গোলটেবিল বৈঠক- ব্যাংক কীভাবে চলছে, কীভাবে চলবে

৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘ব্যাংক কীভাবে চলছে, কীভাবে চলবে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।


যাঁরা অংশ নিলেন
ড. আকবর আলি খান
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
ড. এম এ তসলিম
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রায়হানা আনিসা য়ূসুফ আলী
সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, সোনালী ব্যাংক
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
দেশের ইতিহাসে সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা নজিরবিহীন। শুধু সোনালী ব্যাংকেই নয়, রাষ্ট্র মালিকাধীন সব ব্যাংকে কমবেশি এ ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে। সরকারি ব্যাংকব্যবস্থায় নানা ধরনের অনিয়মের কথা শোনা যায়। যেমন, পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক নিয়োগ, ঠিকমতো হিসাব নিরীক্ষা না হওয়া, অযোগ্য দলীয় লোক নিয়োগ দেওয়া, ব্যাংকের ওপর রাজনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা ইত্যাদি। এ বাস্তবতায় আজকের এই আলোচনা। এখন সালেহউদ্দিন আহমেদকে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য অনুরোধ করছি।

সালেহউদ্দিন আহমেদ
সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা সব খানেই শোনা যায়। এই দুর্নীতি বা অনিয়মের একটা সীমা বা স্তর পর্যন্ত আমরা চিন্তা করতে পারি। কিন্তু হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি আমাদের চিন্তাভাবনার ওপর দিয়ে গেছে। বাক্রুদ্ধ হয়ে গেছি। এটি কী করে সম্ভব? আরও অবাক হয়েছি অর্থমন্ত্রীর কথায়। তিনি বললেন, চার হাজার কোটি টাকা কোনো বিষয় না। কেন গণমাধ্যম এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে! আমরা জানি না, কত হাজার কোটি টাকা চুরি হলে অর্থমন্ত্রী সেটাকে বিবেচনায় নেবেন।
ঋণ অনুমোদনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এ ক্ষেত্রে মানা হয়নি। এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা টাকা চুরির একটা পরিকল্পনা করেছে। টাকা আত্মসাতের পদ্ধতি নির্বাচন করতে গিয়ে ‘ঋণ’ শব্দটাকে ব্যবহার করেছে। সংশ্লিষ্ট অনেকের যোগসাজশে টাকা আত্মসাতের ঘটনাটি ঘটেছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো নয় যে বছরে দু-একবার বসবে। পরিচালনা পর্ষদকে সপ্তাহে অন্তত এক দিন বসতে হয়। বছরে কমপক্ষে ৪৮ বার। প্রয়োজন হলে আরও বেশি সভা করতে হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঋণ নিতে হলে তাদের আনেকবার ব্যাংকে আসতে হয়। ব্যবসাসংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের আলাপ-আলোচনা করতে হয়। ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের দায়-সম্পত্তি, ব্যবসা, ব্যবসার আয়-ব্যয়, ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা, ঋণের বিপরীতে জামানত ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। অতএব, কেউ জানবে না, সেটি ভাবার কোনো করণ নেই। আর যদি না-ই জানেন, তা হলে ব্যাংকে তাদের কাজটা কী, শুধু কি চা খাওয়া, আড্ডা দেওয়া? মোটকথা, যদি তারা না-ও জানে, তা হলে অযোগ্যতার দায় থেকেও মুক্তি পাবে না।
