সাদাসিধে কথা-মেডিকেল এবং অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা by মুহম্মদ জাফর ইকবাল

একটি ছেলে বা মেয়ের সারা জীবনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেওয়া হবে; কিন্তু সেই ছেলে বা মেয়েটি কখনও জানতে পারবে না কেন তার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে। যদি সেটা তাকে জানাতে হয় তাহলে আমাদের গ্রেডিং পদ্ধতি বাতিল করে আগের সেই নম্বরভিত্তিক ফলাফলে ফিরে যেতে হবে। আমরা কি সেটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি?


এই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মেডিকেলে সিট বণ্টন করা শুরু হলে সেটাকে নির্ভর করে কী কী দুর্নীতি এবং কী কী বাণিজ্য হতে পারে তা চিন্তা করে এখনই আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। যারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা এ সহজ বিষয়টি চিন্তা করেননি দেখে আমি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করছি


আমার অবস্থা অনেকটা বাঙালি হাসির গল্পের সেই নাপিতের মতো_ যতদিন সে ডাক্তারি বিদ্যা জানত না ততদিন নিদ্বর্িধায় তার ক্ষুর দিয়ে বড় বড় অপারেশন করে ফেলেছে। যখন ডাক্তারি বিদ্যা জেনেছে তখন সে আর কিছুই করতে পারে না। আমিও এক সময় নিদ্বর্িধায় আমার ভালো লাগা-মন্দ লাগার বিষয়গুলো জোর করে সবাইকে শুনিয়েছি, এখন কিছু লিখতে হলে অনেকবার চিন্তা করি, বিষয়টা ঠিক হচ্ছে কি-না সেটা নিয়ে দুর্ভাবনায় থাকি।
মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে অসংখ্য মানুষ যোগাযোগ করেছে, সবাই তার নিজের পছন্দের বিষয়টি আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমি কিছু না বলে সবার কথা শুনে গিয়েছি_ কয়দিন থেকে মনে হচ্ছে আমার নিজের ভাবনাগুলো হয়তো অন্যদের জানানো উচিত, যারা সিদ্ধান্ত নেবেন তাদের হয়তো কিছু বিষয় জানা দরকার।
বাংলাদেশ থেকে যদি সত্যি সত্যি ভর্তি পরীক্ষার মতো বিষয়টি তুলে দেওয়া যেত তাহলে আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবে বলে মনে হয় না। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আমরা ছেলেমেয়েদের ভর্তি পরীক্ষার নাম দিয়ে যে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাই, সারা পৃথিবীতে সে রকম কোনো উদাহরণ নেই। এইচএসসি পরীক্ষা একটি বড় পরীক্ষা, সেটা দিতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের অনেক রকম চাপ সহ্য করতে হয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো নিষ্ঠুর কোনো সংগঠন নেই, তারা এইচএসসি পরীক্ষার মাঝখানে অবলীলায় হরতাল ডেকে এই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর সেই চাপ একশ' গুণ বাড়িয়ে দেয় এবং বিশাল অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমাদের সবার দায়িত্ব এই ছেলেমেয়েগুলোকে কিছুদিনের জন্য হলেও একটু বিশ্রাম এবং স্বস্তিতে থাকতে দেওয়া। কিন্তু তারা এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নিতে পারে না, পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকেই তাদের ভর্তি কোচিং শুরু হয়ে যায়। দেশে বিশাল বিশাল কোচিং সেন্টার তৈরি হয়েছে, মাফিয়া থেকেও তারা বেশি ক্ষমতাশালী, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তারা বের করে ফেলে, পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে গোপনে সারা রাত পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করিয়ে পরদিন পরীক্ষা দিতে নিয়ে যায়। কোনো এক বছর আমি অনেক চেঁচামেচি করেছিলাম, কোনো লাভ হয়নি।
কোচিং সেন্টার যদি প্রশ্ন বের করতে না-ও পারে, তারা এই ছেলেমেয়েগুলোকে যেভাবে প্রস্তুত করে শিক্ষার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। পত্র-পত্রিকায় তারা যেভাবে বিজ্ঞাপন দেয় সেটি দেখে আমার গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে ফেলার ইচ্ছা করে। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এ দেশের প্রায় সব ছেলেমেয়ে পরীক্ষার পরদিন থেকে এই কোচিং শুরু করে দেয়। যারা মফস্বল বা গ্রামে থাকে তাদের শহরে এসে বাসা ভাড়া করে, হোস্টেলে থেকে, মেসে থেকে এই কোচিং করতে হয়। এর চেয়ে অমানবিক কোনো ব্যাপার হতে পারে বলে আমার জানা নেই।
অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা থেকে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার একটা বড় পার্থক্য আছে, সেটি হচ্ছে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সব সময়ই এ বছরের পরীক্ষার্থী থেকে গত বছরের পরীক্ষার্থীরা বেশি ভর্তি হয়। তার কারণটি বুঝতে কাউকে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। কারণটি খুবই সহজ, যারা গত বছর এইচএসসি পাস করেছে তারা ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করার জন্য সময় পায় এক বছরের চেয়ে বেশি। এ বছরের ছেলেমেয়েরা সে তুলনায় সময় পায় মাত্র কয়েক মাস। যে প্রক্রিয়ায় নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে অনিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ বেশি, সেটি কোনোভাবেই সঠিক প্রক্রিয়া নয়। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন যারা দেখেছে তারা সবাই জানে এ প্রশ্ন দিয়ে আসলে মেধাবী-সৃজনশীল ছেলেমেয়ে খুঁজে বের করা হয় না, কে কত বেশি তথ্য মুখস্থ করে রাখতে পারে সেটা খুঁজে বের করা হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, যারা বেশি মুখস্থ করতে পারে তাদের খুঁজে বের করে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হলে সৃজনশীল অনেক ছেলেমেয়ে, যারা মুখস্থ করতে চায় না তাদের প্রতি এক ধরনের অবিচার করা হয়। কোনো পরীক্ষা না নিয়ে শুধু লটারি করে কিছু ছেলেমেয়েকে বেছে নিলেও এক ধরনের অবিচার হয়_ কোনটি বেশি বড় অবিচার আমি সেটা নিয়ে নিশ্চিত নই।
কাজেই আমি যখন শুনতে পেয়েছিলাম ভর্তি পরীক্ষার নামে এই নৃশংস প্রক্রিয়াটি উঠে যাচ্ছে, আমি তখন খুব খুশি হয়েছিলাম। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত খুব উচ্চ পর্যায়ের একজন মানুষ যখন এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছি। আমার শুধু একটি প্রশ্ন, এসএসসি এবং এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে এ রকম পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজারের কাছাকাছি। তাদের ভেতর থেকে দুই হাজার ছেলেমেয়ে কেমন করে আলাদা করা হবে? তখন আমি জানতে পারলাম, যদিও এ দেশে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় নম্বর তুলে দিয়ে গ্রেড পদ্ধতি করা হয়েছে; কিন্তু সেই নম্বরগুলো কোনো এক গোপন জায়গায় রাখা থাকে। সেই গোপন নম্বরগুলো গোপনে ব্যবহার করে খুবই গোপনে কিছু ছেলেমেয়েকে বেছে নেওয়া হবে। শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দুর্বলভাবে বলার চেষ্টা করলাম, যখন আমরা এ দেশের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল নম্বরভিত্তিক না করে গ্রেডভিত্তিক করে ফেলেছি তখন আমাদের আর সেই নম্বর ব্যবহার করার কোনো অধিকার নেই। যদি সেই নম্বর ব্যবহার করে একটি ছেলে বা মেয়েকে যাচাই করতে চাই তাহলে সবার আগে সেই নম্বরটি সবার মাঝে প্রকাশ করে দিতে হবে। আমাদের পাশের দেশ ভারতও একাধিকবার এ নম্বরগুলো ব্যবহার করতে চেয়েছিল, সে দেশের আইন তাদের অনুমতি দেয়নি। আমাদের কে অনুমতি দেবে?
কেন বিষয়টি করা যাবে না সেটি খুবই স্পষ্ট। ধরা যাক, দু'জন ছেলে বা মেয়ে, দু'জনেরই এসএসসি এবং এইচএসসিতে জিপিএ ৫, দু'জনই মেডিকেলে ভর্তির জন্য আবেদন করেছে। দেখা গেল, একজন সুযোগ পেয়েছে, অন্যজন পায়নি, যে পায়নি সে ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইবে কেন সে পায়নি। তখন তাকে বলা হবে, যদিও তুমি জিপিএ ৫ পেয়েছ কিন্তু পরীক্ষায় তুমি কম নম্বর পেয়েছ। তখন ছেলেটি বা মেয়েটি বলবে, হতেই পারে না, আমাকে দেখাও যে আমি পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েছি। দায়িত্বপ্রাপ্তরা তখন সম্ভবত দাঁত বের করে হেসে বলবেন, সেটা দেখানো যাবে না, সেটা গোপন!
