কলকাতার চিঠি by ঊর্মি রহমান

ঢাকা ঘুরে এলাম। কলকাতায় বসে ঢাকার কথা লেখা হয়ত ঠিক নয়, কিন্তু কয়েকটা কথা না লিখে পারলাম না। ঢাকা শহরের অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে, যদিও সেসব কথা কেউ শুনবে না জানি। সেসব অন্য কোন লেখায় বিবৃত করবো। কিন্তু এটা খানিকটা কলকাতার সাথে সম্পৃক্ত বটে।


কলকাতায় থাকার সুবাদে ঘন ঘন ঢাকা যাই। অধিকাংশ সময় আমরা ট্রেনে যাই মৈত্রী এক্সপ্রেস। অনেকে সে সম্পর্কে বেশি কিছু জানেন না, তাছাড়া তার কিছু সুবিধা-অসুবিধা আছে, যেগুলোর কথা বলা দরকার বলে মনে হয়েছে, সেজন্যই এই বিষয়ের অবতারণা। শুনেছি প্রথমদিকে ট্রেনটা তত জনপ্রিয় ছিল না, কিন্তু এখন সেটা এতই জনপ্রিয় যে, এবার ফেরার সময় আমরা কলকাতার টিকেট পাইনি। শুরু থেকেই বলি। মৈত্রী এক্সপ্রেসের কোন রিটার্ন টিকেট হয় না, কেন হয় না জানি না। শুনেছি যেহেতু এই রেল সার্ভিস উভয় দেশের সরকারের, সেজন্য টাকার আদান-প্রদানসহ কিছু বিষয় নিয়ে সমস্যার কারণে সেটা করা যায় না। বেসরকারী হবার কারণে বিমান সংস্থাগুলো সেটা করতে পারে। ফলে কলকাতা থেকে ঢাকার টিকেট কেটে গিয়ে আবার ঢাকা থেকে কলকাতার আর একটা টিকেট কেটে ফিরতে হয়। তাতেও সমস্যা আছে। কলকাতায় এই টিকেট ছাড়া হয় ঠিক ১০ দিন আগে আর ঢাকায় ছাড়ে এক মাস আগে। কলকাতায় আমরা সাতদিন আগে গেলেও টিকেট পাই, কিন্তু ঢাকায় প্রায় মাসখানেক আগেই টিকেট সব বুক হয়ে যায়। কলকাতার ট্রেন ছাড়ে চিৎপুর এলাকার ‘কলকাতা’ নামে একটা স্টেশন থেকে আর ঢাকায় ছাড়ে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে। দুই দেশেই যেখান থেকে ট্রেন ছাড়ে, টিকেট সেখানে পাওয়া যায় না, সেজন্য অন্য জায়গায় যেতে হয়। ঢাকায় যেতে হয় কমলাপুর স্টেশনে আর কলকাতায় যেতে হয় বিনয়-বাদল-দীনেশ (বিবাদী) বাগ এলাকার ফেয়ারলী প্লেসে। আপনার ভিসা হবার পরই একমাত্র আপনি টিকেট কাটতে পারবেন। কলকাতায় এখনো এজন্য ফর্ম পূরণ করতে হয়, কিন্তু ঢাকায় দেখলাম পাসপোর্ট দিলেই টিকেট পাওয়া যাচ্ছে। আসলে দু’দিকেই সুবিধা-অসুবিধা আছে। ফেয়ারলী প্লেসে সুন্দর বসার ব্যবস্থা আছে, পাখা ও এসি আছে। ঢাকা কমলাপুরে সেসব কিছু নেই। গরমে লাইন দিয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে আপনাকে টিকেট কাটতে হবে। তবে টিকেট বিক্রির কাজ যাঁরা করেন, সেই রেল কর্মীরা অত্যন্ত ভদ্র ও সৎ, সেটা মানতেই হবে।
কলকাতা থেকে ট্রেনটা ছাড়ে সকাল ৭:১০ মিনিটে আর ঢাকা থেকে সাড়ে আটটা নাগাদ। স্টেশনে মালপত্রের এক্সরে হয়। ট্রেন প্রথম থামে ভারতীয় সীমান্ত স্টেশন গেদে’তে। সমস্ত মালপত্র নিয়ে নামতে হয়। তবে সেখানে কুলী আছে। পাসপোর্ট, মালপত্র ও শারীরিক পরীক্ষা হবার পর একটা জাল দিয়ে ঘেরা ঘরে বসতে হয় যতক্ষণ না সমস্ত যাত্রীর সেসব করা শেষ হবে। অথবা হয়ত নির্দিষ্ট সময় পার না হলে সেই ঘরের তালা খোলা হয় না। অনেকটা খাচার মত! তবে সেখানে চা-কপি-বিস্কুট ইত্যাদি পাওয়া যায়। সব কিছু নিয়ে আবার টেনে ওঠার প্রায় মিনিট দশেক পর বাংলাদেশের সীমান্ত দর্শনায় পৌঁছে যাবেন। আবার সব কিছুর