দ্য লাস্ট স্কুপ - ছয় ছক্কা - আফ্রিদি উদ্যাপন

‘দ্য লাস্ট স্কুপ’ সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ব্যবধান, টাইমিং সামান্য এদিক-সেদিক হলেই ইতিহাস লেখা হতে পারত অন্যভাবে। ট্র্যাজেডির নায়ক নন, মিসবাহ-উল-হক হয়ে যেতেন সত্যিকারের নায়ক। অভাবিতভাবে ওই বিশ্বকাপে ক্যারিয়ার পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল মিসবাহর, পাকিস্তানকে জেতাচ্ছিলেন ম্যাচের পর ম্যাচ।
কিন্তু আসল সময়েই পাকালেন গুবলেট, গ্রুপ পর্বের মতো ভারতের বিপক্ষে ফাইনালেও বীরোচিত ব্যাটিংয়ের শেষটা মোড়ানো থাকল হতাশায়। ৪ ওভারে ৫৪ রানের সমীকরণ নামিয়ে এনেছিলেন ৫ বলে ১২-তে। সেখান থেকে ঠান্ডা মাথায় শ্রীশান্তকে ছয়, ৪ বলে ৬। উইকেটে শেষ জুটি। স্কুপ শটটা সেবার খুব কার্যকর হয়েছিল মিসবাহর জন্য, ওই মুহূর্তেও তা-ই করতে গেলেন। কিন্তু আগেই বুঝে স্লোয়ার ডেলিভারি করলেন জোগিন্দর শর্মা। বল উঠে গেল ওপরে, কোটি কোটি চোখ বলের দিকে। খানিক পর সেই বল জমা পড়ল শর্ট ফাইন লেগে শ্রীশান্তের হাতে। বিশ্বজয়ের উৎসবে মাতল ভারত। মিসবাহ তখনো হাঁটুগেড়ে বসে, চোখে উদ্ভ্রান্তের দৃষ্টি। যেন সেই নাবিক, যিনি ডুবতে থাকা জাহাজকে দারুণ দক্ষতায় তীরে টেনে আনছিলেন, ডুবে গেল তীরে আসার পরই!

দিল স্কুপ
‘দ্য স্কুপ’—বইপ্রেমীদের কাছে এলভিন ওয়াহর স্যাটায়ার উপন্যাস আর চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে উডি অ্যালেনের রোমান্টিক কমেডি সিনেমা। ক্রিকেটপ্রেমীরাও শব্দটির সঙ্গে একটু-আধটু পরিচিত ছিলেন। ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু কার্যকর একটি শট ‘স্কুপ’। আন্তর্জাতিক আঙিনায় শটটা প্রথম খেলেছিলেন সম্ভবত জিম্বাবুয়ের ডগ ম্যারিলিয়ার, ২০০২ সালে ভারতের বিপক্ষে। তবে বিশ্বমঞ্চে প্রথম এই শটের কার্যকারিতা দেখিয়েছেন সম্ভবত মোহাম্মদ আশরাফুল, ২০০৭ বিশ্বকাপের সুপার এইটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৮৩ বলে ৮৭ রানের ম্যাচ-জয়ী ইনিংসের পথে এনটিনি-ল্যাঙ্গেভেল্টদের হতভম্ব করে দিয়েছিলেন দারুণ সব স্কুপে। পরের দুই বছরও টুকটাক অনেকেই খেলেছেন। তবে ২০০৯ বিশ্বকাপে যেন শটটাকে নতুন এক মাত্রা দিলেন তিলকরত্নে দিলশান। সদ্য ওপেনিংয়ে উঠে আসা দিলশান স্কুপে দিশেহারা করে ছাড়লেন পেসারদের। এর আগে স্কুপের জন্য সাধারণত বেছে নেওয়া হতো ফুল লেংথ বল, কিন্তু দিলশান গুড লেংথ বলও অনায়াসে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন উইকেটকিপারের মাথার ওপর দিয়ে! ধারাভাষ্যকারেরা শটের নাম দিয়ে দিলেন ‘দিলস্কুপ’, ব্যস ওই নামই স্থায়ী হয়ে গেল!

