গোটা রাজধানী এখন ঈদ মার্কেট, দৈনিক বিক্রি হাজার কোটি ॥ ঈদ বাজার -সব ভোগান্তি থোড়াই কেয়ার, প্রায় রাতভর কেনাকাটা by এম শাহজাহান

রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই গানের কলির সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে হয় আসলেও ঠিক তাই। ঈদ আসছে আনন্দ ও খুশির বার্তা নিয়ে। সারাদেশের প্রতিটি পবিবারের কাছে ঈদই এখন মুখ্য বিষয়। আর সব কিছু গৌণ! তাই তিনদিন বাকি থাকতে গোটা রাজধানী ঈদ মার্কেটে পরিণত হয়েছে।
চলছে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা।
বুধবার থেকে ছুটি শুরু হওয়ায় সবাই ব্যস্ত ঈদ উদ্্যাপন নিয়ে। কেউ কেনাকাটা করছে পোশাক সামগ্রী। কেউ ছুটে যাচ্ছে মাছ, মাংস ও নিত্যপণ্যের বাজারে। কিনছে দুধ, চিনি ও সেমাই। নিজের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে কেউবা ভিড় করছেন বিউটি পার্লার ও সেলুনে। নাড়ির টানে কেউবা ভাড়া গাড়ি বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে রওনা হচ্ছেন গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে। ফলে ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতিও এখন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন রাজধানীতেই গড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এছাড়া সারাদেশেও বিক্রির পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা।
ঈদকেন্দ্রিক এসব কর্মকা- সম্পন্ন করতে বিড়ম্বনা, ভোগান্তি এবং দুর্ভোগও আছে। যানজট, ভ্যাপসা গরম, কখনও বৃষ্টি এবং পরিবহন সঙ্কট থোথাই কেয়ার করে সবাই ছুটে যাচ্ছেন ঈদ মার্কেটে। সব কিছু তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে ঈদের আনন্দের কাছে। ঈদের আনন্দের কাছে সব দুঃখ-কষ্ট ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় খুশি ব্যবসায়ীরাও।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আমির হোসেন খান জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য জমে ওঠায় ব্যবসায়ীরা খুশি। প্রতিদিন রাজধানীতে বিক্রি হচ্ছে হাজার কোটি টাকার ওপরে। এছাড়া সারাদেশেও বিক্রিবাট্টার ভাল খবর পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, যাঁরা গ্রামের বাড়িতে ঈদ করবেন তাঁদের কেনাকাটা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন ঢাকায় যাঁরা ঈদ করবেন তাঁরা কেনাকাটা করছেন। সারাদেশের ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনার ৫০ ভাগ ঢাকায় হয়ে থাকে। তিনি বলেন, ব্যাংিকং খাতের আর্থিক লেনদেন থেকে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী নিউমার্কেট ও গাউছিয়াতেই রাজধানীবাসীর ঈদ কেনাকাটা সীমাবদ্ধ থাকছে না। হাল আমলে কেনাকাটার গ-ি রাজধানীর ৮টি পয়েন্টের প্রায় ২৫০টি মার্কেটে ছড়িয়ে পড়েছে। জমে উঠেছে রাজধানীর ফুটপাথের হকার্স মার্কেটও। গভীর রাত পর্যন্ত চলছে ঈদের বেচাকেনা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফুটপাথেও এবার ৬-৭ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে। এছাড়া মেগা শপিং সেন্টার, বিদেশী পোশাকের মার্কেট নয়াপল্টন জোন, মহিলাদের মার্কেট নিউমার্কেট ও গাউছিয়া, পুরনো ঢাকাবাসীর মার্কেট সদরঘাট জোন, নিম্নআয়ের মানুষের মার্কেট গুলিস্তান জোন, মধ্যবিত্তদের মার্কেট মালিবাগ-মৌচাক জোন, উচ্চবিত্তদের জন্য গুলশান-বারিধারা-বনানী জোন এবং নতুন মার্কেট জোন উত্তরাসহ পুরো রাজধানীর সবখানে এখন চলছে ঈদের কেনাকাটা।