পুনরাবৃত্তি করতে হয়। দর্শনায় ট্রলী আছে, কুলী নেই। ঘরটা খুব ছোট। ফলে গাদাগাদি করে সেখানে অভিবাসন ইত্যাদি করার জন্য লাইন দিতে হয়। তবে সব হয়ে গেলে আপনি সোজা ট্রেনে গিয়ে উঠতে পারবেন। মনে রাখবেন, আপনাকে কিন্তু ট্রেন বা আসন বদলাতে হচ্ছে না। দর্শনা থেকে ছাড়ার পর আর কোন থামাথামি নেই, যদি না যেখানে সিঙ্গল ট্র্যাক, সেখানে অপর দিক থেকে আসা ট্রেনটা যেতে দেবার জন্য মৈত্রী এক্সপ্রেসকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ট্রেনটা খুব আরামদায়ক। বাইরের চমৎকার দৃশ্য দেখতে দেখতে যেতে পারবেন। হার্ডিঞ্জ ও যমুনা ব্রিজের মতো দু’টি বিখ্যাত সেতু আপনি পার হবেন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাবেন। তুলনা করার চেষ্টাও করতে পারেন, তবে পার্থক্য খুব সামান্যই।
ট্রেনে চা-কফি তো বটেই, খাবার-দাবারও পাওয়া যায়, যার মান খুব খারাপ নয়। আমি তো প্রথমবার ইলিশ মাছ-ভাতও পেয়েছিলাম। এখন ইলিশ মাছের আকাশ-ছোঁয়া দামের জন্য সেটা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে আমাকে রেলের প্যান্ট্রিকারের একজন কর্মী জানিয়েছেন। মৈত্রী এক্সপ্রেসের ভাড়াও প্লেনের তুলনায় প্রায় ৭ ভাগের একভাগ। তবে দুই সীমান্তে নামাটা ঝামেলাপূর্ণ, বিশেষ করে বয়স্ক, অশক্ত ও শিশুসহ মায়েদের জন্য। শুনেছি অন-বোর্ড অর্থাৎ ট্রেনের ভেতরেই অভিবাসন ইত্যাদি করার চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন কেন হচ্ছে না জানি না। বিদেশে সর্বত্র দুই বা একাধিক দেশের মধ্যে অন-বোর্ড চেকিং হয়। সেটা হয়ে গেলে যাত্রার সময় অনেক কমে যাবে। এখন লাগে ১১ ঘণ্টা, তখন ৭/৮ ঘণ্টায় কলকাতা থেকে ঢাকা পৌঁছনো যাবে। ছোটখাটো যেসব সমস্যা আছে, সেসব কাটিয়ে উঠতে পারলে মৈত্রী এক্সপ্রেসের যাত্রা অনেক সুখদায়ক হবে। যেমন, রিটার্ন টিকেট কাটার ব্যবস্থা, ঢাকা কমলাপুরে একটু বসার ব্যবস্থা, যেখানে পাখা থাকবে (এটা তো আন্তর্জাতিক ট্রেন, তার ব্যবস্থার মানও সেরকম হওয়া দরকার)। অন-বোর্ড না হলেও যেহেতু যাত্রার শুরুতে মালপত্রের পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে, মাঝখানে সীমান্ত স্টেশনগুলোতে সেসব নিয়ে নামার ঝামেলা থেকে অব্যাহতি (বিশেষ করে যেখানে ট্রেনটা কোথাও থামে না আর দরজাগুলো তালাবদ্ধ থাকে)। তবে এখানে স্বীকার করি, এতসব ঝামেলা সত্ত্বেও ঢাকা যাবার সময় আমি কিন্তু এই রেলযাত্রায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই।
এবার একটি ব্যাখ্যার অতীত মর্মান্তিক ঘটনার কথা বলি। আমরা যে আবাসনে থাকি, তার ভবনগুলো (এদের টাওয়ার বলা হয়) আপাততঃ কলকাতার সর্বোচ্চ ভবন; চারটি টাওয়ার আছে, যার প্রতিটি ৩৬ তলা। অনেক খোলামেলা জায়গা, বাচ্চাদের পার্ক, ছোট একটা ঝিল ইত্যাদি সবই আছে। সেখানে গতমাসে একটি সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে। আমি ভোরে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। ১ নম্বর টাওয়ারের সামনে গিয়ে দেখি অনেকে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে আর কিছু পুলিশও আছে সেখানে। আমারই মতো