চারদিক- ভুক লাগলে আমি কী করুম by ফারুক আহমেদ

থাকি ৯ নম্বর হাজি আবদুল মজিদ লেনের কলতাবাজার। পুরান ঢাকার সবই আমার নখদর্পণে। ইসলামিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। স্কুলটি কবি নজরুল ইসলাম কলেজের অংশ। আমার স্কুল থেকে বের হলেই পাঁচ রাস্তার মোড়। একেবারে কাছাকাছি বাহাদুর শাহ পার্ক, সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল, মুসলিম স্কুল আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


স্কুলের ঠিক পাশেই একটি প্রাচীন পানির ট্যাংক, তার পেছনে সুন্দর গড়নের সাদারঙা সেন্ট থমাস চার্চ। আমার প্রিয় জায়গা অবশ্য স্কুল থেকে একটু দূরে, ওয়ারীতে অবস্থিত বলধা গার্ডেন। সেখানে যাতায়াত আমার সেই ছেলেবেলায়, স্কুলে পড়ার সময়। বলধার সবকিছু আমার ঘরের আঙিনার চেয়ে বেশি পরিচিত। প্রায়ই আমি চলে যাই সেখানে, সকাল-সন্ধ্যা কোনো সময় বাদ নেই। সেদিন সন্ধ্যাবেলা খবর পেলাম নাইটকুইন ফুটেছে। চলে গেলাম। অবশ্য এখন রাস্তায় বের হওয়া একটু কঠিনই বটে। কখন ঝুপ-বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দেবে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এই মেঘ এই বৃষ্টি, অশান্ত নীলিমা।
তবে সেদিন সন্ধ্যায় মেঘ-বৃষ্টির বালাই ছিল না। বলধা গার্ডেনে এসে ছবি তুললাম রাতের রানির। এর একটি মাত্র গাছ এখানে। দুষপ্রাপ্য সে ক্যাকটাস প্রজাতির গাছটি লেডি অব দ্য নাইট নামে খ্যাত, যার পরিচয় ব্রহ্মকমল নামে। আমি সে ফুলের ছবি তুলে চলে যাই বাহাদুর শাহ পার্কে। সেখান থেকে রায়সাহেব বাজার যাওয়ার পথে একটি ১২-১৩ বছরের ছেলেকে দেখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। আমি মোটরবাইক দাঁড় করাই। ছেলেটি তখনো কেঁদে চলেছে। তার সারা গা ধুলো-ময়লায় মাখামাখি। পায়ে কিছু নেই, চুল উসকো-খুসকো। বয়সের তুলনায় সে একটু বেশি মোটা। সে কাঁদছে, এর মধ্যেই কেউ কেউ তার সঙ্গে দুষ্টুমি করে চলেছে। কেউ একজন তার গায়ে পানি ঢেলে দিতেই সে রেগেমেগে ইট হাতে ছুটে গেল তার দিকে। কিন্তু কিছুই হলো না। সে তার টিকিটিও ধরতে পারল না। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেটি একটু শান্ত হতে তার কাছে যাই। মোটরসাইকেলটি ডাবলস্ট্যান্ড করে বসে তাকে কাছে ডাকি। তখনো সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি এবার তার হাত ধরে টান দিই। বিষয়টা তার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। হকচকিত সে বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি তাকে মোটরসাইকেলে আমার পাশে বসতে বলি। এবার সে একটু ভয় পেল মনে হয়। তার পরই সে আমাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘আপনে কেঠা?’
আমি আমার বৃত্তান্ত বলি। তারপর তার হাতে ৩০টি টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলি, বিউটির শরবত নিয়ে এসো। কোনো কিছু না ভেবেই সে নিমেষে উধাও। যখন সে এল তখন তার হাতে দুইটা পলিব্যাগে বিউটির শরবত। একটি তাকে দিলাম, অন্যটি আমি নিয়ে স্ট্রোতে চুমুক লাগালাম।
মোহাম্মদ জুয়েল। ঢাকাইয়া। বাবার নাম মোহাম্মদ মাহবুব। নারিন্দা ভূতের গলির ভাড়া বাসায় থাকে। সে যখন খুব ছোট, তখন তার বাবা তাদের ফেলে চলে যায়। কোথায় গেছে কেউ জানে না, বেঁচে আছে কি না, তা-ও না। জুয়েলরা তিন ভাই, কোনো বোন নেই। সবাই বিভিন্ন দোকানে কাজ করে। আর তাদের মা স্থানীয় স্কুলের ছাত্রী আনা-নেওয়া করে। জুয়েল কাজ করে নবাবপুরের হার্ডওয়্যার সামগ্রীর দোকানে। বেতন ৬০০ টাকা সপ্তাহ। বেতনের বাইরে দোকানের মালিক তাকে ৪০ টাকা রোজ খেতে দেন। তা ছাড়া এমনি-সেমনি অনেক খাবারই খাওয়া হয় জুয়েলের। সে একটু পেটুক ধরনের। হাসতে হাসতেই সে আমাকে বলে, ‘খালি ভুক লাগে।’
একটু পর পর জুয়েলের খিদা লাগে। তার দোকানের মালিক আবার খুব ভালো, তাকে খাওয়ায়ে মজা পান। তিনি সারা দিন তাকে এটা-সেটা কিনে খাওয়ান। খাওয়াতে তাঁর মানা নেই। আর খাবার দিলে জুয়েলেরও না নেই, খেতেই থাকে। বেশি খায় বলেই মানুষজন তাকে খ্যাপায়। শরবত পান করতে করতে এত সব কথা হয়ে যায় জুয়েলের সঙ্গে। এবার সে আমাকে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা আপনেই কন, ভুক লাগলে আমি কী করুম! ইচ্ছা কইরা তো আর আমি ভুকরে ডাইকা আনি না।’ আমি জুয়েলের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকি।
এরপর সে কথায় কথায় তার স্বপ্নের কথা বলে। ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা করবে। ভাইদের পড়ালেখা করাবে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। পড়ালেখা করতে টাকা লাগে। সে টাকা তাদের ছিল না। পেটে ভাতই জুটত না একসময়। এখন খেয়ে-পরে দিন ভালোই চলে যায়। লেখাপড়া করবে কি না জানতে চাইলে তার উত্তর, ‘অহন আর পড়ালেখার কথা চিন্তা করি না। হুনেন, পড়ালেখা অহন হইব না! তারপর সে বলে, দেহেন, আমি মটকু দেইখা মাইনসে আমার লগে শয়তানি করে। পানি মাইরা শয়তানির কী মজা কন তো ভাই?’
আমি হাসি তার কথা শুনে। তারপর হঠাৎ সে আমার পাশ থেকে ছুট লাগায়। আসলে আমার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে কেউ একজন তার গায়ে আবার পানিভরা পলিথিনের ব্যাগ ছুড়ে মেরেছে। তাকে ধরার জন্যই জুয়েলের এই ছুট!
ফারুক আহমেদ
farukh.ahmed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.