ভারত ৩-পাকিস্তান ০
ক্রিকেট ইতিহাসে একবারই ম্যাচের ফলাফল হলো ফুটবলের মতো, ৩-০! ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান গ্রুপ পর্বের ম্যাচ কিংসমিডে। মাত্র ৩ ওভারের মধ্যে ম্যাচের রং পাল্টে দিলেন মিসবাহ। জয়টাকে দূরের তারা থেকে নিয়ে এলেন নাগালের মধ্যে। জয়ের জন্য ৪ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৪৯, মিসবাহর ঝড়ে সেটাই হয়ে গেল ৬ বলে ১২। শ্রীশান্তের বলে আরও দুই বাউন্ডারিতে ১১ চলে এল ৪ বলেই। শেষ দুই বলে প্রয়োজন ১। পঞ্চম বলে ব্যাট ছোঁয়াতে পারলেন না মিসবাহ, শেষ বলে ব্যাট ছুুঁইয়েই পড়িমরি দৌড়ে রানআউট। ম্যাচ টাই! কিন্তু আসল নাটক শুরু এরপরই। সেবারই প্রথম টাইব্রেকার চালু করেছিল আইসিসি। প্রতি দলের পাঁচজন করে ক্রিকেটার বোলিং করবেন ফাঁকা স্টাম্পে, যে দল বেশিবার স্টাম্পে লাগাবে, জয়ী তারাই। নাম ‘বোল আউট।’ বুদ্ধি করে সঙ্গে ভারত শুরুতে পাঠিয়েছিল স্লো বোলারদের, পাকিস্তান ডুবল পেসারদের পাঠিয়ে। দুই পা দৌড়ে প্রথম বল স্টাম্পে লাগালেন শেবাগ, লম্বা রান আপে বোলিং করে অফ স্টাম্পের বাইরে মারলেন ইয়াসির আরাফাত। একই ভাবে পরের বলে স্টাম্পে লাগালেন হরভজন, আবারও বাইরে মারলেন উমর গুল। তৃতীয় বলে স্টাম্পে লাগালেন রবিন উথাপ্পা, আফ্রিদির বল গেল লেগ স্টাম্পের বাইরে। ৩-০ তে জিতল ভারত! ওই বিশ্বকাপে আর বোল আউটের প্রয়োজন হয়নি। নিয়মটা এতই সমালোচিত হয়েছিল যে ওটা বাতিল করেছে, এখন টাইব্রেক হয় ‘সুপার ওভারে’।

আফ্রিদি-উদ্যাপন
উইকেট নিয়ে কেউ হয়ে যান পাখি, কেউ বা উড়োজাহাজ। হাত সামনে-ওপরে-পাশে, কতজনের কত রকমের উদ্যাপন! কেউ আবার উন্মত্তের মতো ছুটে যান সতীর্থদের দিকে। শহীদ আফ্রিদির বুঝি মনে হলো, ‘মুহূর্তের নায়ক আমি, আমি কেন ছুটে যাব? সতীর্থরাই ছুটে আসবে আমার দিকে!’ গ্যালারির দিকে তাকিয়ে দুই পা দুই দিকে ছড়িয়ে, দুই হাত দুই দিকে উঁচিয়ে দাঁড়ানো আফ্রিদি, যেন কলোসিয়ামে দাঁড়ানো কোনো যুদ্ধজয়ী রোমান বীর। সতীর্থরা ছুটে আসছেন তাঁকে জড়িয়ে নিতে। এই হলো ‘দি আফ্রিদি সেলিব্রেশন’। বিখ্যাত এই উদ্যাপনের জন্ম ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দিলশানের উইকেট পাওয়ার পরই সম্ভবত প্রথম দেখা গিয়েছিল ওই উদ্যাপন, জয়াসুরিয়ার উইকেট নেওয়ার পর আবার। তবে উদ্যাপনটা সবার নজর কাড়ল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে, অনেকটা দৌড়ে স্কট স্টাইরিসের দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেওয়ার পর। সেই যে মজলেন এই উদ্যাপনে, চলছে এখনো।