এর চেয়ে বড় অস্বচ্ছ কাজ পৃথিবীতে আর কী হতে পারে? একটি ছেলে বা মেয়ের সারা জীবনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেওয়া হবে; কিন্তু সেই ছেলে বা মেয়েটি কখনও জানতে পারবে না কেন তার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে। যদি সেটা তাকে জানাতে হয় তাহলে আমাদের গ্রেডিং পদ্ধতি বাতিল করে আগের সেই নম্বরভিত্তিক ফলাফলে ফিরে যেতে হবে। আমরা কি সেটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি? এই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মেডিকেলে সিট বণ্টন করা শুরু হলে সেটাকে নির্ভর করে কী কী দুর্নীতি এবং কী কী বাণিজ্য হতে পারে তা চিন্তা করে এখনই আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। যারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা এ সহজ বিষয়টি চিন্তা করেননি দেখে আমি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করছি।
আমি বিশ্বাস করি, ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে মেডিকেল (বা অন্য কোথাও) পড়ার সুযোগ করে দেওয়া একটি অত্যন্ত চমৎকার ব্যাপার। কিন্তু এ চমৎকার ব্যাপারটি যদি করা হয় খুব অস্বচ্ছভাবে তাহলে এটি কিন্তু খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আমি প্রায় সময়ই বলে থাকি দুধ শিশুদের জন্য খুব চমৎকার খাবার; কিন্তু একটা দুধের ড্রামের মধ্যে একটা শিশুকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হলে সে শিশুটি কিন্তু দুধের মধ্যেই ডুবে মারা যাবে। এখানেও তাই, ভর্তি পরীক্ষা না নেওয়ার চমৎকার বিষয়টা করতে হবে সঠিকভাবে, যেন এখানে কেউ ডুবে না যায়।
২.
ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে শুধু এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে একটা ছেলে বা মেয়েকে বেছে নেওয়া কতটুকু যৌক্তিক? প্রশ্নটা একটু জটিল। কারণ ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র যদি মানসম্মত হয় তাহলে তার উত্তর হবে এক রকম আর প্রশ্নপত্র যদি খুব নিম্নমানের হয় তাহলে তার উত্তর হবে অন্যরকম। গত বছর হাইকোর্ট থেকে আমাকে ডাকার কারণে আমি আবিষ্কার করেছি, এ দেশে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ও শুধু গাইড বই থেকে প্রশ্ন নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র করে ফেলতে পারে! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা খুব যত্ন করে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করার চেষ্টা করি এবং যারা শুনতে রাজি আছে তাদের বলার চেষ্টা করি, ভালো ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কারও কোনো কোচিং সেন্টারে যেতে হবে না, কোনো গাইড বইও মুখস্থ করতে হবে না। আমাদের ডাটাবেজের গত তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি এসএসসি এবং এইচএসসিতে খুব ভালো গ্রেড নেই; কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় শতকরা ৫০ জন। এটি অনেক বড় সংখ্যা, যার অর্থ আমাদের পাবলিক পরীক্ষা এখনও একটা ছেলে বা মেয়েকে সঠিকভাবে যাচাই করতে পারছে না এবং শুধু এসএসসি এবং এইচএসসির ফলাফল দেখে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করে নেওয়া হলে শতকরা ৫০ জন ছাত্রছাত্রীর ওপর অবিচার করা হবে।
৩.