দেরিতে হলেও গণমাধ্যমের জন্য মানুষ ঘটনাটি জানতে পেরেছে। গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়ার পরপরই যদি ব্যবস্থা নিত, তা হলে অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ কম হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য পাওয়ার কথা। অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বুঝতে পেরেছিল, তাদের চুরির ঘটনা অনেকেই জেনে যাচ্ছে। তাই সাত-আট মাসের মধ্যে বিশাল অঙ্কের টাকা বের করে নিয়েছে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থ কেলেঙ্কারি। এর বিপরীতে সরকারের যে প্রতিক্রিয়া দেখছি, তাতে কিছু হবে বলে মনে হয় না। এখানে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব বেশি। কিন্তু মনে হয়, তিনি সময় নষ্ট করে বিষয়টি আড়াল করতে চান। এখন যদি অতি দ্রুত কঠিন শাস্তি দেওয়া না যায়, এটি জাতির জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করে ছেড়ে দিচ্ছে। এটা কত দিন ধরে চলবে, জানি না। দুদক কী করবে, সরকার কী করবে, আমরা জানি না। যা-ই করা হোক না কেন, দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থমন্ত্রীর আরেকটি কথায় দুর্নীতিবাজদের এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা পকেটে ঢোকানোর ব্যবস্থা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘দুই হাজার কোটি টাকা পাচ্ছি।’ এতে দুর্নীতিবাজেরা ধরে নিচ্ছে, দুই হাজার কোটি টাকা দিলেই সরকার খুশি। মূল কথা হচ্ছে, কী পাচ্ছি কী পাচ্ছি না, সেটা আগে থেকে বলার দরকার নেই। আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে সম্পূর্ণ টাকা আদায় করা। অর্থমন্ত্রীর এসব কথা খুব খারাপ ইঙ্গিত বহন করে। এদিকে সময়ক্ষেপণের কারণে হলমার্ক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। রাস্তা অবরোধসহ নানা ষড়যন্ত্র করছে।
এই পরিচালনা পর্ষদ এখনো কীভাবে আছে, সেটা বোধগম্য নয়। আবার অনেকে বুক ফুলিয়ে বলছে, ‘চলে গেলে তো দোষী হব। এখানে থেকে নির্দোষ প্রমাণ করব।’ এখানে থাকলে তারা তদন্ত বাধাগ্রস্ত করবে। এটা কোনো স্বাভাবিক ঋণ নয়, এটা সোজাসুজি টাকা চুরি—আত্মসাৎ বা দুর্নীতি। এখানে ফৌজদারি মামলায় (ক্রিমিনাল) আটক করে টাকা আদায় করতে হবে ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
ব্যাংকের এবং এর বাইরে যারা জড়িত, তাদের ফৌজদারি আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। সাধারণ মানুষের জমানো টাকা আদায় করতে হবে।
হিটলার তিন লাখ মানুষ হত্যা করেছিলেন। তাঁর বিচারের সময় বিচারক বলেছিলন, তিন লাখ কেন, বিচারের জন্য একজন মানুষ হত্যাই যথেষ্ট। তাই চার হাজার কোটি টাকা বিশাল পরিমাণ টাকা। বিচারের জন্য ৪০০ টাকা চুরিও যথেষ্ট।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
ব্যাংক বলতে শুধু রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক নয়। ব্যাংক খাতের একটি বড় অংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক খাতে হয়তো সমস্যা আছে। তবে সরকারি ব্যাংকের মতো সংকট এত গভীর নয়। রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক, বিশেষ করে সোনালী ব্যাংকে সমস্যা বললে ভুল হবে, এটা বড় রকমের সংকট। এতগুলো টাকা চলে গেল, ব্যাংকের একটি পরিপূর্ণ হিসাব নিরীক্ষা দল, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের একটি পরিদর্শক দল, পরিদর্শন, নিরীক্ষা—কোনো কিছুই কার্যকর হলো না। বাহ্যিক দিক থেকে পরিচালনা পর্ষদ প্রতিটি ঋণ অনুমোদন করবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করবেন। বড় বড় শাখা—যেখানে লেনদেন বেশি, সেখানে নিরীক্ষা করবেন। এখান থেকেও এ কেলেঙ্কারি রোধে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। আবার সরকারের একটি নিরীক্ষা দল আছে। তারা হাজার হাজার অভিযোগ করে থাকে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ দেখলাম না। এখানে সবগুলো নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি ব্যর্থ হলো।
