গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সিজারলিস্ট সাক্ষীর সাক্ষ্য- যুদ্ধাপরাধী বিচার

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চতুর্থ সিজারলিস্ট সাক্ষী বাংলা একাডেমীর সহকারী লাইব্রেরীয়ান এজাব উদ্দিন মিয়া জবানবন্দী প্রদান করেছেন। তিনি ট্রাইব্যুনালে তৎকালীন সময়ের দৈনিক সংগ্রাম ও আজাদ পত্রিকায় এর বিষয়ে বর্ণনা করেন।


অন্যদিকে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১২তম সাক্ষী জবানবন্দী প্রদান করেছেন। একই ট্রাইব্যুনাল হাজী মোবারক হোসেনের জামিন আরও ২ মাস বৃদ্ধি করেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে আটক জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে ৫ম সাক্ষী মোঃ খসরুল আলম এদিন জবানবন্দী দিয়েছেন। চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই নির্দেশ গুলো প্রদান করেছে।
১৯৭১ সালের একটি হত্যা মামলায় আটক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাজী মোবারক হোসেনের জামিন আবেদন গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনাল দুই মাস জামিন বৃদ্ধি করে এ আদেশ দেয়। এর আগে ১৬ জুলাই মোবারককে দুই মাসের জামিন দেয় ট্রাইব্যুনাল। রবিবার সকালে মোবারকের পক্ষে তাঁর আইনজীবী এসএম শাজাহান জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনাল তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ১৫ নবেম্বর তদন্তে অগ্রগতির পরবর্তীর প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশ দেয়। ওই দিন মোবারক হোসেনকে হাজির হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের একটি হত্যা মামলায় আটক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেনের জামিন আবেদনের শুনানি হয় গত ১১ জুলাই। ওইদিন আসামিপক্ষ ও প্রসিকিউশন বিষয়টির ওপর শুনানি শেষে ১৬ জুলাই তাঁকে জামিন দেয় ট্রাইব্যুনাল।
ওই দিন শুনানিতে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর সারাদেশ থেকে ৬৪০ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে, যা তদন্ত সংস্থার রেকর্ডে রয়েছে। তিনি বলেন, এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের রস্তম শিকদার, খুলনা বিভাগের আমজাদ মিয়া, রাজশাহীর লাহার আলী ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে সংঘটিত একটি হত্যা মামলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ওই মামলায় আটক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেন বর্তমানে জামিনে মুক্ত রয়েছেন।
তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন গ্রামবাসী আব্দুল খালেকের লাশ পার্শ্ববর্তী খাল থেকে উদ্ধার করে। আরজিতে উল্লেখ করা হয়, যারা ডেকে নেয় তাদের মধ্যে আখাউড়া উপজেলার নয়াদিল গ্রামের মোবারক ও জমশেদ মিয়া ছিল।
নিহত আব্দুল খালেকের কন্যা খোদেজা বেগম ২০০৯ সালের ৩ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। মোবারক হোসেন ১৩ মে ওই মামলায় হাইকোর্ট থেকে ৬ মাসের আগাম জামিন নেন। এরপর কয়েক দফা জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে আরেক দফা জামিনের মেয়াদ বাড়ানো আবেদন করলে হাইকোর্ট তাকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেয়।
পরে ২০১১ সালের ৯ অক্টোবর মোবারক হোসেন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠায় এবং মামলার নথিপত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয়। পরে গত ৬ জুন আসামিপক্ষের আইনজীবী ট্রাইব্যুনালে আপীল মোকাদ্দমা দায়ের করলে ট্রাইব্যুনাল এ মামলার নথিপত্র তলব করে।
গোলাম আযম
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চতুর্থ সাক্ষী বাংলা একাডেমীর সহকারী লাইব্রেরিয়ান এজাব উদ্দিন মিয়া। তিনি তালিকার প্রথম সাক্ষী। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হয়ে দুপুর ১টা পর্যন্ত তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণ চলে। তাঁর সাক্ষ্য প্রদানকালে গোলাম আযম আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।
