বাংলাদেশ রেলওয়ে-ভাড়া বাড়লে সেবাও বাড়ূক

দ্রুতগামী, নিরাপদ ও আরামদায়ক বলে সারা পৃথিবীতেই রেলের বিশেষ সুনাম। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্রটি উল্টো। সুনামের চেয়ে দুর্নাম বেশি। রেল ভ্রমণ অধিকাংশের পছন্দের তালিকার শীর্ষ থাকলেও বাস্তবে চলাফেরায় রেল এড়িয়ে চলতেই বাধ্য হন সবাই।


প্রথমত, পছন্দমতো সময়ে চাইলেই ভ্রমণ করা যায় না; দ্বিতীয়ত, ট্রেনের সময়-সূচির বিশৃঙ্খলা। ৯টার ট্রেন কখন আসে সে কথা কেউ-ই বলতে পারে না। তৃতীয়ত, যাত্রীসেবার মানের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এদিক থেকে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাস সার্ভিস বেশ এগিয়ে। রাজধানী থেকে অধিকাংশ বড় শহরের উদ্দেশে প্রতি এক বা দুই ঘণ্টায় বাস ছাড়ে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা আছে। আছে শহর থেকে টার্মিনাল পর্যন্ত যাত্রী পরিবহনের সুলভ ব্যবস্থাও। এসি, ননএসিসহ বাহারি নানা সেবা ব্যবস্থা দিয়ে যাত্রীদের আকৃষ্ট করে বাস সার্ভিসগুলো। টিকিটের মূল্য দফায় দফায় বাড়লেও বাসই এদেশে পছন্দের তালিকার শীর্ষে। কিন্তু নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বাসের এই অবস্থান থাকার কথা নয়। বস্তুত, নদীপথগুলোই এদেশের প্রথম যোগাযোগ মাধ্যম হওয়া উচিত। কিন্তু, দিনকে দিন নদী পথের গুরুত্ব কমছে। নদী নাব্যতা হারাচ্ছে, নদীপথে যাত্রীসেবার মানও পড়তির দিকে। নতুন পথ তৈরি দূরের কথা, পুরনো পথগুলো সচল রাখাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বর্তমানের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলের তৈরি। দুঃখজনক হলেও বঙ্গবন্ধু সেতু প্রকল্পে রেল সংযোগ ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশে রেলের অবকাঠামো সম্প্রসারণের উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই অবকাঠামো সুবিধা হ্রাস পেয়েছে। ট্রেনের সংখ্যা কমেছে। জনপ্রিয়তাও ক্রমহ্রাসমান। অথচ ভারতসহ পৃথিবীর সর্বত্রই রেলের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। নিত্যনতুন সেবার মাধ্যমে যাত্রীদের আকৃষ্ট করে, ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে, স্টেশনগুলোর বৈপ্লবিক সংস্কার করে রেলকে নতুন কালের উপযুক্ত করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজলভ্য করা হয়েছে রেল সার্ভিস। অথচ আমাদের রেল ব্যবস্থা চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। লাভের বদলে লোকসান, আলোর বদলে অন্ধকার, সেবার বদলে হয়রানি, স্বচ্ছতার বদলে দুর্নীতি, সম্প্রসারণের বদলে দখল-সংকোচনই যেন রেলের নিয়তি। অথচ মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে রেলের অবকাঠামো ও সেবা সম্প্রসারণ শুধু নয়, দরকার রীতিমতো বৈপ্লবিক সংস্কার। সে কাজটি এ পর্যন্ত হয়নি। সংস্কারের আলামতও খুব স্পষ্ট নয়। সম্প্রতি রেল ও যোগাযোগমন্ত্রী রেলকে নতুন জীবনদানের কথা বলেছেন। এটি ইতিবাচক কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু কথাকে কাজে পরিণত করতে হবে। আর সে জন্য দরকার বড় ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা, বিনিয়োগ, সংস্কার। এর মাধ্যমে রেলকে নতুন জীবন দেওয়া সম্ভব, রেলকে লাভজনক করাও সম্ভব। সেবা ব্যবস্থা উন্নত হলে পছন্দের তালিকায় রেল আসবে। জনসংখ্যার যে চাপ তাতে বাসের যাত্রী কমার আশঙ্কা নেই। কিন্তু রেলও সমান্তরালে যাত্রী পাবে। সে ক্ষেত্রে টিকিটের দাম বাড়ালেও যাত্রীদের আপত্তির কিছু থাকবে না। কিন্তু বিদ্যমান সেবা ব্যবস্থায় টিকিটের দাম বৃদ্ধির যুক্তি কী? বিগত বিশ বছরে টিকিটের দাম বাড়েনি। কিন্তু চলি্লশ বছরে সেবার মান কি একটুও বেড়েছে? কিংবা অদূরভবিষ্যতে বাড়বে এমন ইঙ্গিত কি আছে? তবু বহুদিন পর কিছু আশ্বাসের বাণী আসছে। আশা করা যায়, কিছু কাজ হবে। রেল নতুন গতি পাবে। আর সে আশায় যাত্রীরাও হয়তো বাড়তি ভাড়া মেনে নেবেন। কিন্তু বাড়তি ভাড়ার পাশাপাশি বাড়তি সেবার দিকে নজর দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। মনে রাখতে হবে, কম ভাড়া লোকসানের অন্যতম কারণ নয়, রেলের সঙ্গে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলার যে গাঁটছড়া তা-ই রেলের দুর্গতির কারণ। সে কারণগুলো দূর করা খুব জরুরি।
 

No comments

Powered by Blogger.