পদ্ধতি পরিচালিত হয় ব্যক্তির দ্বারা। একজন দুষ্ট লোককে যত ভালো পদ্ধতি দেওয়া হোক না কেন, তিনি এই পদ্ধতির বারোটা বাজিয়ে ছাড়বেন। একজন ভালো লোককে খারাপ পদ্ধতি দিলেও তিনি সেটাকে অনেক ভালো করে ফেলতে পারেন। পদ্ধতির চেয়েও মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে লোক নির্বাচন পদ্ধতিতে। যত ঝামেলা এখান থেকেই শুরু হচ্ছে। কয়েক বছর আগে ব্যাংকগুলোকে কোম্পানি করে কোম্পানির আওতায় আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চালানোর ব্যবস্থা করা হলো। ফলে কোম্পানি ও আমলা দুটো ধরনই ব্যর্থ হলো। কোম্পানি ধরনে চালানোর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি ব্যাংকিং বিভাগ তৈরি করা হলো। এটা কোম্পানি আইনের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ। মালিক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় তো আছেই। কিন্তু যখন একটা ব্যাংকিং বিভাগ করা হলো, তারা কী করবে? কথায় বলে, নাই কাজ তো খই ভাজ। তাদের তো একটা কাজের দরকার। তখন তারা কাকে কোথায় বদলি করা যায়, কাকে কীভাবে রক্ষা করা যায় ইত্যাদি কাজ করতে থাকল। আরও অনেক রকমের কথা কানে আসে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই ব্যাংকিং বিভাগ তুলে দিতে হবে। তা না হলে ব্যাংক সংকট থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না।
ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে বাজার থেকে দক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়োগ দিতে হবে। লোক নিয়োগ একটি বিশেষায়িত দক্ষতা। বিজ্ঞান, জনপ্রশাসন যেমন বিশেষায়িত বিষয়, তেমনি উচ্চপর্যায়ের দক্ষ, যোগ্য লোক নির্বাচন করা একটি বিশেষায়িত বিষয়। একজন সচিব ও মন্ত্রী হলেই যে তিনি উচ্চপর্যায়ের দক্ষ ও যোগ্য লোক নিয়োগ করতে পারবেন, তা নয়। কিন্তু একজন বিশেষায়িত লোক, যিনি এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ, জ্ঞান অর্জন করেছেন ও দীর্ঘদিন এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত, একমাত্র তিনিই উচ্চপর্যায়ের দক্ষ লোক নিয়োগ করতে পারেন। এখন পাঁচ থেকে ছয় বছরের বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন (এসিআর) দেখে সচিব-মন্ত্রী লোক নিয়োগ দিলেন। চুরি যে করে, তার বার্ষিক গোপন প্রতিবেদনে চুরির ঘটনা লেখা থাকে না। তাই শুধু এটা লোক নির্বাচনের মাধ্যম হতে পারে না। সোনালী ব্যাংকের মতো ব্যাংকে কাজ করতে হলে তাঁকে কয়েকটি ব্যাংকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করতে হবে। একজন খারাপ লোককে নিয়োগ দিলে লোকজন বলবে, এই লোকটা ঘুষখোর, তাঁকে কেন এখানে এনেছে। অতএব, লোক নিয়োগের সময় জনমনের ধারণা (পাবলিক পারসেপশন) বিবেচনায় নিতে হবে। সচিব এটা বিবেচনায় নিতে পারবেন না। বিশেষ করে যাঁরা এ অঙ্গন বা অন্য ভালো জায়গায় কাজ করেছেন, তাঁদের নিয়ে একটা অনুসন্ধান কমিটি করতে হবে। এমন একটি নির্বাচন কমিটি ঠিক করতে হবে, যাঁরা সঠিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিতে পারবেন।
দুর্নীতি গণতন্ত্রের মতো নয়। গণতন্ত্র নিচের দিক থেকে ওপরের দিকে যায়। দুর্নীতি ওপরের দিক থেকে নিচে আসে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে মাথা পচে আগে। এ জন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক ও সম্ভব হলে উপমহাব্যবস্থাপক পর্যায়ে যাঁরা নিয়োগ পাবেন, তাঁদের যদি সঠিকভাবে নিয়োগ দেওয়া যায়, তা হলে নিচের স্তরে কোনো দুর্নীতিবাজ থাকবে না। যে মহাব্যবস্থাপক ট্রুথ কমিশনে গিয়ে হলফ করে বলেছেন, ‘হ্যাঁ স্যার, ঘুষ খেয়েছি। এই নিন টাকা’, তাঁকেই পদোন্নতি দিয়ে সোনালী ব্যাংকে দেওয়া হলো, যাতে বড় রকম দুর্নীতি করতে পারে। ব্যাংকিং বিভাগের সচিবের কাছে জানতে চাই, ট্রুথ কমিশনে যাওয়া লোক কী করে ব্যাংকিং বিভাগে এলেন? এবং তিনি হলেন এই পুরো দুর্নীতি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক। তাঁর সঙ্গে অন্যরা হাত মিলিয়েছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ এই ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতিপরায়ণ লোকজনকে বসিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগে পচন ধরেছে। এটাকে তুলে দিতে হবে। তা না হলে ব্যাংকব্যবস্থা ঠিক হবে না। বর্তমান সরকার, হাওয়া ভবনের সরকার, তার আগের সরকার—কেউ কোনো দুর্নীতির সমাধান দিতে পারেনি। নিচের স্তরে সাজা দিয়ে কিছু হবে না।
উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে হলমার্ক পর্যন্ত যারা জড়িত, তাদের সবাইকে র‌্যাবের হাতে তুলে রিমান্ডে দিতে হবে। রিমান্ডে না দিলে দুর্নীতির ২০ গুণ সম্পদের হিসাব বের হবে না। সরকারের শক্তি দিয়ে ওই টাকা উদ্ধার করে ব্যাংকে জমা করতে হবে। এ কাজগুলো করলে সরকারের ব্যাংকব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা পুরোপুরি ফিরে আসবে।

আব্দুল কাইয়ুম
কেন ব্যাংকে দুর্নীতি হয়েছে এবং কীভাবে ব্যাংকে আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়, সে সম্পর্কে ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন। হলমার্কের মালিক গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন, তাঁর ঋণের ২০ গুণ সম্পত্তি আছে। এ সম্পত্তির কর দিয়েছেন কি না, এনবিআর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারে। এবার বলবেন রায়হানা আনিসা য়ূসুফ আলী।

রায়হানা আনিসা য়ূসুফ আলী
সোনালী ব্যাংক পরিবারের একজন সাবেক সদস্য হিসেবে এই কেলেঙ্কারির ঘটনায় লজ্জিত হয়েছি। দুঃখ পেয়েছি। একটি কথা জোর দিয়ে বলতে চাই, আমাদের পদ্ধতিতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা রয়েছে পদ্ধতি ব্যবহারকারী মানুষের মধ্যে। একটা ব্যাংক তার জমার কত অংশ ঋণ দিতে পারবে, নিয়মে তা স্পষ্ট করে বলা আছে। ব্যাংকে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কার কতটুকু ক্ষমতা, সেটা খুব পরিষ্কার করে বলা আছে। ২০০৭ সালে আমি যখন সোনালী ব্যাংকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করি, রূপসী বাংলার ব্যবস্থাপককে (ম্যানেজার) তখন সহকারী ব্যবস্থাপক (এজিএম) হিসেবে পাই। নিয়ম অনুযায়ী কারও পদোন্নতি হলে তাঁকে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু তিনি কী করে পদোন্নতি পাওয়ার পরও রূপসী বাংলা শাখায় ছিলেন, তা কোনোভাবে বোধগম্য নয়।
আমরা জানতে পেরেছি, তিন মাসে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা বের করা হয়েছে। এটা খুবই ভয়ংকর ও অস্বাভাবিক যে একটা শাখা থেকে এক ব্যক্তিকে মাত্র তিন মাসে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে! বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জেনেছি, একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন। তাঁকে তৎক্ষণাৎ বদলি করা হয়। এবং অনেক ওপর থেকে বলা হয়, ‘খবরদার, এ ব্যাপারে কোনো কথা বলবেন না!’ ইংল্যান্ডে ব্যাংকারদের খুব সম্মান করা হয়, সেই ধারণা থেকে ব্যাংকে আসা। আজ ব্যাংক কর্মকর্তারা যা করছেন, তাতে খুব লজ্জা বোধ করছি। একসময় নিয়োগ বোর্ডে ছিলাম। তখন আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল জনমনের ধারণার (পাবলিক পারসেপশন) দিকে লক্ষ রাখতে। এ বিষয় আজ এখানে আলোচিত হলো। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। এখানে সবাই সবার আত্মীয়। তাই আমরা কোনো না কোনোভাবে নিম্নস্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি। এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে হাত করে দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করি। একটা জাতির জন্য এর থেকে খারাপ আর কী হতে পারে। এক তরুণ ব্যাংকারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার লক্ষ্য কী?’ সে বলল, ‘উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যবস্থাপানা পরিচালক হব। গাড়ি-বাড়ি করব।’ আমরা এগুলো কখনো চিন্তা করতে পারতাম না।

এম এ তসলিম