জবানবন্দীতে তিনি বলেন, আমি ১৯৮৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে বাংলা একাডেমীতে কর্মরত আছি। আমি লাইব্রেরির পত্রিকা শাখায় কাজ করি। পত্রিকা পড়া এবং লোখার জন্য। আমি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে চিনি। তিনি ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সহকর্মীদের সঙ্গে বাংলা একাডেমীর লাইব্রেরীতে পত্রিকা শাখায় আসেন। ১৯৭১, ১৯৭২ সালের পত্রিকা লাইব্রেরীর মূল পত্রিকা কপিগুলোর পত্রিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে দেয়া হয়। প্রধান গ্রন্থাগারিক মোঃ মোবারক হোসেন (ভারপ্রাপ্ত) ও নিজে দস্তখত করি। মূল কপিগুলো আমাদের লাইব্রেরীতে জিম্বানামায় মূলে জিম্মায় রেখে আসি।
উল্লেখ্য, সমস্ত পত্রিকা জব্দ করা হয়, সেগুলোর মধ্যে হেডিং ছিল, ২২/৬/৭১ দৈনিক সংগ্রাম, ‘সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে রক্ষা করার বিকল্প ব্যাবস্থা ছিল না।’ গোলাম আযম। ১৯/৭/৭১ ‘হিন্দু মুসলমানের বন্ধু এমন কোন প্রমাণ নেই।’ গোলাম আযম। ১৫/১১/৭১ ‘অভিনন্দনের জবাব- জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠাই আমাদের লক্ষ্য। গোলাম আযম। এগুলো ছাড়া বেশকিছু কাগজের কাটিং উপস্থাপন করা হয।
সাকা চৌধুরী
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেফকতারকৃত বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের ১২তম সাক্ষী অরুনাংশ বিমল চৌধুরী রবিবার জবানবন্দী দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যুনাল-১-এ সাক্ষীর জবানবন্দীর সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।
তিনি জবানবন্দীতে বলেন, বর্তমানে তাঁর বয়স ৮০/৮২ বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল ৪০/৪১ বছর। তিনি চট্টগ্রামে রাউজান থানার জগতমোল্লপাড়ার সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৭১ সালে রাঙ্গুনিয়ার রানিরহাটে অরুনাংশের একটি ওষুধের দোকান ছিল এবং তিনি ডাক্তারি করতেন।
জবাবন্দীতে তিনি বলেন, ‘যেদিন ঘটনা ঘটে সেদিন রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরের চেয়ারম্যান কায়কোবাদ চৌধুরী আমার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে বলেন, ‘ডাক্তারবাবু আপনি বাড়ি চলে যান। তার কথা শুনে আমি বাড়ি গিয়ে পরিবারসহ শ্বশুরবাড়ি বিনাজুড়িতে চলে যাই। সেখানে পৌঁছবার ঘণ্টা দু’য়েক পরে জানতে পাই জগতমোল্লপাড়ার সব লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তখন আমি ভাবলাম, একটু গিয়ে দেখে আসি। বাড়ি যাওয়ার পথে বৌদি জোৎস্নাবালা চৌধুরীর সঙ্গে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখা হয়। বউদির বাবার বাড়িও ছিল বিনাজুড়িতে। তখন বিনাজুড়িতেও লুটপাট শুরু হয়ে যায়।’
জবানবন্দীতে প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমনের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ঘটনা কারা ঘটিয়েছে তা আমি জানি না। কারণ আমি বাড়িতে ছিলাম না। বিনাজুড়িতে যখন লুটপাট হয় তখন আমরা খেতের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। সেদিন রাতে আমি স্ত্রীপুত্রসহ ভারতে চলে যাই। আমি যখন বর্ডারে যাই সেখানে আমরা গুরুসাধন ধর, আব্দুল্লাহ আল হারুন ও অন্যদের সঙ্গে দেখা হয়। দেশ স্বাধীনের পরে দেশে ফিরে দেখলাম, গ্রামের সব শেষ হয়ে গেছে। কিছুই নাই, শুধু মাটির ঘরগুলো দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম; কোথায় থাকব, কি করব, কি খাব এসব ভেবে অস্থির ছিলাম। এ কারণে অন্য গ্রামে কী হয়েছে তা আমি দেখিনি।’
অরুনাংশ আরও বলেন, ‘জগতমোল্লপাড়ায় ওই গণহত্যায় আমার বড় ভাই ডাক্তার হিমাংশু বিমল চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী নীলু প্রভা চৌধুরী, মেজভাই প্রেমাংশু বিমন চৌধুরী তাঁর স্ত্রী জ্যোৎসা বালা চৌধুরী, আরেক ভাই শীতাংশু বিমল চৌধুরী, কাকা সুরেন্দ্র বিমল চৌধুরী তার স্ত্রী চারুবালা চৌধুরী- এদের আমাদের বাড়িতেই হত্যা করা হয়। পরে শুনেছি, এর এক মাস পরে আরও তিনজনকে হত্যা করা হয়েছিল।’
উল্লেখ্য, এ হত্যাকাণ্ডে যত মানুষ নিহত হয়েছিলেন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে সেখানে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে এবং সেখানে তাদের নাম লেখা রয়েছে। অরুনাংশের জবানবন্দী শেষ হওয়ার পরে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রধান আইনজীবী আহসানুল হক হেনা সাক্ষীকে জেরা করবেন না বলে ট্রাইব্যুনালকে জানান।

No comments

Powered by Blogger.