সাক্ষাৎকার-সরকার অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ by হাসানুল হক ইনু

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শেখ রোকন সমকাল : আপনি এমন সময় তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন যখন সরকারের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। হাসানুল হক ইনু :সাংবাদিকদের সঙ্গে সরকারের কোনো দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে আমি মনে করি না।


গত পৌনে চার বছরের মেয়াদে সরকার এমন কোনো আইন বা বিধান প্রণয়ন করেনি, যাতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়। সেদিক থেকে দূরত্বের কোনো কারণ দেখি না।
সমকাল : সম্প্রতি আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রীর কয়েকটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। টক শো নিয়েও সরকারের পক্ষ থেকে নেতিবাচক বক্তব্য শোনা গেছে।
হাসানুল হক ইনু :ইলেকট্রনিক মিডিয়ার টক শোতে কিংবা সংবাদপত্রে সরকারের যে সমালোচনা হয়, সে নিয়ে তো সরকার কোনো ভূমিকা রাখেনি। সমালোচনা তো চলছেই। আমার কাছে মনে হয়, সরকারের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের দূরত্বের কথাটা নিছকই গুজব। এটা হয়তো উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ছড়ানো হচ্ছে। আমি নিজেও অবাক হয়েছি_ এমন খবরও প্রকাশ হয়েছে যে, টক শো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এগুলো কাল্পনিক খবর। সরকারের কোনো ফোরামে বা মন্ত্রিসভায় এ নিয়ে আলোচনাও হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর বা তথ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশ বা প্রজ্ঞাপন কেউ দেখাতে পারবে না। সরকার অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সমকাল :আপনি বলছেন, সরকার ও সংবাদমাধ্যমের মধ্যে দূরত্ব নেই। বিদ্যমান সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করা প্রয়োজন কি-না?
হাসানুল হক ইনু :বর্তমান সরকারের আমলে দেশ সামরিক স্বৈরতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত করে সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর দিকে উত্তরণের পর্যায়ে রয়েছে। এই পর্যায়ে সংবাদমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। গণতন্ত্রের প্রতি সরকারের অঙ্গীকার অনুধাবন করতে হবে। আপনাদের মনে থাকার কথা, ২০০৬ শ্রম আইন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার সরকার সাংবাদিকদের বিশেষ মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ আইন করেছিল। খালেদা জিয়া সরকার সেই আইনটি বাদ দিয়ে সাংবাদিকদের জন্য অপমানজনক একটি আইন করেছে। বঙ্গবন্ধুর সেই আইনে ফিরে যেতে পারলে সাংবাদিকরা আরও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। আমি সে লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। কমিটি গঠন করে দিয়েছি।
সমকাল :হত্যা-নিপীড়ন নিয়ে সাংবাদিক সমাজে অসন্তোষ রয়েছে। এখন পর্যন্ত একজন সাংবাদিক হত্যারও বিচার সম্ভব হয়নি। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনাতেও খুব বেশি অগ্রসর হওয়া যায়নি। আমরা জানি, এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। আপনার মন্ত্রণালয় কি এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না?
হাসানুল হক ইনু :সামরিক স্বৈরতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদের কারণে সাধারণ নাগরিক যেমন, তেমনই সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও ঝুঁকির মুখে থেকেছেন। তারা ঝুঁকি মাথায় নিয়েই দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের অনেকে নিপীড়িত, এমনকি নিহতও হয়েছেন। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সাংবাদিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে গত ১৫-২০ বছরে এ ধরনের সব ঘটনার তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছি। হত্যা মামলাগুলো নিয়ে বিশেষ নজর দিতে বলেছি। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ইচ্ছা পোষণ করেছি। সাগর-রুনির মামলার ব্যাপারে আমি উদ্যোগ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের বৈঠকের ব্যবস্থাও করেছি।
সমকাল : সংবাদমাধ্যম-সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়নের ব্যাপারে সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে অনলাইন সংবাদমাধ্যম-সম্পর্কিত নীতিমালা।
হাসানুল হক ইনু : আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নীতিমালার খসড়া প্রকাশ করা হয়নি। অনানুষ্ঠানিক বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর একটি কমিটি করে দিয়েছি। তারা নতুন করে খসড়া নীতিমালা তৈরি করছে। সেই খসড়া তৈরির ব্যাপারে মন্ত্রণালয় বা সরকারের দিক থেকে কোনো নির্দেশনা, সিদ্ধান্ত বা শর্ত দেওয়া হয়নি। অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি, অনলাইন বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বিষয়টি পড়ান_ তাদের নিয়েই কমিটি হয়েছে। খসড়াটি পাওয়ার পর আমরা সব নাগরিকের মতামত নেব, তারপর কমিটিই সেই নীতিমালা চূড়ান্ত করবে।
সমকাল :কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেন, নতুন আইন বা নীতিমালা মানেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা অবাধ তথ্যপ্রবাহ ক্ষুণ্ন হওয়া।