মেডিকেল পরীক্ষা নিয়ে দেশে একটু উত্তেজনা হচ্ছে, দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কোনো উত্তেজনা নেই। এটি আমার কাছে রহস্যের মতো। এ দেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়। শিক্ষার্থীরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পরীক্ষা দিতে পারে না। এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েই না খেয়ে, না ঘুমিয়ে সারারাত বাসে বা ট্রেনে করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে যায়, অপরিচিত শহরে বিশ্রাম নেওয়া দূরে থাকুক, বাথরুমে যাওয়ার পর্যন্ত কোনো জায়গা নেই। সেভাবে দেশের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় এই অসহায় ছেলেমেয়েগুলো তাদের বাবা-মায়েদের নিয়ে ছুটে বেড়ায়। একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এই ছেলেমেয়েদের বিশাল একটা অঙ্কের টাকা খরচ হয়, কাজেই যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত তাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষমতাও থাকে না, কাজেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগও কমে আসে। ঘুরেফিরে পড়াশোনার সুযোগটা আবার সেই বিত্তশালী মানুষের ছেলেমেয়েদের কাছেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।
সব মেডিকেল কলেজ মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষার মতো সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষার একটি উদ্যোগ কয়েক বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হয়েছিল। এর সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমাকে একটা প্রস্তাব দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আমি তখন ছিলাম অজ্ঞ নাপিত। তাই সেই সভায় বাংলাদেশের সব ভাইস চ্যান্সেলরের সামনে কীভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যায় তার খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না বলে সেটাকে শেষ পর্যন্ত কেউ গুরুত্ব দেয়নি!
ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের এত কষ্ট করতে হয় এবং বিষয়টা পুরোপুরি জেনেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় না এবং এর মূল কারণটা 'বাণিজ্যিক'_ এটা জানার পর থেকে আমি সব সময়ই নিজের ভেতরে এক ধরনের ক্ষোভ অনুভব করি। আমি সব সময়ই মনে মনে আশা করে থাকি যে, কোনো একজন শিক্ষার্থী কিংবা তার অভিভাবক ক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে রিট করে দেবেন এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিষয়টি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক ভর্তি পরীক্ষার সময় কী ধরনের কাজ করে কত টাকা উপার্জন করেন, সে তালিকাটি প্রকাশিত হবে এবং শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালত সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে বাধ্য করবেন।
সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ জানে না। প্রতি বছরই কিন্তু সারাদেশের সব পরীক্ষার্থী নিয়ে একটি নির্দিষ্ট দিনে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রায় ৩-৪ লাখ পরীক্ষার্থী সেই পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং অত্যন্ত সুচারুভাবে তার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আমি নিজে এ তথ্যটি জানতাম না, দেশব্যাপী বিশাল একটি ভর্তি পরীক্ষার খুঁটিনাটি আমি জানতে পেরেছি, কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমরা গত বছর তাদের কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছি। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে আমি আরেকটি বিষয় আবিষ্কার করেছি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল কর্মকাণ্ড করার পরও কোনো পত্র-পত্রিকায় তাদের সম্পর্কে একটি ভালো কথাও বলা হয় না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রমাণ করে রেখেছে এ দেশে চার-পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার জন্য 'ডিজিটাল' বা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব, অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া সম্ভব। তারা প্রমাণ করেছে এই চার-পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থীর জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা সম্ভব এবং সিকিউরিটি প্রেসে সেগুলো ছাপিয়ে কঠিন নিরাপত্তার মধ্যে সারাদেশের সবগুলো পরীক্ষা কেন্দ্রে পেঁৗছানো সম্ভব। তারা প্রমাণ করেছে, একই দিনে সারাদেশের অসংখ্য পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব এবং মূল্যায়নের জন্য উত্তরপত্র একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিরাপদে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তারা প্রমাণ করেছে, সেই উত্তরপত্র নির্ভুলভাবে যাচাই করে নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব এবং পুরোপুরি ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় তাদের ভর্তি করানো সম্ভব।
এক কথায় বলা যায়, এ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সম্মিলিত একটি ভর্তি পরীক্ষা নিতে যে কাজগুলো করতে হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রত্যেকটি ধাপ সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছে। আমি এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে জানি। কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে আমার তরুণ সহকর্মীরা এর সব কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছে এবং এ বছর ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।
তাই অন্যান্য বছর থেকে এই বছর আমার ভেতরে ক্ষোভটা একটু বেশি, কারণ এই বছর আমি আরও অনেক বেশি নিশ্চিতভাবে জানি, সম্মিলিতভাবে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জীবনটুকু অনেক সহজ এবং সুন্দর করতে পারতাম। আমরা সেটা করছি না। আমি জানি না, এ ছেলেমেয়েগুলো আমাদের ক্ষমা করবে কি-না।
২৪.৮.১২

মুহম্মদ জাফর ইকবাল :লেখক; অধ্যাপক
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মুহম্মদ জাফর ইকবালের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট সাদাসিধেকথা ডটকম (www.sadasidhekotha.com) †) থেকে লেখাটি নেওয়া হয়েছে
 

No comments

Powered by Blogger.