আপিল বিভাগের রায়ে নির্বাচনী সরকারের রুপরেখাঃ স্বাধীন ইসি- সংসদ ভেঙে ছোটো মন্ত্রিসভা, কিংবা এমপিদের তত্ত্বাবধায়ক by মোহাম্মদ আরজু

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে রোববার রাতে সই করেছেন বিভাগের ছয় বিচারক। এর আগে রায় চূড়ান্ত করার জন্য কয়েক দফায় আলোচনায় বসেন বিচারকরা। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এ আলোচনা চলে।
পরে রাতে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রায়ে দেখা যায়; ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের দেয়া রায়ের সঙ্গে একমত হয়েছেন অপর তিন বিচারক, ফলে চার বনাম তিন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে চূড়ান্ত হলো বহুল আলোচিত এ রায়টি।
রায়ের ৪৩তম অংশে ‌'জনগণের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক চরিত্র, এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা'কে ‌'সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার ও রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি' সাব্যস্ত করে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ঘোষণা করেন যে (৪৪ এর ১০ অনুচ্ছেদ), ‘‘সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারকে খর্ব করিয়াছে বিধায় উক্ত তর্কিত আইন অসাংবিধানিক ও অবৈধ, সুতরাং বাতিল হইবে।’’

পাশাপাশি রায়ে নির্বাচনকালীন সরকার নয়, বরং সুষ্ঠু নির্বাচনই মূল লক্ষ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে সেই লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) স্বাধীন করে একে জাতীয় নির্বাচনকালে বিশেষ বাড়তি ক্ষমতা দিতে হবে।

একইসঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের বিবেচনার জন্য দুটি বিকল্প হাজির করা হয়েছে রায়ে। দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন করা যেতে পারে বলে বলা হয়েছে।

বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সাংবিধানিক ও বৈধ সাব্যস্ত করে তত্ত্বাবধায়ক বহাল রাখার পক্ষে রায় দিয়েছেন ‍দুই বিচারক, আর ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সাংবিধানিক ও বৈধ বললেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা বা না রাখার বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়ার রায় দিয়েছেন এক বিচারক।

গত বছরে মৌখিকভাবে সংক্ষিপ্ত রায় দেয়া বেঞ্চের নেতৃত্বে থাকা তখনকার প্রধান বিচারপতি খায়রুল সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ রায় লিখে তাতে সইয়ের পরে রোববার রাতে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট ছয় বিচারক বর্তমান প্রধান বিচারপতির কামরায় বৈঠক করে রায়ে সই করেন। গত বছর মৌখিক রায় দেয়ার সময় যারা বেঞ্চে ছিলেন- বর্তমান প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, রায় ঘোষণা কালের প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, আপিল বিভাগের অন্য বিচারকরা- এসকে সিনহা, মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, নাজমুন আরা সুলতানা, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও মো. ইমান আলী রায়টিতে নিজেদের অংশ যোগ করে পূর্ণাঙ্গ এ রায়ে স্বাক্ষর করেন।

মোট ৭৪৭ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারপতি খায়রুলের বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে ৩৪২ পৃষ্ঠার অংশে নিজেদের সম্মতির কথা জানিয়েছে ছোটো অংশ যোগ করেছেন তিন বিচারক। তারা হলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি, এস কে সিনহা, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

অন্যদিকে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে রায় দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন বিচারক মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা ও নাজমুন আরা সুলতানা। মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞার ১৭৬ পৃষ্ঠা লেখা মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন নাজমুন আরা সুলতানা। তারা বলেন, বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানসম্মত, গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু নির্বাচনে দরকারি।

বিচারক মো. ইমান আলী’ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজনে আনা ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সাংবিধানিক ও বৈধ বলেছেন। তবে আগামী নির্বাচনগুলোতে কেমন সরকার ব্যবস্থা থাকবে সে বিষয়ে তিনি জনগণের মতামত, কাজেই জাতীয় সংসদের ওপর বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি একশ ৫০ পৃষ্ঠা রায় লিখেছেন।

গত বছর ১০ মে সেই সময়কার প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। সেদিন সংক্ষিপ্ত মৌখিক রায় ঘোষণা করা হয়।

ওই সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রের বৃহৎ স্বার্থ ও জনগণের নিরাপত্তার প্রয়োজনে আগামী দুটি (দশম ও একাদশ) জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারকদের বাদ দিয়ে নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠনের জন্য সংসদ প্রয়োজনে এ পদ্ধতি সংশোধন করতে পারে।

এ রায় মানার কথা বলে ইতিমধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করেছে বর্তমান সরকার। তবে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক রাখার কথা বলা হয়েছে পূর্ণাঙ্গ রায়েও।

নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি
আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতে পারে বললেও রায়ে নির্বাচনকালীন সরকারের চেয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ওপর। রায়ে বলা হয়, ‘‘প্রথমত, প্রকৃতপক্ষে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, যাহা প্রয়োজন তাহা হইল কারচুপিহীন একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। সেই জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী, স্বায়ত্ত্বশাসিত ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নহে। কারণ, দ্বিতীয়ত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রত্যেকটি নির্বাচনের পূর্বে ও পরবর্তীতে নানা ধরণের চরম সঙ্কট দেখা দিয়াছে যাহা বহুল প্রচারিত ও বহুল প্রশংসিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ও কৃতিত্বের সাক্ষ্য বহন করে না।''

আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে মামলাটির শুনানি চলাকালে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে এতে নিজেদের মত-অমত দেন দেশের বেশ কয়েকজন শীর্ষ আইনজ্ঞ।

সে বিষয়ে উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‌‌''নির্বাচনে কারচুপি সম্বন্ধে বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরি গণের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বলিতে চাই যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইহার সমাধান নহে। কারচুপিমুক্ত সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজন সত্যকার স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিগণের একান্ত ও নির্ভেজাল প্রচেষ্টা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবে স্বাধীন করিতে হইবে। ইহাকে সম্পূর্ন প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান করিতে হইবে। লোকবল নিয়োগে কোন প্রকার বাঁধা সৃষ্টি করা যাইবে না। নির্বাচন অনুষ্ঠান করিতে সর্বপ্রকার প্রয়োজন নিরসনকল্পে সরকার তাৎক্ষনিকভাবে পদক্ষেপ লইবেন। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সকল প্রকার সহায়তা সরকারের নির্বাহী বিভাগ তড়িৎ প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবেন, অন্যথায় তাহারা  সংবিধান ভঙ্গ করিবার দায়ে দায়ী হইবেন। এই ব্যাপারে কোন তরফে কোন গাফিলতি দেখা দিলে নির্বাচন কমিশন প্রকাশ্যে অভিযোগ উত্থাপন করিবেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তড়িৎ গ্রহণ করিবেন, অন্যথায় তাহারাও সংবিধান ভঙ্গের দায়ে দায়ী হইবেন।''

এছাড়া নির্বাচনকালে কমিশনকে বিশেষ বাড়তি ক্ষমতা দিতে রায়ের ৪৪ (১৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‌‌''সাধারণ নির্বাচনের তপসীল ঘোষণার তারিখ হইতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ পর্যন্ত নির্বাচনের সহিত প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত এবং নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা অনুসারে যাহারা এমনকি পরোক্ষ ভাবে জড়িত, রাষ্ট্রের সেই সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে।''

সংসদ ভেঙে দিয়ে সংক্ষিপ্ত মন্ত্রিসভা
সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে এমন সব ব্যবস্থার পরও আদালত একটি দৃষ্টান্ত ব্যবহার করে বলেছেন, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও নির্বাচনে অনিয়ম হয়। আদালত বলছেন যে এক্ষেত্রে ‌'প্রয়োজনীয় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে লওয়া যাইতে পারে', কিন্তু তার জন্য ‌'গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে কোন অজুহাতেই, এমনকি স্বল্পতম সময়ের জন্যও পরিহার করা যাইবে না।'

গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকভাবে চালু রাখতে আদালত এ অবস্থায় সংসদ ভেঙে দিয়ে ও মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত করে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের পথ বাতলেছেন। রায়ের ৪৪ (১২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ''সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত কাল পূর্বে, যথা, ৪২ (বেয়াল্লিশ) দিন পূর্বে, সংসদ ভাঙ্গিয়া দেওয়া বাঞ্ছনীয় হইবে, তবে, নির্বাচন পরবর্তী নূতন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করতঃ উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করিবেন।''

বিচারক নয়, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
একইসঙ্গে পরের অংশেই (৪৪ এর ১৩ অনুচ্ছেদ) বলা হয়েছে, ‘‘সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, অসাংবিধানিক ও অবৈধ হইলেও জাতীয় সংসদ ইহার বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত অনুসারে উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে প্রয়োজনমত নূতনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।’’

পাশাপাশি রায়ে বলা হয়েছে, এ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকরা থাকুন- এমনটি আশা করেননা আদালত। রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণকে বাদ দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়ন করিতে পারে, কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে তাহাদিগকে সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়।’’

বরং রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধুমাত্র জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যগণ দ্বারা গঠিত হইতে পারে, কারন, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার এই রায়ে উক্ত বিষয়গুলির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে।’’

তবে লক্ষনীয় হচ্ছে, সংসদ ভেঙে দিয়ে সংক্ষিপ্ত মন্ত্রিসভা বা এমপিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার; দুটি বিকল্পই জাতীয় সংসদের 'বিবেচনা'র ওপর ছেড়ে দিয়েছে আপিল বিভাগ। তবে 'একটি শক্তিশালী, স্বায়ত্ত্বশাসিত ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন' গড়তে ও নির্বাচনকালে কমিশনকে বিশেষ ক্ষমতা দেয়ার বিষয়ে রায়ের অংশে 'জাতীয় সংসদের বিবেচনার অনুসারে' উল্লেখ করা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.