অনলাইন নীতিমালা- এই উদ্যোগ সফল হওয়ার সুযোগ নেই by সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর

অনলাইন গণমাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার নীতিমালা তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। সঙ্গে একটি খসড়া প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সম্পৃক্তদের মতামতের জন্য। ১০ দিন সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে লিখিত মতামত জানাতে হবে। সেটাকে নীতিমালার খসড়া বলা হলেও চেহারাটা আইন বা প্রজ্ঞাপনের মতো।


সেখানে অনুমোদন, বাধ্যতা, শাস্তি, জরিমানার বিষয়গুলো আইনের মতোই রাখা হয়েছে।
তথ্যসচিব বলেছেন, আমরা নীতিমালার মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যমের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে চাই না, বরং বিকাশে সহায়তা করতে চাই। সরকার অনলাইনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, দেশদ্রোহী, অসামাজিক কার্যকলাপ রোধ করতে চাইছে। সেই সদিচ্ছাকে সাধুবাদ জানাই। তবে নীতিমালার খসড়ায় ‘বিকাশ’ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না থাকলেও বিবিধ নিয়ন্ত্রণের বিষয় স্পষ্ট।
এই উদ্যোগটির মাধ্যমে বোঝা যায়, সরকার অনলাইনকে গণমাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন মনে করছে। তবে কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করার আগে সেটা সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝা চাই। সে জিনিসটা কী? তার কতটুকু নিয়ন্ত্রণযোগ্য? কতটুকু নিয়ন্ত্রণ যৌক্তিক? আমাদের জনবল ও অবকাঠামো দিয়ে তার কত ভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব? তার চেয়ে আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, আমরা এই রাস্তায় হাঁটব কি না?
প্রস্তাবিত খসড়ায় অনলাইন গণমাধ্যমের কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে অনলাইন গণমাধ্যম হিসেবে ধরা যাবে, সেটা পরিষ্কার নয়। এখনকার অনলাইন মানে শুধু সাদাসিধে ওয়েবসাইট আর ই-মেইল নয়। লেখক-পাঠক মিথস্ক্রিয়ার অসংখ্য ধরনের চ্যানেল তৈরি হয়েছে। নিউজ পোর্টাল, নিউজ এজেন্সি, পিটুপি, মিডিয়া শেয়ারিং, কমিউনিটি ব্লগ, ব্যক্তিগত ব্লগ, মিনি ব্লগ, মাইক্রো ব্লগ, ফোরাম, মেইল-গ্রুপ, চ্যাটরুম, ডিসকাশন গ্রুপ, বুকমার্কিংয়ের মতো অসংখ্য মাধ্যম। প্রতিটি মাধ্যমেই অসংখ্য পাঠকের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ আছে। পাঠকের অংশগ্রহণ এবং পুনঃপ্রচারের সুযোগ আছে। এর মধ্যের কয়েকটি মাধ্যমের পাঠক/দর্শক/শ্রোতাসংখ্যা অনেক প্রতিষ্ঠিত জাতীয় সংবাদপত্রকে ছাড়িয়ে গেছে। সেখানে দিনে যতবার খুশি লেখা, মতামত, ছবি, ভিডিও প্রকাশ করা যায়। পাঠক মন্তব্য করতে পারে। এ ছাড়া কিছু লোকের ব্যক্তিগত, সামাজিক প্রোফাইলে অনেক জাতীয় পত্রিকার চেয়ে বেশি পরিমাণ দেশি-বিদেশি পাঠক যুক্ত। প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে কোনোটির গুরুত্বই কম নয়। এর কতগুলো নীতিমালায় আনা হবে?
তার চেয়ে আগে ভাবা দরকার এর কতগুলো আইন, নীতিমালা, লাইসেন্স, ও তদারকির আওতায় আনা সম্ভব। বাস্তবতা হলো, একটি বড় মন্ত্রণালয়ের সব জনশক্তি নিয়োগ করেও এ দৌড়ে পারা সম্ভব নয়। গোঁ ধরে একের পর এক নীতিমালা তৈরি করে যাওয়া যাবে। লাইসেন্স নিতে বাধ্য করা যাবে। তবে বর্তমান মাধ্যমগুলোর নীতিমালা তৈরি শেষ হওয়ার আগেই শত শত নতুন প্রযুক্তি এসে যাবে। সেই প্রযুক্তিগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে। যে দেশের আইনের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অথচ আমাদের কোনো একটি গ্রামে বসে সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব সহজেই সংবাদ আদান-প্রদান করা যাবে। লেখক, পাঠক যেখানে বেশি স্বাধীনতা পাবেন, সেখানে গিয়েই ভিড় করবেন।