দেশে যে অবস্থা চলছে, এর শেষ কোথায়, আমরা কেউ জানি না। শরীরের যখন সব জায়গায় সমস্যা হয়, তখন ওষুধ দেওয়ার জায়গা থাকে না। দেশে যে দুর্নীতি-জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে, সেটা অস্বাভাবিক। সোনালী ব্যাংকের কেলেঙ্কারি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সুরঞ্জিত সেনের এপিএসের গাড়িতে টাকা, সেটি আলোচনা হতে হতে বিএনপির এক নেতা গুম। এরপর বিশ্বব্যাংক থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ। পদ্মা সেতুর পর সোনালী ব্যাংক। আবার খুন, গুম সাংবাদিক হত্যা, একটা পর একটা চলছেই। এসব ঘটনার কোনোটির বিচার হয়নি। একটি বড় অপরাধ ও দুর্নীতি আরও একটি বড় অপরাধ ও দুর্নীতি দ্বারা ঢাকা পড়ছে। আমরা জানি যে শেষ তিন মাসে নিরীক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা বের করা হয়েছে। এটি কখন সম্ভব? সম্ভব হয় যখন কেউ বুঝতে পারে, যা-ই করা হোক না কেন, তার কোনো বিচার হবে না। অর্থমন্ত্রী বললেন, চার হাজার কোটি টাকা কিছু নয়। এসব কথা আমাদের গভীর শঙ্কার মধ্যে ফেলে দেয়।
সাধারণত দুর্নীতি যা প্রকাশ পায়, বাস্তব অবস্থা তার থেকে অনেক বেশি। এখন অন্যান্য ব্যাংক থেকেও লুটপাটের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সব ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। একজন দারোগা পুলিশের উপমহাপরিদর্শক, মহাপরিদর্শককে তোয়াক্কা করেন না। কারণ, তিনি জানেন, তাঁকে কিছু করতে গেলে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক, মহাপরিদর্শকের পায়ের নিচে মাটি থাকবে না। তেমনি সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপক তাঁর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে কোনো পাত্তা দেননি। কারণ, তিনিও জানেন, তাঁর অনেক বড় প্রভু আছেন, যিনি তাঁকে রক্ষা করবেন। মূলত এই ব্যবস্থাপক তাঁর সেই প্রভুর নির্দেশমতো কাজ করছেন। আবার সাজা হচ্ছে কাদের, যারা বকশিশ নিয়েছে, তাদের। আসল অপরাধী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এত দিন জানতাম, ঋণপত্র (এলসি) হয় বিদেশের সঙ্গে। এখন শুনছি এটা নাকি দেশের মধ্যে হয়। এটাই দুর্নীতির একটা মাধ্যম। দেশের মধ্যে যদি ঋণপত্রের দরকার হয়, তা হলে আগে দুর্নীতির সুযোগগুলো বন্ধ করতে হবে। এখন দেশের অন্যতম বাণিজ্য হলো নিয়োগ-বাণিজ্য। এমন কোনো সরকারি নিয়োগ নেই যেখানে টাকার লেনদেন হয় না। কোটাপদ্ধতি, এই-সেই পদ্ধতির নামে এমন অদক্ষ-অযোগ্য লোক সরকারের বিভিন্ন খাতে ঢুকছে যে ভবিষ্যতে দেশটি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবে।

আকবর আলি খান
ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কারণ, এটি একটি বড় ধরনের প্রতারণা। একটির পর একটি সংকট তৈরি হচ্ছে। আরেকটি বড় সংকট এসে প্রথমটিকে চাপা দিচ্ছে। এভাবেই আজ আমরা একটি জাতীয় সংকটের মধ্যে পড়ে গেছি। ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় অর্থ মন্ত্রণালয় ও গণমাধ্যম ভূমিকা রেখেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রহস্যজনক। গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়। শুরুতে অর্থমন্ত্রী এই কেলেঙ্কারিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে হালকা করে দেখার চেষ্টা করেছেন। যখন বুঝতে পেরেছেন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি, তখন মত বদলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে বলল। তখন তিনি বললেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এটা বলার এখতিয়ার নেই। অথচ কোম্পানি আইনে সুস্পষ্টভাবে তফসিলি ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়-দায়িত্বের কথা বলা আছে। এবং পৃথিবীর সব দেশে ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ থাকে। বরং গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো এখতিয়ার ছিল না। মালিকানা থাকলে সরকারের আছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের বেলায় সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গণমাধ্যম হইচই করে দেশের ক্ষতি করছে, গণমাধ্যমের জন্য টাকা আদায় বাধাগ্রস্ত হবে—অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। সরকারের টাকা তোলার ইচ্ছা থাকলে অনেক আগেই সেটা করতে পারত। আবার অর্থমন্ত্রী বললেন, সোনালী ব্যাংকের ঋণসীমা ৪০ হাজার কোটি টাকা। চার হাজার কোটি টাকায় ব্যাংকের কোনো অসুবিধা হবে না। অথচ সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলছেন, এই টাকা না পেলে তাঁরা সংকটে পড়ে যাবেন। সোনালী ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারিতে অর্থমন্ত্রীর ভূমিকা সম্পূর্ণ রহস্যজনক। ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদায়নে মন্ত্রণালয় জড়িত, এই রহস্যও আমি বুঝতে পারি না। ট্রুথ কমিশনের আত্মস্বীকৃত অপরাধীদের কীভাবে সোনালী ব্যাংকের মতো একটি বড় ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয়, সেটি আরেক রহস্য।
আয়নায় নিজের চেহারা দেখা যায়। নিজের চেহারা খারাপ হলে সেটা আয়নার দোষ নয়, চেহারার দোষ। গণমাধ্যম সমাজের আয়না, তারাই প্রথম এ দুর্নীতিকে সাধারণ মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে। গণমাধ্যম বড় রকমের ধন্যবাদ পাওয়ার মতো কাজ করেছে। আর আমাদের অর্থমন্ত্রী গণমাধ্যমকে একহাত নিলেন।
গণমাধ্যমের মতো আওয়ামী লীগকে এ ঘটনার জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে। কারণ, বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই প্রথম কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ অন্যরা এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন। নিজেদের ভেতর থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ হলে সেই অন্যায়কারী পার পাবে না।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক আছে, থাকবে—এটা ধরে নিয়ে আমরা এতক্ষণ আলোচনা করেছি। কিন্তু ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, সব সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক চালাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এ জন্য আমার প্রস্তাব হলো, সব সরকারি ব্যাংক বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করবে। সব সরকারের সময় ব্যাংকের অর্থ নয়ছয় হয়ে থাকে।
সবার আলোচনায় একটা বিষয় বেরিয়ে এসেছে তা হলো, সরকারের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সরকারের আর্থিক খাত সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার এ খাত নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবেদনে বলেছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন নিতে গেলে ঘুষ দিতে হয়। পেনশন নিতে গেলে ঘুষ দিতে হয়। অর্থাৎ যেখানে টাকা আছে, সেখানে দুর্নীতি। ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা না থাকলে আর্থিক খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। সোনালী ব্যাংকে যে কেলেঙ্কারি ঘটল, তা বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অব্যবস্থাপনার নিকৃষ্টতম উদাহরণ। এ থেকে সরকারকে শিক্ষা নিয়ে সবকিছু শক্ত হাতে দমন করতে হবে। আমরা শেয়ারবাজারে ধস দেখলাম, ইউনিপেটুইউ দেখলাম, ডেসটিনি দেখলাম, হলমার্ক দেখলাম। এভাবে যদি একের পর এক অর্থ লুট হতে থাকে, তা হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। সরকারের চেয়ে চেয়ে দেখার সময় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। ত্বরিত ব্যবস্থা না নিলে সবাইকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
একসময় সরকারি ব্যাংকের শেয়ার ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেটা আর কার্যকর হয়নি। এখন বলবেন এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