হাসানুল হক ইনু :অবাধ গণতন্ত্র বলে যেমন কোনো শব্দ নেই, তেমনই অবাধ গণমাধ্যমও হতে পারে না। গণতন্ত্রের মতো গণমাধ্যমকেও একটা সীমার মধ্যে থাকতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজে যে কারণে কারাগার থাকে। গণতন্ত্র মানেই সবকিছু হালাল নয়। গণতান্ত্রিক সমাজেও সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধাপরাধ, গুপ্তচরবৃত্তি চালানো যায় না। আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন, ইতিহাস-ঐতিহ্য অমান্য করা যায় না। সংবাদমাধ্যমকেও কিছু নিয়মনীতি মেনে, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ থেকেই স্বাধীনতা ভোগ করতে হবে। দেশের সংবিধান, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনতা চর্চা করতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি সংবাদমাধ্যমকে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। তথ্য পণ্য নয়, সামাজিক সম্পদ। দেশ যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, স্বৈরতন্ত্রের বীজ, যুদ্ধাপরাধের কলঙ্ক, জঙ্গিবাদের কালো ছায়া থেকে মুক্ত হতে চাইছে, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের দিকে উত্তরণের পথে রয়েছে, তখন সংবাদমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
সমকাল :এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের প্রতি সরকারেরও দায়িত্বশীল হওয়ার বিষয় আছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয় আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বেতার ও টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টিও দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে।
হাসানুল হক ইনু :জাতীয় সম্প্রচার নীতি হয়ে গেলে বিষয়টি সহজ হবে। সম্প্রচার নীতি থাকলে শুধু বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার নয়; বাসস, পিআইবি, পিআইডি, এফডিসি_ সবার ভূমিকা ও দায়িত্ব নির্ধারিত হবে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতা জরুরি।
সমকাল :সম্প্রচার নীতিমালা যেহেতু এতটা জরুরি; আপনি এটা প্রণয়নের কোনো ডেডলাইন কি দিতে পারেন?
হাসানুল হক ইনু :এক-দেড় মাসের মধ্যে খসড়া প্রস্তুতের জন্য কমিটিকে অনুরোধ করেছি আমরা। বাকি প্রক্রিয়ায় আরও কিছু দিন প্রয়োজন হবে। আমি আশা করছি, সব মিলিয়ে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে জাতীয় সম্প্রচার নীতি, অনলাইন সংবাদমাধ্যম নীতি পাওয়া যাবে।
সমকাল :আমরা সব সরকারের সময়ই দেখেছি রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন, বেতার ও সংবাদ সংস্থায় বিরোধী দলের খবর প্রচারিত হয় না। নীতিমালা প্রণয়ন, তারপর এগুলোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সদিচ্ছার প্রমাণ হিসেবে কি রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমগুলো বিরোধী দলের সংবাদ প্রচারে উদ্যোগী হতে পারে না? আপনি নিজেও দীর্ঘদিন বিরোধী দলে ছিলেন এবং এ ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
হাসানুল হক ইনু :বিরোধী দলের বা নাগরিকের সমালোচনা বেতার বা টেলিভিশনে না দেখানোর ব্যাপারে সরকারের কোনো প্রজ্ঞাপন নেই। বিটিভিতে তো আমি দেখি, নাগরিক সমালোচনা সম্প্রচার করা হচ্ছে। কীভাবে সমস্যাটির সমাধান করা যায়, এ ব্যাপারে আমি খতিয়ে দেখব। তবে মনে রাখতে হবে, অনেক বছরের 'আবর্জনা' রাতারাতি পরিষ্কার করা যাবে না। এসব আবর্জনা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দলবাজি, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। এগুলো আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। আমি আন্তরিক চেষ্টা করব, এগুলো দূর করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে। এটা মহাজোট সরকারেরও অগ্রাধিকার।
কয়েক দশক ধরে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ লালন করা হয়েছে, তা দূর করার ব্যাপারে সব সংবাদমাধ্যমেরই দায়িত্ব রয়েছে। এই সেদিন রামুতে কীভাবে সাম্প্রদায়িক হামলা হলো! গত কয়েক দশকে সমাজে অনেক আগাছা জমেছে, সেখানে কেউটে সাপ বাসা বেঁধেছে। এগুলোকে নির্মূল করতে বেসরকারি সংবাদমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল হতে হবে।
সমকাল :প্রেস কাউন্সিলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে আরও কার্যকর করার ব্যাপারে আপনার কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি-না?
হাসানুল হক ইনু : প্রেস কাউন্সিলের কার্যকর ভূমিকা নিয়ে নাগরিকদের পক্ষ থেকে একটা গোলটেবিলের চিন্তা করছি। সাধারণ নাগরিক যাতে প্রেস কাউন্সিলের সুবিধা সম্পর্কে জানতে পারে। প্রেস কাউন্সিলের বিধিবিধানও যুগোপযোগী করা দরকার।
সমকাল :বর্তমান সরকার ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের নাম বদলিয়ে সার্টিফিকেশন বোর্ড রেখেছে। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এটি এখনও আমলাতন্ত্রনির্ভর। প্রতিবেশী ভারতের মতো চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কাউকে এই সার্টিফিকেশন বোর্ডের নেতৃত্ব দেওয়া যায় কি-না?
হাসানুল হক ইনু : বর্তমান সরকার গোটা চলচ্চিত্রশিল্পের ডিজিটালাইজেশনে উদ্যোগী হয়েছে। চলচ্চিত্র শিল্পের সামগ্রিক সংস্কারে মনোযোগ দিয়েছে। এ জন্য ফিল্ম সেন্সর বোর্ডকে আমরা 'সার্টিফিকেশন বোর্ড' নামকরণের উদ্যোগ নিয়েছি। এর জনবল কাঠামো, নীতিমালা খতিয়ে দেখছি। এখানে শ্রদ্ধাভাজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের সনি্নবেশ করার উদ্যোগও নিয়েছি।
সমকাল :ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অনুমোদন দিয়েছে বর্তমান সরকার। খোদ সিনেমা হলগুলো যে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে_ এ ব্যাপারে কী করণীয়?
হাসানুল হক ইনু : চলচ্চিত্র নির্মাণ, প্রদর্শন কীভাবে ডিজিটালাইজেশন হতে পারে, মানোন্নয়ন হতে পারে_ সে ব্যাপারে আমরা উদ্যোগী হয়েছি। এর সুফল পাওয়া যাবে।
সমকাল : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
হাসানুল হক ইনু : সমকালের জন্য শুভেচ্ছা।
 

No comments

Powered by Blogger.