অনলাইন গণমাধ্যম-ডিজিটাল বাংলাদেশবিরোধী নীতিমালা কার স্বার্থে? by আবু সাঈদ খান

আজকের দুনিয়ায় শিক্ষা, গবেষণা ও তথ্য আদান-প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ইন্টারনেট। ইন্টারনেট বা ওয়েবের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট প্রকাশসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে সব অনলাইন প্রকাশনাই ব্যবসায়িক তাগিদ থেকে নয়।


লিটল ম্যাগাজিনের মতো অব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে সংবাদ পরিবেশন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিজ্ঞান, শিক্ষা, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, মতামত চর্চাসহ মানবিক চিন্তাচেতনা বিকাশের কাজও ওয়েবসাইটগুলোতে হচ্ছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও সমাজ অগ্রগতির প্রয়োজনে এসব কিছুতেই আজ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও বিকাশের জন্য সহায়তার হাত না বাড়িয়ে 'অনলাইন গণমাধ্যম পরিচালনা নীতিমালা ২০১২' নামে একটি নিয়ন্ত্রণের খাঁড়া তুলে ধরা হয়েছে। এটি মাধ্যমটিকে নির্মমভাবে নিয়ন্ত্রণের বিধি। নীতিমালা অনুযায়ী ৫ লাখ টাকা দিয়ে লাইসেন্স ফি এবং প্রতি বছর নবায়নের জন্য ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। অন্যদিকে অনলাইন গণমাধ্যমগুলোর ওপর সংশ্লিষ্ট আমলাদের খবরদারির ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে, যা অনলাইন গণমাধ্যম বিকাশের ক্ষেত্রে বড় হুমকি।
১২ সেপ্টেম্বর তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তথ্য সচিব পঠিত ওই বিধানে ৪। (ক)তে বলা হয়েছে, 'এই নীতিমালার অধীনে প্রদেয় লাইসেন্স ব্যতিরেকে কোনো প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনা করতে পারবে না।' লাইসেন্সের জন্য দুই লাখ টাকা আর্নেস্টমানি দিয়ে আবেদন করতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, মুদ্রিত সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম এবং বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়। সে ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের লাইসেন্স ফি প্রযোজ্য না হলে অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য কেন তা প্রযোজ্য হবে?
মূলধারার অনলাইন গণমাধ্যমগুলো এখনও বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে পারেনি। আবার অনেক গণমাধ্যম বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিতও হচ্ছে না। বিনিয়োগ, বিজ্ঞাপন বা অন্য কোনো উপায়ে আয়ের সুযোগ ছাড়াই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। মানবিক-চেতনা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গীকার থেকে নতুন প্রজন্মের অনেক মেধাবী তরুণ-তরুণী কাজ করছে।
অনলাইনে নতুন আঙ্গিকে লিটল ম্যাগাজিন, সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে। এই তরুণ উদ্যোক্তাদের পক্ষে এই অর্থ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রসহ বর্ণিত নিয়ম-কানুন মেনে লাইসেন্স পাওয়া কি আদৌ সম্ভব? আর সেটি চাপিয়ে দিলে তা হবে সাংস্কৃতিক বন্ধ্যত্ব তৈরির হীনপ্রচেষ্টা; যা মেনে নেওয়া যায় না।
