গ্রামবাসীর মত- লিমনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাটি কাল্পনিক by গোলাম মর্তুজা ও আক্কাস সিকদার

র‌্যাবের গুলিতে এক পা হারানো লিমনের মা-ভাইদের বিরুদ্ধে করা হত্যা মামলাটি কাল্পনিক বলে মনে করছেন গ্রামবাসী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁদের মত, গ্রাম্য শত্রুতার কারণে এ মামলা করা হয়েছে। গতকাল শনিবার ঝালকাঠির রাজাপুরের সাতুরিয়া গ্রামে গেলে তাঁরা এসব কথা বলেন।


মামলার বাদী ইব্রাহিম হাওলাদার র‌্যাবের সোর্স হিসেবে পরিচিত বলে গ্রামের অনেকেরই মনে হয়েছে। এর সঙ্গে র‌্যাবের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।
গ্রামের ইঁদুরবাড়ি সেতুর ওপর ঈদের দিন লিমনকে মারধর করেন ইব্রাহিমসহ কয়েকজন। এ ঘটনা শুনে আধা কিলোমিটার দূরের বাড়ি থেকে দৌড় দিয়েছিলেন ইব্রাহিমের শ্যালক মো. ফোরকান। কিন্তু সেতু পর্যন্ত আসতে পারেননি। বাড়ি থেকে ১০০ মিটার দূরে সাতুরিয়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসার সামনে রাস্তায় পড়ে যান তিনি।
এ ঘটনার পর রাজাপুর থানায় ইব্রাহিমের ওপর হামলার অভিযোগে জিডি করেন তাঁর স্ত্রী লিলি বেগম। লিমনের মা হেনোয়ারা বেগমও আরেকটি জিডি করেন। আর ফোরকানের মৃত্যুর ঘটনায় লিলি বেগম পরদিন রাজাপুর থানায় অপমৃত্যু মামলা করেন। তিন দিন পর লিমনের মা হেনোয়ারা, বাবা তোফাজ্জল হোসেন, ভাই সুমন, সাতুরিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হেমায়েত হোসেনসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ফোরকান হত্যার অভিযোগে আদালতে নালিশি মামলা করেন ইব্রাহিম। তালিকাভুক্ত পলাতক সন্ত্রাসী মোর্শেদ জমাদ্দারকেও এ মামলায় আসামি করা হয়েছে।
এই মোর্শেদকে ধরতে এসে গত বছরের ২৩ মার্চ লিমনের পায়ে গুলি করেছিল র‌্যাব। বরিশাল-খুলনা মহাসড়কের ইঁদুরবাড়ি সেতু পার হয়ে উত্তর দিকে কাঁচা রাস্তা দিয়ে আধা কিলোমিটার হাঁটলে সাতুরিয়া গ্রামে লিমনদের বাড়ি। বাড়ি বলতে বাঁশ দিয়ে ঠেক দিয়ে রাখা হেলে পড়া একটি টিন-কাঠের ঘর। এই ঘরের পাশের ঘরটিই হলো ফোরকানের। এর একটু পাশেই ইব্রাহিমের ঘর। গ্রামবাসী বলছেন, এই পরিবারগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের।
মহাসড়কের পাশে লিমনের ওপর হামলা হলেও ইব্রাহিমের দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, সাতুরিয়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসার সামনে ইব্রাহিমকে মারধর করে আসামিরা। ইব্রাহিমের ডাকে ফোরকান ছুটে এলে তাঁকেও মারধরের পর গলা চেপে হত্যা করে আসামিরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইব্রাহিম গতকাল বলেন, তাঁর স্ত্রী লিলি বেগম যে অপমৃত্যু মামলা করেছেন, সেখানে ঘটনাস্থল হিসেবে দেখানো হয়েছে ইঁদুরবাড়ি। মাদ্রাসার সামনের জায়গাটিও ইঁদুরবাড়ি এলাকার মধ্যে পড়ে।