তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করে- পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল রবিবার সুপ্রিম কোর্টে দিনভর বৈঠকের পর রাত পৌনে ১০টায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ রায় প্রদানকারী সাতজন বিচারপতি গতকাল দুপুরেই নিজ নিজ রায়ে স্বাক্ষর করে তা সুপ্রিম


কোর্টে জমা দেন। সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, গতকাল অধিক রাত পর্যন্ত বিচারপতিদের দেওয়া রায় সমন্বয় করা হয়। পরে রাতে আবারও তাঁরা বৈঠকে বসেন।
গত বছর ১০ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জ করে করা এক মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার এক বছর চার মাস পাঁচ দিন পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হলো। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে পূর্ণাঙ্গ রায়েও বলা হয়েছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বলে রায় দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
অবশ্য রায় ঘোষণার পর পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা না করেই সরকার গত বছর সংবিধান সংশোধন করে জাতীয় সংসদে বিল পাস করে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়। এ নিয়ে সমালোচনা আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা চলছে। এরই মধ্যে গত রাতে এ-সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হলো।
গত রাতে সুপ্রিম কোর্টে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, 'দুইজন বিচারপতি ভিন্নমত পোষণ করলেও আমরা একটি সুন্দর রায় দিয়েছি।'
১৯৯০ সালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। তখন এ ব্যবস্থা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সংবিধানের ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ ও ৫৮ঙ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, যা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী নামে পরিচিত। এরপর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের সপ্তম, অষ্টম ও নবম- এ তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজন করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী করায় এর বৈধতা নিয়ে ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী এম সলিমউল্লাহ, রুহুল কুদ্দুস বাবু ও মো. আবদুল মান্নান খান হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এর মধ্যে এম সলিমুল্লাহ মারা গেছেন। রুহুল কুদ্দুস বাবু এখন হাইকোর্টের বিচারপতি। এ কারণে মো. আবদুল মান্নান খানকেই রিট আবেদনকারী হিসেবে ধরা হয়।
রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বা পদ্ধতি গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনার পরিপন্থী। এটা সংবিধানেরও পরিপন্থী। কারণ গণতন্ত্র ও সংবিধানের চেতনা হচ্ছে, সব সময় নির্বাচিত সংসদ বহাল থাকবে। নির্বাচিত সরকারই দেশ পরিচালনা করবে। রিট আবেদনে আরো বলা হয়, প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথককরণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ওই রিট আবেদনের ওপর দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ঘোষণা করে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপিলের অনুমতি দেন আদালত। ফলে আপনাআপনিই আপিল হিসেবে মামলাটি আপিল বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ আপিলের ওপর গত বছর ১ মার্চ থেকে শুনানি হয়, শেষ হয় ৬ এপ্রিল। পরে ১০ মে রায় দেওয়া হয় এবং আপিল মঞ্জুর করা হয়। আপিল বিভাগে শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ড. এম জহির, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসির মতামত নেওয়া হয়। এই আট অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে পাঁচজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে, একজন বিপক্ষে এবং দুজন সংস্কার করতে নতুন ফর্মুলা দেন। কিন্তু রায়ে অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত অগ্রাধিকার পায়নি।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাসংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের নিজের অংশে গত ১৩ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষর করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি ৩৪২ পৃষ্ঠায় বাংলায় রায় লিখেছেন। তৎকালীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতির মধ্যে ছিলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী।
জানা গেছে, গতকাল দুপুরে এই সাতজন বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টে বৈঠক করেন। বৈঠকে রায়ে স্বাক্ষর করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে সন্ধ্যার আগেই তাঁরা প্রত্যেকে নিজ নিজ রায়ে স্বাক্ষর করেন। এর আগে রায় প্রকাশ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখাকে প্রস্তুত রাখা হয়। প্রত্যেকের রায় সমন্বিত করার পর সন্ধ্যায় আবার সাত বিচারপতি বৈঠকে বসেন। বৈঠকটি বেশ রাত পর্যন্ত চলে। ওই সময় আবার পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন তাঁরা।
আরো জানা গেছে, সাতজন বিচারপতির সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করা হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একমত পোষণ করেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। অন্য বিচারপতি ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো মত না দিয়ে বিষয়টি সম্পূর্ণ জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
আরো জানা গেছে, বিচারপতি খায়রুল হক বাংলায় রায় লিখলেও যাঁরা তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারেননি, তাঁরা ইংরেজিতে রায় লিখেছেন। বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ১৭৬ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন। অন্যদিকে বিচারপতি মো. ইমান আলী ১৫০ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন। পরে সব রায় একত্র করে বাংলা ও ইংরেজিতে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম এক মামলার রায় বাংলায় ও ইংরেজিতে প্রকাশ করা হলো।
সূত্র জানায়, পূর্ণাঙ্গ রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ও তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রায়ে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যদের দ্বারা গঠিত হতে হবে।
রায়ে আরো বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে করা ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে তা বাতিল করা হলো। তবে সময়ের প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত আগের নির্বাচনগুলোকে আইনগত বৈধতা দেওয়া গেল। রাষ্ট্রের ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এটা করা হলো।
তবে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্তমানে যে অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, সেই ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে অভিমত দেওয়া হয়েছে। অভিমতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার বিধানটি বাতিলের সুপারিশ করে বলা হয়, যদি পরবর্তী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে হয়, তাহলে এ সময়ের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বাদ দিয়ে অন্য কাউকে প্রধান উপদেষ্টা করতে জাতীয় সংসদ সংবিধান সংশোধন করতে পারে।
তবে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা, শান্তিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে আগামী দুটি (দশম ও একাদশ) জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন আদালত। রায়ে বলা হয়েছে, এ সময়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদ থেকে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ দিয়ে জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংস্কার করে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। সংসদের সেই স্বাধীনতা রয়েছে।
এই রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা তাঁর রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দিলেও তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি তাঁর লেখা রায়ে উল্লেখ করেন, বিগত দিনগুলোতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়। এ জন্য দেশে রাজনৈতিক সংকট দূর হয়। কিন্তু বিগত নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করায় দেশে আবার রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। তিনি সংবিধানে বর্ণিত পাঁচটি বিকল্প পথে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান না খুঁজে নিজেই সরকারের প্রধান হন, যা ছিল বিতর্কিত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সংবিধান লঙ্ঘন করলেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হতে পারে না।
অন্য বিচারপতি মো. ইমান আলী তাঁর রায়ে বলেছেন, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জাতীয় সংসদই তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, যেহেতু দেশে সংসদ বিদ্যমান রয়েছে, সেহেতু তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো মতামত দেননি।

No comments

Powered by Blogger.