচ্ছেন, তারাই কি মুজিবের হত্যার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভবান হননি?' তিনি এ ব্যাপরে আরও নির্দিষ্ট করে ট্রাইব্যুনালকে বলেন, 'এখন হয়তো ট্রাইব্যুনাল বুঝতে পারবেন কেন আমি সায়েম, জিয়া, এমএইচ খান, তাওয়াব আর ওসমানীকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করতে বলেছিলাম। তারা এখানে এসে বলুন, আমি যা বলেছি তার কোথাও এক বর্ণ মিথ্যা আছে কি-না।'
কিন্তু তাহেরের বিচার কার্যক্রমের ট্রাইব্যুনাল ছিল সাজানো দাবার ঘুঁটির মতো। যা ছিল জিয়াউর রহমানের সাজানো নাটক। সেই সত্য ও তার পরিণতি বুঝতে পেরেও সাহসী বীর তাহের ট্রাইব্যুনালের সামনে বলেছিলেন, 'সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই জাতি মরতে পারে না। বাংলাদেশ বীরের জাতি।...নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো বড় সম্পদ নেই।' তাই যেন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তাহের তারই আরেক সঙ্গী মেজর জিয়াউদ্দিনের একটি কবিতা তাহেরের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত করেন :
জন্মেছি সারা দেশটাকে একটা ঝাঁকুনি দিতে
দিয়েই গেলাম।
জন্মেছি সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে
কাঁপিয়ে দিলাম।
তাহেরকে প্রহসনমূলক বিচারের নামে জেনারেল জিয়াউর রহমান হত্যা করেছেন। সম্প্রতি কর্নেল তাহের হত্যা মামলার রায়ে আদালত তাহেরকে বীর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানকে কাপুরুষ বলে ভৎর্সনা করেছেন। তাহেরের সহযোগীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। দেরি হলেও আশার কথা সত্যের জয় হয়েছে। এখন আমরা আশা করি, তাহের হত্যার রায়ের নথি প্রকাশ ও রায় বাস্তবায়ন সময়ের দাবি।

মোহাম্মদ আলী : কর্নেল তাহের সংসদের
সাধারণ সম্পাদক
nanditaali@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.