আগুন ও বরফ!
সে একসময় ছিল বাংলাদেশের ব্যাটিংয়েই। আফতাব আহমেদের কাছে আক্রমণই ছিল ব্যাটিংয়ের শেষ কথা, আশরাফুলও তখন খেলতেন চোখধাঁধানো সব শট। ২০০৭ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৬৪ বাংলাদেশ ১৮ ওভারেই পেরিয়ে গিয়েছিল আফতাব (৪৯ বলে ৬২*) ও আশরাফুলের (২৭ বলে ৬১) ব্যাটিং-ঝড়ে। পরের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শুরু হলো যেন ওখান থেকেই। শন পোলকের করা প্রথম ওভারেই দুটো চার তামিম ইকবালের। এনটিনির করা পরের ওভারের প্রথম বলেই আউট নাজিমুদ্দিন। আফতাব এসে দুটো বল দেখলেন, পরের দুই বলে দুটো ছয়, শেষ বলে চার। পোলকের করা পরের ওভারের প্রথম বলে আউট তামিম। আশরাফুল নেমে প্রথম বলেই ছয়, পরের বলে চার। পরের বলেই শূণ্যে তুলে আউট। স্ট্রাইক পেলেন আফতাব, আবার চার। দলের প্রথম ৩৮ রানই বাউন্ডারি থেকে, ২.৫ ওভারে! পরের ওভারে আবার এনটিনি। এবার দুটি চার মারলেন আফতাব, একটি সাকিব। ৪ ওভার শেষে ৫৪! বল পেলেন মরনে মরকেল, আফতাব স্বাগত জানালেন দুরন্ত এক চারে। পরের বলেই মরকেলের ১৫০ কিমির গোলায় ক্রস খেলে বোল্ড আফতাব (১৪ বলে ৩৬), রোমাঞ্চকর অভিযানেরও সমাপ্তি। উন্মত্ত এক ঝড়ের পর হঠাৎই যেন সব শান্ত। ৪.১ ওভারে ৫৮ তোলা দল শেষ পর্যন্ত খেলতে পারল না ২০ ওভারও, ১৪৪ রানে গুটিয়ে ম্যাচ হারল ৭ উইকেটে।

ছয় ছক্কা
পঞ্চম ছক্কাটা হজমের পর স্টুয়ার্ট ব্রডের চেহারাটা হয়েছিল দেখার মতো। দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিল চোখে ঘোলা দেখছেন! ব্রডের অসহায় চেহারা মনে করিয়ে দিচ্ছিল যেন ১৯৬৭ সালে আর্নি টেরেলকে, মোহাম্মদ আলি যখন একেকটা বজ্রমুষ্টি টেরেলের দুগালে বসিয়ে দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘হোয়াটস মাই নেম আঙ্কেল টম, হোয়াটস মাই নেম?’ টেরেলের অসহায়ত্বে মায়া হয়েছিল আলির, নকআউট পাঞ্চটা আর মারেননি। তবে ব্রডের অসহায়ত্বে কোনো মায়া হয়নি যুবরাজ সিংয়ের, ষষ্ঠ বলটাও গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিলেন প্রবল আক্রোশে! কদিন আগে ইংল্যান্ডের্ মাসকারেনহাসের কাছে হজম করেছিলেন ওভারে পাঁচ ছয়, সেটার নির্মম প্রতিশোধ যেন ছয় ছক্কায়। কদিন আগে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে হল্যান্ডের বিপক্ষে এই কীর্তি গড়েছিলেন হার্শেল গিবস। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ছিল স্যার গ্যারি সোবার্স ও রবি শাস্ত্রীর। তবে টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে যুবরাজই একমাত্র। ২০০৭ বিশ্বকাপে সেদিন যুবরাজের ১২ বলে ফিফটি এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দ্রুততম ফিফটি।
>>>আরিফুল ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.