এ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, এ স্লোগানে অনুপ্রাণিত হয়ে তরুণ প্রজন্ম ভোট দিয়ে তাদের বিজয়ী করেছে আর এখন সেই সরকারই যে অনলাইন গণমাধ্যম নীতি গ্রহণ করতে যাচ্ছে তা কার্যত ডিজিটাল নীতিবিরোধী পদক্ষেপ। নীতিমালার ২। (ক)তে_ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক সুরক্ষা, প্রশিক্ষণ, গণসচেতনতা ও বিনোদনের পরিসর বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ ও মূল্যবোধ গড়ে তোলায় এবং বিশ্বব্যাপী এসব বিষয় সম্প্রচারের অনলাইন গণমাধ্যম স্থাপনের জন্য লাইসেন্স ফির কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, এগুলো সবই রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। আর সেই কাজ যেসব অনলাইন গণমাধ্যম করবে, সেগুলোতে সহায়তা দেওয়া সরকারের কর্তব্য, দণ্ড বা বাধা সৃষ্টি নয়।
বিকাশমান এই গণমাধ্যমটিকে আমলাদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ অবিবেচনাপ্রসূত এবং উন্নয়নবিরোধী। অর্থ দিয়ে এবং আনুগত্য প্রকাশ করে লাইসেন্স নিতে হবে। আনুগত্য প্রকাশে ব্যত্যয় হলে লাইসেন্স রক্ষা করা যাবে না। এর বাইরেও রয়েছে বিটিআরসির শর্ত। সেগুলোর ভেতরে কী আছে, তা আমার জানা নেই। সেগুলো ভঙ্গ হলেও উপায় নেই। লাইসেন্স বাতিল ও স্থগিত করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। যারা অনলাইনে লেখালেখি করছেন, ছোটখাটো গণমাধ্যম গড়ে তুলতে চাইছেন, তাদের এখন আমলাতন্ত্রের হাইকোর্ট দেখতে হবে।
নীতিমালার ১৩। (ক)তে বলা হয়েছে, 'অনলাইন গণমাধ্যম দেশি-বিদেশি ধারণকৃত অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারবে। তবে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সেন্সর নীতিমালা সম্পূর্ণভাবে অনুসৃত হবে। কোনো অবস্থাতেই বিদেশি অনলাইন গণমাধ্যম সংবাদ, পর্যালোচনা, টক শো, আলোচনা, সম্পাদকীয় এবং সমসাময়িক ঘটনাবলি নিয়ে অনুষ্ঠান ও মন্তব্য সরাসরি সম্প্রচার ও ধারণকৃত যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না।' আর ১১। (ঞ)তে বলা হয়েছে, 'অনলাইন গণমাধ্যমে অন্য কোনো দেশি বা বিদেশি গণমাধ্যমের লিংক করা যাবে না।' আমি জানি না, এই খসড়া প্রস্তুতকারীদের গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, তথ্য অধিকার সম্পর্কে আদৌ কোনো ধারণা আছে কি-না! তবে এটি নিশ্চিত অনলাইন গণমাধ্যম সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। উল্লেখ্য, বিদেশি সংবাদের প্রধান উৎস বিদেশি গণমাধ্যম। পৃথিবীর সব দেশের গণমাধ্যম সংবাদ আদান-প্রদান করে নতুন বিশ্ব গড়ার সংগ্রামে সহায়তা করছে। আর আমরা বিদেশি সংবাদ, টক শো, সম্পাদকীয় ইত্যাদি থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখব? আর লিংক দেওয়া অনলাইনের আবশ্যিক অংশ, তা কি আটকে রাখা যায়? এমন সিদ্ধান্ত তালেবানি কোনো রাষ্ট্রও দেবে কি-না, সন্দেহ।
১৩। (গ)তে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসের অনুষ্ঠানাদি (ঘ)তে সরকারের প্রেসনোট ও বিজ্ঞপ্তি প্রচারের বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। এসব কি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্তের আদৌ প্রয়োজন আছে? অনলাইন সংবাদপত্র নিজেদের গরজেই তা প্রচার করবে। তবে সেই সঙ্গে সরকারের নীতির সমালোচনা, কার্টুনসহ ব্যঙ্গাত্মক রচনাও প্রকাশ করার অধিকার তাদের রয়েছে। তা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। কিন্তু ১৪। (ঙ)তে আছে, 'অশালীন বা আক্রমণাত্মক কোনো রসিকতা/গান/বিজ্ঞাপন/সংবাদ বা সাবটাইটেল সংবলিত কোনো অনুষ্ঠান, যা জনগণের নৈতিকতাকে কলুষিত, দুর্নীতিগ্রস্ত বা আহত করতে পারে_ এমন সংবাদ বা অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না।' কে ঠিক করবে কোনটা শালীন বা অশালীন, আমলাগোষ্ঠী না পাঠক, এটি মৌলিক প্রশ্ন। আর গানে-কবিতায় আক্রমণ থাকলে তা প্রকাশ করা যদি নীতিবিরুদ্ধ হয়, তবে নজরুল, সুকান্তের কবিতা-গান উচ্চারণ করা যাবে না। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছে মৌলিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও সদাচার পরিপন্থী উপাদান (১৪। ঝ-এ বর্ণিত)। মৌলিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বলতে কী বোঝা যায়, নীতিমালার প্রণেতারা ব্যাখ্যা দেবেন কি? বন্ধুপ্রতিম দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে ক্ষতিকর কিছু রয়েছে এমন কোনো সংবাদ অনুষ্ঠান প্রচারেও নিষেধাজ্ঞা (১৪। (ট)। এটি বোধগম্য নয়। কেউ যদি এই নিষেধাজ্ঞার আলোকে ব্যাখ্যা করে বলেন, সীমান্তে বিএসএফের হামলার প্রতিবাদ, তিস্তার পানি চুক্তিতে গড়িমসির জন্য ভারতের সমালোচনা করা যাবে না, তবে সেটি কি মানতে হবে? একই যুক্তিতে যদি বলা হয়, মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী তেল-গ্যাস উত্তোলন চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যাবে না। তা কি সমর্থনযোগ্য?
১৪। (খ)তে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং রাষ্ট্রীয় নীতির পরিপন্থী কোনো সংবাদ/অনুষ্ঠানের নিষেধাজ্ঞার কথা রয়েছে। এখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বিধান রয়েছে। কিন্তু একাত্তরের চেতনা সমুন্নত করতে এই বিধানের বিরুদ্ধে কথা বলা ও লেখা নৈতিক দায়িত্ব। এ নীতিমালা দিয়ে সেই দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হবে, তা হতে পারে না।
এই বিধিমালায় ১১। (ঝ)তে বাংলাদেশে স্থাপিত সার্ভারে হোস্টিংয়ের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে এই সুযোগ কতটুকু? সামান্য ডোমেইন সেবাও বিটিআরসি সঠিকভাবে দিতে পারছে না। ডটকম.বিডি ডোমেইন সম্পর্কে যাদের ধারণা রয়েছে, তারাই বলতে পারবেন কেবল দেশীয় সার্ভারে মাধ্যমগুলো হোস্টিংয়ের প্রস্তাব কতটুকু বাস্তবসম্মত?
এমন কড়াকড়ি আরোপ করলে দেখা যাবে, বাংলা ভাষার বা বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো সব নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিঙ্গাপুর, হংকং প্রভৃতি স্থান থেকে বের হচ্ছে। তখন সরকার তা কী করে ঠেকাবে?
সবকিছু মিলে এটি একটি গোলমেলে নীতিমালা। অপ্রয়োজনীয়ও বটে। এটি না করে বরং অনলাইন মাধ্যমকে বিকশিত করার প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবতে পারে, সেটিই প্রত্যাশিত। বড়জোর নিয়মিত ও পেশাদার অনলাইন সংবাদপত্রের জন্য মুদ্রিত সংবাদপত্রের মতো ডিক্লারেশনের বিধান থাকতে পারে। অপেশাদার ও ছোট অনলাইন সংবাদপত্র, ব্লগ, সাময়িকীসহ যেসব প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক চর্চায় নিবেদিত, যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিক্লারেশনের আওতামুক্ত রাখার বিকল্প নেই।
প্রশ্ন উঠতে পারে, অনলাইন মাধ্যম কি আয়করমুক্ত থাকবে? না, সেটি বলছি না। আয়কর বিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্যই আয়কর-ভ্যাট দেবে; তবে তা শৌখিন বা পরীক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য মোটেই প্রযোজ্য নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া যত গুটিয়ে রাখা যায়, ততই তা দেশের গণতন্ত্রের আবহের জন্য উপযোগী।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.