এটা খুব পরিষ্কার যে সরকারের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। শেয়ারবাজার, ইউনিপে, পদ্মা সেতু, ডেসটিনি ও গ্রামীণ ব্যাংক—একটি জায়গাতেও সরকারের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কাজ করেনি। বেসরকারি খাতে ব্যাংক ছেড়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ আসছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে সরকার ব্যাংকগুলোকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে চায় না, সে কেন অন্যের হাতে ব্যাংক ছেড়ে দেবে? সব সরকার ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। এখান থেকে বেরিয়ে এসে মালিকানা অন্যের কাছে ছেড়ে দেবে, এটা আমার কাছে অবাস্তব মনে হয়। ব্যাংক খাতে কিছুটা নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর কিছু ফলও পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সে অবস্থার ধস নামল।
বর্তমানে যে কেলেঙ্কারি ঘটেছে, তার বিশ্লেষণ অনেকেই করেছেন। আমি সেই বিশ্লেষণে যাব না। তবে এর থেকে শিক্ষা নিয়ে কীভাবে সামনের দিকে এগোনো যায়, সে ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। এই দিকনির্দেশনা যে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয় আশা করতে পারছি না। কারণ, আশা করতে পারলে অনেক কিছুই হতো। হলমার্কের ঘটনা ঘটেছে মূলত অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়ের জন্য। অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বিত কোনো নীতিমালা নেই। প্রতিটি ব্যাংক তার নিজের মতো পদ্ধতি অনুসরণ করে। অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়ের কারণে যে দায়ের সৃষ্টি হচ্ছে, তার প্রতিবেদন পেশের প্রয়োজনীয়তা (রিপোর্টিং রিকয়ারমেন্ট) সম্পর্কে স্বচ্ছতা নেই। অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়ব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করতে হবে। এটা করতে গিয়ে যেন ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি না হয়, সে দিকটি খেয়াল করতে হবে। অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে যারা তৈরি পোশাক রপ্তানি করে, তাদের অনেক পণ্য দেশের ভেতর থেকে ক্রয় করে। ফলে অভ্যন্তরীণ বিলের হয়তো প্রয়োজন আছে। কিন্তু কীভাবে তাদের মধ্যে সমন্বয় করা যাবে, সেটা ভাবতে হবে। তাই অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়ের সুযোগ একেবারে বন্ধ হলে সমস্যা হতে পারে। তবে কীভাবে এ বিষয়গুলো সমন্বয় করা যায়, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
ব্যবসার মালিকানা এবং ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ আলাদা। তাই ব্যাংকের মালিকানা সরকারের থাকলেও এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পুরোটাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ভালো সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কিছু সংস্কারের প্রয়োজন আছে। নিয়োগপদ্ধতি নিয়ে সারা দেশে বিতর্ক রয়েছে। এখানে কোনো আইন করেও কাজ হবে না। কারণ, সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে সব আইনই তারা ভেঙে ফেলবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে একমাত্র সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেকগুলো মাধ্যম থাকা সত্ত্বেও কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এত দেরিতে বিষয়টি উদ্ঘাটন করল, তা-ও একটি বিষয়। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিক থেকে আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সবার মতো আমারও শেষ কথা, গুরুতর ঘটনা ঘটছে, বিচার হচ্ছে না। কিন্তু এ ঘটনাকে কোনোরকম ছাড় দেওয়া উচিত হবে না। সবার ক্ষেত্রে হয়তো একই আইন প্রয়োগ করা যাবে না। তবে যেখানে যে আইন দরকার, সেটা প্রয়োগ করে এই কেলেঙ্কারির দ্রুত বিচার করতে হবে। তা না হলে ব্যবসা, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান—সবকিছু ধ্বংস হবে।

