খুনী নূর চৌধুরীকে চোরা পথে পাসপোর্ট দেয় বিএনপি সরকার- কানাডা সে সময় ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল তাকে by শংকর কুমার দে

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদ- সাজাপ্রাপ্ত খুনী কানাডায় পলাতক লে. কর্নেল (অব) এসএইচএমবি নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল কানাডা সরকার। এখন থেকে প্রায় ৮ বছর আগে ২০০৪ সালে।
তখন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও তাকে ফেরত আনেনি তখনকার বিএনপি সরকার। সে সময় বিএনপি সরকারের প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতায় কানাডায় তার অবস্থানের সুবিধার্থে পাসপোর্ট অফিস থেকে লুট হয়ে যাওয়া একটি চোরাই পাসপোর্ট পাঠিয়ে দিয়ে কানাডায় তাকে অবস্থান করতে সুযোগ করে দেয়া হয়। পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট লুট হয়ে যাওয়া এবং নূর চৌধুরীকে কিভাবে কারা চোরাই পাসপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছিল সেই ঘটনা এখনও রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। এ খবর গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, কানাডা সরকার যখন নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল তখন রফিক আহমেদ খান বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে কানাডায় নিযুক্ত ছিলেন। কানাডার হাইকমিশনার তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তখন সচিব ছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতার পররাষ্ট বিষয়ক উপদেষ্টা পদে থাকার পর শমসের মবিন চৌধুরীকে সর্বশেষ গঠিত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদ দেয়া হয়। কানাডায় নিযুক্ত হাইকমিশনার রফিক আহমেদ খান তখন নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বহিষ্কার ও তার পাসপোর্ট সংক্রান্ত ব্যাপারে পররাষ্ট্্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের পরামর্শ চান। এ ব্যাপারে একটি বার্তাও পাঠানো হয়। তারপরই রহস্যজনকভাবে কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরীর কাছে বাংলাদেশ থেকে লুট হয়ে যাওয়া সিরিজের একটি পাসপোর্ট পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাসপোর্ট অফিস থেকে লুট হয়ে যাওয়া পাসপোর্টটি নূর চৌধুরীর নামে কারা কিভাবে ইস্যু করে কানাডায় তার কাছে পাঠানো হয়েছে সেই রহস্যের জট খোলা যায়নি অদ্যাবধি।
২০১০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকা-ের মামলার রায়ে ১২ জনের ফাঁসির রায় হয়। এর মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ ও একেএম মহিউদ্দিনÑ এই ৫ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারিতে। ২০০১ সালে জিম্বাবুইয়েতে মারা গেছে আবদুল আজিজ পাশা। অপর ৬ খুনী এখনও পলাতক। এর মধ্যে নূর চৌধুরী অবস্থান করছে কানাডায়। রাশেদ চৌধুরী আছে আমেরিকায়। আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, আবদুল মাজেদ ও মোসলেমউদ্দিন কোথায় আছে তার কোন হদিস নেই। কোন ব্যক্তিকে নিজ দেশে ফেরত পাঠালে মৃত্যুদ- হবে এমন অবস্থায় কানাডার আইন অনুযায়ী ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আইনগত বাধা থাকার সুযোগে এখন আর নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদ- কার্যকর করার পথে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত খুনী মেজর (অব) নূর চৌধুরীর সেই পাসপোর্ট কেলেঙ্কারির রহস্যের জট খুলতে তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে সে এই পাসপোর্টটি ব্যবহার করে বলে অভিযোগ রয়েছে। কানাডায় অবস্থানকালে বাংলাদেশ থেকে তার কাছে এই পাসপোর্টটি পাঠিয়েছে জোট সরকারের এক প্রভাবশালী মহল। পাসপোর্ট অফিস থেকে লুট হয়ে যাওয়া একটি সিরিজের পাসপোর্ট তার কাছে পাঠানো হয়। কারা কিভাবে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরীর কাছে পাসপোর্টটি পাঠিয়েছে তা খুঁজে বের করা গেলে থলের বিড়াল বের হয়ে আসতে পারে বলে জানা গেছে।
২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রায় ৩ মাস আগে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরী কাছে একটি পাসপোর্ট পাঠানো হয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে এই পাসপোর্টটি ব্যবহার করে কানাডা থেকে বাংলাদেশে এসেছে সে। হরকত-উল-জিহাদের (হুজি) প্রধান মুফতি হান্নানের দেয়া জবানবন্দীতে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে নূর চৌধুরী বাংলাদেশে এসে পরিরকল্পনায় অংশ নেয়। নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে এসে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে পরিকল্পনায় অংশগ্রহণের জন্য কানাডায় তার কাছে সেই পাসপোর্টটি কারা কিভাবে পাঠিয়েছে তা এখনও বহস্যাবৃত।
কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরীর কাছে বাংলাদেশ থেকে যে সিরিজের পাসপোর্টটি পাঠানো হয়েছে সেই পাসপোর্টটি নিয়েও যে কেলেঙ্কারি ঘটেছে তাও তদন্ত করে দেখা হয়। নূর চৌধুরীর নামে ইস্যু করা হয়েছে ‘ডব্লিউ’ সিরিজের একটি পাসপোর্ট। ডব্লিউ সিরিজের এই পাসপোর্টটি ২০০৪ সালের বিভিন্ন আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে ২৫০টি আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট লুট হয়ে যায়। ২০০৪ সালের ১০ আগস্টে পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক ড. পারভীন বানু স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ডব্লিউ সিরিজের ২৫০টি পাসপোর্ট বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিস থেকে লুট হয়ে গেছে।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ২০০৪ সালে যে ডব্লিউ সিরিজের ২৫০টি পাসপোর্ট লুট হয়ে গেছে সেই সিরিজের লুট হয়ে যাওয়া পাসপোর্টের একটি পাঠানো হয়েছে কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরীকে। শুধু তাই নয়, ২০০৪ সালে লুট হয়ে যাওয়া ডব্লিউ সিরিজের ২৫০টি পাসপোর্টেরই একটি তার নামে ইস্যু দেখানো হয়েছে ২০০২ সালে। ২০০৪ সালে যে পাসপোর্ট লুট হয়ে গেছে তার ২ বছর আগে ২০০২ সালে তার কাছে পাঠানো হলো কিভাবে?
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রায় ৩ মাস আগে কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধরীর কাছে পাসপোর্ট পাঠানো হয়েছে বলে তদন্তে পাওয়া যাচ্ছে। হুজি প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানের দেয়া জবানবন্দীর সঙ্গে কানাডায় নূর চৌধুরীর কাছে তার নামে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পাঠানোর দিনক্ষণের সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে। তারপর পাসপোর্ট অফিস থেকে লুট হয়ে যাওয়া সিরিজের পাসপোর্ট নূর চৌধুরীর নামে কারা কিভাবে ইস্যু করে পাঠিয়েছে তার সঠিক তদন্ত করা গেলে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.