তার পরও এই নীতিমালা নিয়ে এগোতে চাইলে প্রস্তাবিত কিছু ধারা নিয়ে কথা বলা দরকার। ১১ ও ১২ ধারায় প্রকাশনাসংক্রান্ত কিছু কারিগরি নির্দেশ রয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশের স্থাপিত সার্ভারে হোস্টিংয়ের বিষয়টি অবকাঠামো ও নীতিমালার কারণে এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। আর্কাইভ মাত্র ৯০ দিনের বদলে প্রথম থেকেই অনলাইনে সংরক্ষণের নির্দেশনা যৌক্তিক। এ ছাড়া সংবাদমাধ্যমগুলোর নিজস্ব কারিগরি অবকাঠামো ও কর্মপদ্ধতির বিষয়ে কোনো স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। কোনো মানদণ্ড না থাকলে দুর্ঘটনার মুখে প্রয়োজনীয় তথ্য উদ্ধার অসম্ভব। খবর কোথা থেকে এসে কোন পথে প্রকাশিত হলো, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না। প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা যায় না। সে ক্ষেত্রে সংবাদ সংগ্রহ থেকে প্রকাশনা ও সংরক্ষণ পর্যন্ত (নিউজ লাইফ সাইকেল) প্রতিটি প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট কারিগরি মানদণ্ড থাকা দরকার। তবে সেই মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালনা অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর হবে কি না, সেটাও ভেবে দেখতে হবে।
নীতিমালায় উল্লিখিত আর্থিক দিকগুলোর ন্যায্যতা পুনরায় ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। একটি স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার জন্য একই ধরনের শিল্পের খরচ ও আয়ের সমন্বয় প্রয়োজন। দেশি বিজ্ঞাপনদাতারা অনলাইনে বিজ্ঞাপনের বিষয়টি এখনো খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন না। একটি ছাপা পত্রিকার লাইসেন্স খরচ মানে ফটোকপি ফরমের ওপর ২০ টাকার রেভিনিউ স্ট্যাম্প। কোনো জামানত নেই। সেই পত্রিকা অনলাইনে প্রকাশেরও কোনো লাইসেন্স ফি নেই। সরকারি বিজ্ঞাপনের তালিকাভুক্তিসহ সব মিলিয়ে বার্ষিক নবায়ন খরচ ২০ হাজার টাকাও নয়। অথচ অনলাইন পত্রিকার জন্য ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকার আবেদন ফরম, লাইসেন্স ফি পাঁচ লাখ টাকা, দুই লাখ টাকা জামানত ও ৫০ হাজার টাকা বার্ষিক নবায়ন ফি। ছাপার মাধ্যমের অন্য অনেক খরচ বেশি বটে। তবে যোগ-বিয়োগ করেও এই প্রতিযোগিতা স্বাস্থ্যকর করে তোলা কঠিন।
বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ২০ শতাংশের বেশি প্রচার সময়ে বিজ্ঞাপনে ব্যয় করা যাবে না। অনলাইনের বিজ্ঞাপনের প্রযুক্তি যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে, তাতে এই সরল সমীকরণে বিজ্ঞাপন পরিচালনা প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া, বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে বিজ্ঞাপন নেওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু নতুন যুগের বিজ্ঞাপন আসছে বিজ্ঞাপন এগ্রিগেটর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রতিযোগিতার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রমেই বিজ্ঞাপন সংগ্রহের বিষয়টি আউট সোর্স করতে হবে।
এ ছাড়া কিছু আইনি নির্দেশনার কারণ স্পষ্ট নয়। দৈনিক ছাপা পত্রিকার জন্য একজন ব্যক্তি উদ্যোক্তা লাইসেন্স গ্রহণ করতে পারেন। সেখানে অনলাইনের জন্য কোম্পানি আইনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান বাধ্যতামূলক কেন?
দেশ হিসেবে শুধু আমরাই এ রকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছি না। ইন্টারনেট জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি দেশই এ রকম সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে। তবে বেশির ভাগ দেশই এ রকম নীতিমালার রাস্তায় হাঁটেনি। দু-একটি এমন উদ্যোগ থাকলেও সফলতা কম। তারা বরং মৌলিক আইনগুলোকে অনলাইনে প্রয়োগযোগ্য করেছে। কপিরাইট, ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় তথ্য নিরাপত্তা, সাক্ষ্য, প্রমাণ, প্রচার, প্রকাশনা, মানহানি—ধরনের আইনগুলোকে যুগোপযোগী করেছে। প্রয়োগের কারিগরি অবকাঠামো ও জনশক্তি উন্নত করেছে। অনলাইনের বিভিন্ন অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে দাপ্তরিক সম্পর্কের উন্নয়ন করেছে। বিভিন্ন ধরনের চুক্তির মাধ্যমে আইন প্রয়োগের পথ সুগম করেছে। সেটাই পরীক্ষিত ও সোজা রাস্তা। সেই উদাহরণগুলো মাথায় রেখে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর: তথ্যপ্রযুক্তি পরামর্শক।
contact@sufi-faৎuq.com

No comments

Powered by Blogger.