সালেহউদ্দিন আহমেদ
আমরা যত কথাই বলি, এর কোনো মূল্য নেই—যদি সরকারের সদিচ্ছা না থাকে। দেশে কত আইন আছে, কোনো আইনেই তো কোনো কাজ হয় না। কারণ, সরকারের সদিচ্ছা থাকে না। আমার সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ে কিছু সংস্কার জমা দেওয়া আছে। তারা কি কাজ করে জানি না। আজও সে সংস্কার নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। এ সংস্কারগুলো করতে হবে। যতই চাপ আসুক না কেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে সবকিছু শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শেষ যেটা বলতে চাই, যে ঘটনা ঘটল, তাকে যদি কোনোরকমে ধামাচাপা দেওয়া হয়, তা হলে হঠাৎ টাইটানিকের মতো সবাই একসঙ্গে ডুবে যাব।

এম এ তসলিম
নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে সবাই যা বললেন, তাকে এককথায় সারমর্ম করা যায়, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

রায়হানা আনিসা য়ূসুফ আলী
পরিচালনা পর্ষদ বলছে যে তাদের কোনো দায় নেই। একজন ব্যাংকার হিসেবে আমি এটা কোনোভাবেই মানি না। যেকোনো প্রস্তাব পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করা হয়। তাদের অনুমোদন ছাড়া কোনো ঋণই পাস হতে পারে না। তারা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
আইন সবার জন্য সমান হতে হবে। ব্যক্তিমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংক—সবার জন্য সমান আইন থাকতে হবে। এক দেশে দুই ব্যাংকে দুই রকম আইন থাকতে পারবে না। এ ব্যাপারে ফখরুদ্দীন আহমদ ও সালেহউদ্দিন আহমদ সুপারিশ করেছেন। কিন্তু সচিবালয়ে এসে আটকে যায়। সচিবালয়কে বাদ দিয়ে সংসদে পাঠাতে হবে। দেশটা সরকারের একার নয়। এ দেশটা আমাদের সবার। অতএব, সবাইকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদেরই বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে হবে। আমাদের নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক সমাজ ও শিক্ষক সমাজ—সবাইকে একসঙ্গে প্রতিবাদ জানাতে হবে। এভাবে প্রতিবাদ করতে করতে একসময় এটি বিশাল শক্তি সঞ্চয় করবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

আকবর আলি খান
সবাই বলছেন যে সরকার কারও কথা শোনে না এবং বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কথা আসছে। আমার কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় ব্যাংক চালানোর যোগ্যতা সরকারের নেই। সব সরকারি ব্যাংক ব্যক্তিমালিকানা খাতে ছেড়ে দিতে হবে। এই লক্ষ্যটা আমাদের ঠিক করতে হবে। আজ না হয় পাঁচ বছর পর এমন সরকার আসবে, যারা এই ভালো কাজটি করবে। শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যাংক নয়, সরকারের পক্ষে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো সম্ভব নয়। বিদেশে প্রশিক্ষিত মারাত্মক প্রতারণা (সিরিয়াস ফ্রড) তদন্ত কমিশন আছে। এ রকম একটি তদন্ত কমিশন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দিয়ে এই কেলেঙ্কারির তদন্ত করতে হবে। অন্যথায় অতীতের মতো সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যাবে। শাস্তি হওয়া তো দূরের কথা, আমরা কিছু জানতেও পারব না।

আব্দুল কাইয়ুম
একটি ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আজকের আলোচনায় রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ও পরামর্শ উঠে এসেছে। এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে ব্যাংকের সমস্যা অনেকাংশে কেটে যাবে। ব্যস্ততার মধ্যেও আপনারা সময় দিয়েছেন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.