জানা গেছে, মধ্যবিত্তদের কেনাকাটার জন্য মালিবাগ-মৌচাক জোন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মালিবাগ সুপার মার্কেট, মৌচাক, বিশাল সেন্টার, আনারকলি মার্কেট, কনকর্ড টুইন টাওয়ার, কর্ণফুলী গার্ডেন সিটিসহ বিভিন্ন মার্কেট রয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ এই মার্কেটে কেনাকাটা করছেন। কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির নীহারিকা স্টোরের স্বত্বাধিকারী এএসএম সালেহউদ্দিন শাহীন জনকণ্ঠকে বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ এই এলাকার মার্কেটগুলোতে শপিং করে থাকেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে গুরুত্ব দিয়ে ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের কসমেটিক্স, জুয়েলারি, লেডিস পার্স, ঘড়ি এবং বিবাহ সামগ্রী দোকানে তোলা হয়েছে। ঈদ সামনে রেখে বেচাকেনা ভাল হচ্ছে। নিম্নআয়ের মানুষ ভিড় করছেন গুলিস্তান এলাকার মার্কেটগুলোতে। এখানকার বঙ্গবাজার, এনেক্সকো টাওয়ার, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, ফুলবাড়িয়া, রমনা ভবন, পীর ইয়েমেনী মার্কেট জমজমাট। ভোররাত পর্যন্ত চলছে কেনাকাটা। নিম্নআয়ের মানুষজন সাধারণত দিনের বেলা অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত থাকেন। তাঁরা রাতের বেলা বের হন শপিংয়ের উদ্দেশে। এসব মার্কেটে দেড় শ’ টাকা থেকে ৫শ’ টাকার মধ্যে পছন্দের অনেক পোশাক মিলবে। বঙ্গবাজারে সন্ধ্যার পর তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না।
পুরনো ঢাকার সদরঘাট জোনে ছোট বড় মিলিয়ে অর্ধ শতাধিক মার্কেট রয়েছে। বিশেষ করে নবাববাড়ি মার্কেট, সদরঘাট শরীফ মার্কেট, ইসলামপুর মার্কেট, আহসান মঞ্জিল মার্কেট, সাবেক চায়না মার্কেট ও উর্দুরোডে বিভিন্ন মার্কেট রয়েছে। শব-ই-বরাতের পর থেকে এসব মার্কেট পাইকারি বেচাকেনা করলেও এখন খুচরা বিক্রি বেড়েছে। পুরনো ঢাকার লোকজন ঈদের কেনাকাটার জন্য ভিড় করছেন এসব মার্কেটে। এছাড়া পুরনো ঢাকার র‌্যাংকিন স্ট্রীট রোডে বিভিন্ন দামী দামী ব্র্যান্ডের মেগাশপ গড়ে উঠেছে । সন্ধ্যার পর ওয়ারীর র‌্যাংকিন স্ট্রীটে পা ফেলার জায়গা থাকে না।
মহিলাদের প্রিয় মার্কেট গাউছিয়া, চাঁদনী চক, নিউমার্কেট, ধানম-ি হকার্সে এখন ভোররাত পর্যন্ত চলছে বেচাকেনা। ক্রেতাদের ভিড় এত বেশি যে, এখানে প্রবেশ করলে গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগবেই। তরুণ-তরুণী ও ছেলেমেয়েরা ভিড় করছে নিউ এলিফ্যান্ট রোডের শপিংমল ও মার্কেটগুলোতে। শার্ট-প্যান্ট, জুতো, বেল্ট, ঘড়ি, চশমা কিনতে হলে নিউ এলিফ্যান্ট রোডের মার্কেটগুলোতে ঢুঁ মারতে হবে। কারণ এখানে দেশী-বিদেশী সব ধরনের পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এখানকার মনসুর ভবনের ব্যবসায়ী আবুল হাশেম বলেন, তরুণদের পোশাকের জন্য নিউ এলিফ্যান্ট রোডের জুড়ি নেই। বিদেশী শার্ট-প্যান্ট, জিন্সের শার্ট-প্যান্ট, টি-শার্ট, জুতো-স্যান্ডেল, এমনিক দেশী অভিজাত ব্র্যান্ডগুলোর শো-রুম এখানে রয়েছে। ফলে যে কোন ক্রেতা এখানে এলেই তাঁর পছন্দের পোশাকটি কিনতে পারছেন। তিনি বলেন, রমজানের প্রথম সপ্তাহ থেকে এখানকার মার্কেটগুলো জমজমাট। তবে এখন বেচাবিক্রি সবচেয়ে বেশি। বিক্রেতাদের গভীর রাত পর্যন্ত দোকানপাট খোলা রাখতে হচ্ছে। তবে বেচাকেনা ভাল হওয়ার কারণে বিক্রেতাদের সব কষ্ট লাঘব হয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া হাল আমলে নয়াপল্টনে অনেক মার্কেট গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে বিদেশী পোশাকের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে পলওয়েল সুপার মার্কেট ও গাজী ভবন। এ দুটি মার্কেট পাইকারি মার্কেট হিসেবেও ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ দুই মার্কেটর উল্টো দিকে রয়েছে সিটি হার্ট ও জোনাকি সুপার মার্কেট। ঈদ সামনে রেখে প্রতিটি মার্কেটে ক্রেতাদের আনাগোনা বেড়েছে, বেড়েছে বিক্রিও। এখানকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত মার্কেটের প্রতিটি দোকান খোলা রাখা হবে। ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে ঈদের নামাজে শরিক হবেন। ওইদিন থেকে ৩-৪ দিন মার্কেট ছুটি ঘোষণা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.