খসড়া আইন মন্ত্রিসভায় উঠছে আজ- নামমাত্র শাস্তির বিধান রেখে এমএলএম আইন হচ্ছে by ফখরুল ইসলাম

গণপ্রতারণা ও জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত হলে অপরাধীদের জন্য নামমাত্র শাস্তির বিধান রেখে বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। যত বড় জালিয়াতিই হোক না কেন বা যত বেশি মানুষের সঙ্গেই প্রতারণা করা হোক না কেন, আইনের খসড়ায় সর্বোচ্চ জরিমানা ৫০ লাখ টাকার কথা বলা হয়েছে।


আর জেল হবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের।
ডাইরেক্ট সেল আইন, ২০১২ নামের এই আইনের খসড়া তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ৩০ আগস্ট তারা তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে। আজ সোমবার খসড়া আইনটি নীতিগত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপিত হওয়ার কথা রয়েছে। ১৪টি অধ্যায়, ৪৮টি ধারা ও দুটি তফসিল মিলিয়ে এই খসড়া আইন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত অনুযায়ী, আলোচিত ডেসটিনি গ্রুপ অধিক মুনাফার কথা বলে প্রায় অর্ধকোটি মানুষের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করে। যে অর্থের প্রায় পুরোটাই তুলে নিয়েছেন গ্রুপের পরিচালকেরা।
সাড়ে ছয় লাখ সাধারণ মানুষকে স্বর্ণের ব্যবসা করে অধিক মুনাফা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ইউনিপেটুইউ বিডি লিমিটেড সংগ্রহ করেছে এক হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৩১ কোটি টাকা তুলে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। ইউনিগেটওয়েটুইউ ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেড প্রতারণার মাধ্যমে ২৯ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। ইউনি রুট ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স লিমিটেড নামের আরেক এমএলএম কোম্পানি অল্প সময়ে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে ১৬ কোটি তিন লাখ টাকা সংগ্রহ করে। চট্টগ্রামের মা পলিকম লিমিটেডও একই কথা বলে সংগ্রহ করে ৩৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খসড়া আইনে ৫০ লাখ টাকা জরিমানার যে সুপারিশ করা হয়েছে তাতে এ ধরনের ব্যবসা ঠেকানো যাবে না। তাঁরা জরিমানার পরিমাণ আরও বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন।
খসড়া আইনের ১২ থেকে ২৯, অর্থাৎ মোট ১৮টি ধারায় শাস্তি সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। খসড়া অনুযায়ী, আইন লঙ্ঘনকারীদের জেল খাটতে হবে তিন থেকে পাঁচ বছর। লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসার জন্য সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা ও তিন থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া ব্যবসা করলে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ থেকে ১২ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। নির্দিষ্ট পণ্য ছাড়া অন্য পণ্যের ব্যবসা করলে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা ও তিন থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, মোড়কবিহীন পণ্যের ব্যবসা করলে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা ও এক-দুই বছরের কারাদণ্ড, পরিবেশকদের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ও এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ডের শাস্তি প্রস্তাব করা হয়েছে আইনে।
যোগাযোগ করলে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহ্দীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্নীতি মামলার দর্শনটা হলো, কোনো ভুক্তভোগী যত টাকার ক্ষতির শিকার হলেন, অন্তত তত টাকা যাতে তিনি ফেরত পান। তবে জরিমানার টাকা ক্ষতির পরিমাণের তিন গুণও হতে পারে।’ তিনি বলেন, তার চেয়েও বড় কথা হলো, জরিমানার টাকা ভুক্তভোগী পাবেন, না সরকার পাবে?’ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জরিমানার টাকা জমা হলে নাগরিক কী বিচার পেল?—প্রশ্ন শাহ্দীন মালিকের। তিনি বলেন, প্রতারণার শিকার হলেও ভুক্তভোগীর টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো ধারা না থাকা মানে তা সংশ্লিষ্ট আইনের দুর্বল দিক।
শাহ্দীন মালিক আরও বলেন, ‘জমিসংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দাদার মামলা নাতি চালাচ্ছে। কারণ, মামলা শেষে কিছু তো পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতারণার মামলায় সাক্ষীই পাওয়া যায় না। এ ছাড়া ভুক্তভোগীর ক্ষতিপূরণের সম্ভাবনাও কম থাকে।’ আইন প্রণয়নের সময় এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