প্রাতঃভ্রমণকারী এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার? তিনি বললেন, আগের রাতে ঐ টাওয়ারের ওপর থেকে পড়ে তিনজন মহিলা মারা গেছেন। তাঁর সঙ্গীকে দেখিয়ে বললেন, তিনি দেখেছেন। তিনি অবশ্য বললেন, না, আমি ঠিক মৃতদেহ দেখিনি, তবে অন্য ‘মাল-মশলা’ দেখেছি। সেদিন গোটা দিনটা ধরেই অনেক জল্পনা-কল্পনা চলল। কোন ফ্ল্যাট থেকে পড়েছেন (নাকি ফেলে দিয়েছে কেউ) সেটা বের করা খুব কঠিন। এক একটা টাওয়ারে চার শ’ করে ফ্ল্যাট। পরে আসল ঘটনা জানা গেল। বৃদ্ধা মা ও তাঁর দুই মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তাঁরা এই আবাসনের বাসিন্দা নন, থাকতেন গলফ গ্রিণ নামে কাছাকাছি একটা এলাকায়। মা অনিমার বয়স আশির বেশি, দুই মেয়ে মুকুতা ওে খয়ার বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। তাঁদের বাবা দু’দিন আগে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছেন। তবে বাবা মারা যাবার আগেই মনে হয় এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ‘রবীন্দ্রপ্রেমী’ নামে নিজেদের অভিহিত করা এই পরিবার ঘটনার কয়েকদিন আগে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে তাঁদের সমস্ত সম্পত্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করার প্রস্তাব নিয়ে যান। তাঁরা বলেছিলেন, তাঁরা বিদেশ চলে যাচ্ছেন। তাঁদের তাড়াহুড়া দেখে উপাচার্য নিঃসন্দেহ হতে পারেননি বলে রাজী হননি। মুকুতা পরিবার অবশ্য মারা যাবার আগে সমস্ত সম্পত্তি রবীন্দ্রভারতীকে দান করে একটা চিঠি লিখে রেখে যায়। শোনা গেল চরম অবসাদের কারণে এই আত্মহত্যা। মেয়ে দু’টি বাবাকে দাহ না করে বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তাতে বন্ধু-পরিচিতরা বাধা দেয়। শ্মশানে শুধু মুকুতা গিয়েছিলেন, মা এবং অন্য মেয়েটি যাননি। তাতে বোঝা যায়, শুধু অবসাদ নয়, অন্য কোন অবসেশন কাজ করছিল। উল্লেখ্য, বাবার বয়স নব্বই পেরিয়ে গিয়েছিল। আজ হোক, কাল হোক, তিনি মারা যেতেন। সেজন্য এত বেশি ডিপ্রেশন বা অবসাদের কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আর্থিক সঙ্কট বলতে যা বোঝায়, তা-ও তাঁদের ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, অন্তত মুকুতার বেঁচে থাকার অনেক কারণ ছিল। তিনি পরিবেশবাদী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে নিরলস লড়ে গেছেন। ভাল টেবিল টেনিস খেলতেন। আমাদের পরিচিত অনেকেই তাঁকে চিনতো আর তারা সবাই এই ঘটনায় খুবই অবাক হয়েছে। তাঁর মতো মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারেন, এটা তারা ভাবতে পারছে না। জানা গেছে, মারা যাবার আগে তারা কলকাতার উঁচু ভবন বা স্থাপনাগুলোর একটা তালিকা করেন, যার মধ্যে গঙ্গার বুকের সেতু থেকে শুরু করে অনেক অফিস ভবনও ছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদের আবাসনকেই তাঁরা বেছে নিলেন। এখনো কলকাতার মানুষ এই মিলিত আত্মহত্যার কোন যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। এখনো সবার বিস্ময় কাটেনি।

No comments

Powered by Blogger.