আন্তর্জাতিক-মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা ও দক্ষিণ এশিয়া by জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী

ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপালসহ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশ আফগানিস্তান, মালদ্বীপ ও ভুটানেরও লোকজন মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে। তাদের দেশেও ঘনিষ্ঠরা এমনিভাবে উৎকণ্ঠিত। তবে এ মানবিক অবস্থার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়টিও সর্বাগ্রেই স্বাভাবিকভাবে চলে আসে


দক্ষিণ এশিয়া প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অশান্ত পরিস্থিতির ফলে এবং বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের প্রায় সব দেশেই এ অবস্থার বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও এ পর্যন্ত লিবিয়া ছাড়া অন্য অস্থির দেশগুলো সেভাবে তেলসমৃদ্ধ বড় দেশ নয় এবং অন্যান্য দেশ থেকে বড় মাত্রায় জনশক্তি আমদানি করে না, তথাপি মধ্যপ্রাচ্য সামগ্রিকভাবেই এ অবস্থায় উৎকণ্ঠিত। অস্থিরতার প্রবণতা এবং গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবিতে উত্তাল ঢেউ কখন কার তীরে আঘাত হানে বলা কঠিন। ছোট দেশ তিউনিসিয়ায় যে গণবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়, সেটা বিভিন্ন দেশকেই গ্রাস করছে। যেসব বড় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ দেশে এখনও এ অবস্থার প্রভাব পড়েনি, যেমন_ সৌদি আরব, সংযুক্ত আমির শাহী কিংবা কাতার, সেখানেও যে অন্যান্য আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশে ঘটনাপ্রবাহ গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এ পর্যন্ত এসব দেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে, যদিও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কারণে তারাও কম উৎকণ্ঠিত নয়।
এ পর্যন্ত দুটি বড় দেশ প্রচণ্ডভাবে গণবিক্ষোভে দারুণভাবে প্রকম্পিত হয়েছে। মিসরে ৩০ বছরের শাসক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়ে রাজধানী কায়রো ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও তার বিরোধীদের মধ্যে চলছে গৃহযুদ্ধ; চলছে ন্যাটোর নেতৃত্বে হামলা। স্বীয় জনগণের ওপর সেনাবাহিনীকে দিয়ে আক্রমণ করাচ্ছেন এবং জাতিসংঘ এ পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করে অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি দেশে আলজেরিয়া, বাহরাইন, ইয়েমেন ও জর্ডানে অস্থিরতা এবং অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। তবে লিবিয়ার পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি তোলপাড় করছে দেশটির গুরুত্ব ও কঠোর দমননীতির কারণে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহ সত্যিকার অর্থে বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোতে চরম উদ্বেগ ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি করছে। যেহেতু এশিয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোরই জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং সে কারণে তাদের জনগণের সংখ্যা মধ্যপ্রাচ্যে অনেক বেশি, তাই অর্থনৈতিকভাবে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে এসব দেশ। বাংলাদেশসহ আরও সাতটি সার্কভুক্ত দেশই এ অবস্থার শিকার এবং আগামী দিনগুলোতে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশেরই বেশ কয়েক লাখ জনশক্তি রয়েছে। সেখানে এরই মধ্যে অনেক বিদেশি শ্রমিক ও কর্মকর্তা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন এবং এদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশিও আছেন। তাদের নিরাপত্তাই সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। দেশে তাদের ঘনিষ্ঠরা উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপালসহ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশ আফগানিস্তান, মালদ্বীপ ও ভুটানেরও লোকজন মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে। তাদের দেশেও ঘনিষ্ঠরা এমনিভাবে উৎকণ্ঠিত। তবে এ মানবিক অবস্থার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়টিও সর্বাগ্রেই স্বাভাবিকভাবে চলে আসে। শারীরিক নিরাপত্তার পাশাপাশি এসব মানুষের জীবিকার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন চাকরিজীবীর ওপর পরিবারের অনেকেই নির্ভরশীল।
অনেক উন্নত দেশেরও জনশক্তি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রয়েছে। বিশেষ করে তেল ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান আছে। তারা বেশিরভাগই উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য এসব দেশ পর্যাপ্ত কর্মসূচি নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো সেভাবে এমনি ব্যবস্থা করতে পারছে না তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে। এখানে আর্থিক এবং অন্যান্য বিষয় জড়িত। তাই এসব উন্নয়নশীল কিংবা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জনগণ মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত দেশগুলো থেকে কীভাবে এবং কখন ফিরতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। অবশ্য এসব দেশের সরকারগুলো বলছে, তারা এ লক্ষ্যে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা তাদের কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে_ সন্দেহ নেই। তবে অর্থনৈতিক দিকটি অনেক শঙ্কার কারণ। মধ্যপ্রাচ্যের তেলক্ষেত্রেই অধিকাংশ বিদেশির কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। অশান্ত পরিস্থিতির কারণে অনেক কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে এবং আগামীতে এ অবস্থার আরও অবনতি হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। ফলে চাকরির পরিসরও আরও সংকুচিত হয়ে আসবে সন্দেহাতীতভাবে এবং প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়বে জনশক্তি রফতানিকারক দেশগুলো। এশিয়া, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকেই এ প্রতিকূল পরিস্থিতির ভার বেশি করে বহন করতে হবে। দেশগুলোর অর্থনীতিতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
তবে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে সৌদি আরব এখনও স্বাভাবিক থাকায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর উৎকণ্ঠা কিছুটা কম। কেননা বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি জনশক্তি রয়েছে এই সৌদি আরবে_ প্রায় ২০ লাখের মতো। অন্যান্য দেশ যেমন_ কাতার ও সংযুক্ত আরব শাহীতেও প্রচুর মানুষ রয়েছে। তবে এসব দেশে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি না হলেও আগামীতে কর্মসংস্থানের পরিধি সীমিত হয়ে যেতে পারে বলে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। কেননা প্রতিকূলতা তাদেরও যে একেবারেই স্পর্শ করছে না, তা নয়। সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ দীর্ঘদিন পর চিকিৎসা শেষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে জনগণকে আরও বেশি সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন। স্পষ্টত প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ যাতে না হয়, সেদিকেই এখন তাদের দৃষ্টি। তবে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অবস্থা উন্নয়নশীল এশীয় দেশগুলোকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী :আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
 

No comments

Powered by Blogger.