উচ্চ মুনাফার লোভ দেখানো যাবে না: খসড়ার সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ‘এমএলএম কোম্পানির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে দেশে কোনো আইন নেই। কোম্পানি আইনে নিবন্ধন নিয়ে বা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে এ ব্যবসা করা হচ্ছে। এরা কখনো উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করছে জনগণকে। আবার কখনো অলীক পণ্য বিপণনে অস্বাভাবিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে আসছে।’ এই কাজ আর করা যাবে না বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়।
এমএলএম ব্যবসাকে ‘দ্রুত বিকাশমান’ উল্লেখ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, এই আইন পাস হলে দেশের এমএলএম কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে।
আইনের চতুর্থ অধ্যায়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, কিছু ক্ষেত্রে এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসা নিষিদ্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, পিরামিডসদৃশ বিক্রয় কার্যক্রম করা যাবে না। অবস্তুগত বা অলীক পণ্য এবং সময়ের ধারাবাহিকতা বা পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিপণনযোগ্য হবে—এমন পণ্য বা সেবা নিয়েও ব্যবসা করা যাবে না। ফলে এই আইন পাস হলে ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ, নিউওয়ে, এমওয়ে ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
তবে এ আইন কে বাস্তবায়ন করবে তা এখনো ঠিক হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চায়, এমএলএম কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি পরিদপ্তর গঠন করা হোক। অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ গঠনের পক্ষে। আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, পরিদপ্তর বা কর্তৃপক্ষ আইন দিয়ে সৃষ্টি করা যায় না, বরং আইন প্রণয়নের পর তার উদ্দেশ্য পূরণে সরকার কোনো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে পারে বা কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে পারে।
আইন লঙ্ঘন হলে লাইসেন্স বাতিল: যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তর (রেজসকো) থেকে বিদ্যমান ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের আওতায় লাইসেন্স ও নিবন্ধন নেওয়ার কথা আইনে বলা হয়েছে। তবে আইন যথাযথভাবে পরিপালিত না হলে যেকোনো সময় লাইসেন্স বাতিল করা যাবে।
লাইসেন্স পাওয়ার জন্য নামের ছাড়পত্র, সংঘবিধি ও সংঘস্মারক, পণ্যতালিকা, ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি এবং কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের সমপরিমাণ অর্থের ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে আবেদন করতে হবে। কাগজপত্র যাচাই করে ২৫ দিনের মধ্যে প্রয়োজনে শুনানি গ্রহণ করে লাইসেন্স দেওয়া হবে।
কী কী পণ্যের ব্যবসা করা যাবে: এমএলএম পদ্ধতিতে যেসব পণ্যের ব্যবসা করা যাবে, তার একটি তালিকা আইনের দ্বিতীয় তফসিলে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে: গৃহস্থালি, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক, হোম এপ্লায়েন্স, প্রসাধন ও টয়লেট্রিজ, হারবাল, টেলিমার্কেটিং, কৃষিজ ও কৃষিজাত, টেলিকমিউনিকেশন সেবা বা ব্যবহারযোগ্য পণ্য এবং প্রশিক্ষণসংক্রান্ত সেবা ও পণ্য। তবে চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, এই তালিকা কমানো-বাড়ানোর এখতিয়ার সরকারের হাতে থাকবে।
লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হলেও কোনো কোম্পানি যদি কার্যক্রম অব্যাহত রাখে, তাহলে দায়ী ব্যক্তিদের পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়, শুধু বাজেয়াপ্ত কোম্পানি নয়, বরং লাইসেন্সবিহীন কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত কার্যক্রমকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
মতামত চাইলে ছয় মাস আগেই অর্থ বিভাগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, সরাসরি বিক্রয়ের প্রস্তাবিত সংজ্ঞাটি অনেক জটিল বলে তা সহজ করা দরকার। কিন্তু চূড়ান্ত খসড়ায় ওই সংজ্ঞাটিই রয়ে গেছে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের পর এই খসড়া আইন যাচাই-বাছাইয়ের (ভেটিং) জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তারপর তা উপস্থাপন করা হবে জাতীয় সংসদে।

No comments

Powered by Blogger.