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, মাদ্রাসা থেকে অন্তত ৪০০ মিটার দূরে ইঁদুরবাড়ি সেতুর পাশে লিমনের ওপর হামলা হয়েছিল। সে পর্যন্ত ফোরকান যেতেই পারেননি। আবদুল হাই নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ঈদের দিন বিকেলে তাঁরা কয়েকজন ইঁদুরবাড়ি সেতুর পাশে চায়ের দোকানে বসে ছিলেন। এ সময় লিমন, তাঁর মা, চার খালা ও অন্য আরেকজন সেতুর ওপর আসেন। তাঁরা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। লিমন খালাদের সঙ্গে মোবাইলে ছবি তুলছিলেন। এ সময় ইব্রাহিমসহ কয়েকজন লিমনকে ছবি তুলতে দেখে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করেন। লিমনও পাল্টা জবাব দিলে বিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে ইব্রাহিম লিমনকে মারতে শুরু করলে লিমন মাটিতে পড়ে যায়। লিমনের মা এগিয়ে এলে তাঁকে ঘুষি মারেন ইব্রাহিম। তিনি পাকা রাস্তায় পড়ে যান। সেখানে ফোরকান ছিলেন না।
ওই এলাকার আরও কয়েকজন বলেন, তাঁরা শুনেছেন, মারামারির কথা শুনে দৌড়ে বাড়ি থেকে আসতে গিয়ে পথে ‘হার্টফেল’ (হূদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে) করে মারা যান ফোরকান।
মাদ্রাসার সামনের ঘন কাদায় পড়ে যাওয়ার পর ফোরকানকে নেওয়া হয়েছিল পাশে ইব্রাহিমের বোন নিলুফার ইয়াসমিনের বাড়িতে। ইব্রাহিমের নালিশি মামলার এক নম্বর সাক্ষী নিলুফার। তবে সাক্ষী হওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন না। গতকাল নিলুফার বলেন, ঈদের দিন বিকেলে চিৎকার শুনে বাসা থেকে বের হয়ে ফোরকানকে প্রায় নিস্তেজ অবস্থায় দেখতে পান। স্থানীয় মহিবুল ও মামুনের সহায়তায় ফোরকানকে তাঁর ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। খুব নিচু গলায় ফোরকান তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর মাথা ঘুরছে। তিনি পানি খেতে চান। মুখে পানি দিলে ফোরকান মুখ হাঁ করে পানি খান। এরপর আর নড়াচড়া করেননি।
নিলুফার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মারামারি হতে দেখেননি। তবে শুনেছেন, তাঁর ভাই ইব্রাহিমের সঙ্গে কয়েকজনের মারামারি হয়েছে ইঁদুরবাড়ি সেতুর পাশে। তিনি ফোরকানের শরীরে মারপিটের চিহ্ন দেখতে পাননি বলে জানান। ফোরকানের সুরতহালকারী ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল বাশার মোহাম্মদ আমিরউদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, নিহতের শরীরে কোনো দাগ দেখা যায়নি।
একাধিক গ্রামবাসী বলেছেন, ইব্রাহিমকে তাঁরা র‌্যাবের সোর্স হিসেবেই জানেন। এই পরিচয়ে ইব্রাহিম গ্রামের মানুষকে ভয় দেখান। তাঁদের ধারণা, লিমনের পরিবারকে চাপে রাখতেই র‌্যাব এ ঘটনা ঘটাতে পারে। তবে গত বৃহস্পতিবার র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ইব্রাহিমের সঙ্গে র‌্যাবের কোনো সম্পর্ক নেই।
রাজাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফাজ্জল হোসেন বলেন, লিমনের মা, বাবা, ভাইসহ ১০ জনের নামে আদালতে যে নালিশি মামলা হয়েছে, তা এজাহার হিসেবে গ্রহণের আদেশ গতকাল পর্যন্ত থানায় পৌঁছায়নি। আর লিমনের ওপর হামলার ঘটনায় পাল্টাপাল্টি যে দুটি জিডি হয়েছিল, তার তদন্ত শুরু হয়েছে।
সেদিনের হামলায় আহত হেনোয়ারা বেগম বলেন, তিনি বৃহস্পতিবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। তিনি এখন দুই চোখে আবছা দেখছেন। হত্যা মামলা হওয়ায় তিনি গ্রেপ্তারের আতঙ্কে আছেন। তাঁদের ওপর হামলার সময় ফোরকান সেখানে ছিলেন না বলে জানান হেনোয়ারা ও লিমন। আর লিমনের বাবা মামলার আসামি হলেও তিনি ঘটনার সময় ঢাকায় ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.