বছরের পর বছর ধরে বিশ্বমানের স্প্রিন্টারের জন্ম দিয়ে আসছে জ্যামাইকা। কীভাবে? জ্যা মা ই কা স্প্রিন্টার তৈরির কারখানা

কী ভেলকিটাই না দেখালেন উসাইন বোল্ট! বেইজিংয়ের পর লন্ডনেও ডাবল, ট্রেবল! একেবারে হাসতে হাসতে কেল্লাফতে! হাস্য-কৌতুকে হালকা হয়ে ট্র্যাকে যাওয়া, গুলির সংকেতের অপেক্ষা, তারপর?তারপর স্টেডিয়ামে জড়ো হওয়া, সারা বিশ্বে টেলিভিশনের দিকে চোখ রাখা মানুষ দেখল এক বিদ্যুৎ-ঝলক।
একটি দৌড়, অলিম্পিক রেকর্ডের পাতায় জ্বলজ্বল করে উঠল একটি নাম—উসাইন বোল্ট!
আচ্ছা, ২০০ মিটার দৌড়ে পদক তালিকার তিনটি নামের দিকে চোখ রেখেছিলেন কি? ওঁরা তিনজনই জ্যামাইকান! ১০০ মিটারেও বোল্টের পেছনে ছিলেন যে ব্লেক, তাঁর বাড়ি কোথায়? সেই জ্যামাইকায়ই না? মেয়েদের মধ্যে ১০০ মিটারের সোনা পেলেন শেলি-অ্যান ফ্রেজার-প্রাইস, তাঁর দেশও দেখি জ্যামাইকা! তাহলে কি জ্যামাইকা নামক ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রটায় স্প্রিন্টার তৈরির কারখানা আছে?
কী করে দ্রুততম মানব-মানবীরা তৈরি হচ্ছেন ছোট্ট এই দেশটায়? কোন জাদুবলে দরিদ্র দেশটির মানুষ অলিম্পিকের মাঠে উড়িয়ে দিচ্ছেন জাতীয় পতাকা আর সারা বিশ্ব বিপুল সম্ভ্রমের সঙ্গে দেখছে তাঁদের?
চলুন, একটু ঘুরে আসি জ্যামাইকা থেকে। লক্সলে অ্যান্ডারসনের কাছে গিয়ে একটু দাঁড়াই। কিংসটনের মোনা প্রিপারেটরি স্কুলের কোচ তিনি। দেখুন, জ্যামাইকার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ঘাসের ট্র্যাকের দিকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাচ্চাদের। শিশুগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন, সবচেয়ে বড়টির বয়স ১২, ছোটটির ছয়। ওরা এখন দৌড়ের প্রশিক্ষণ নেবে। লক্সলে অ্যান্ডারসনকে প্রশ্ন করলেই জানতে পারবেন, এই স্কুলে তিন বছর বয়সেই শিশুরা ভর্তি হয়। তিন, চার, পাঁচ বছর বয়সেই ওদের হাঁটার ধরন, দৌড়ানোর ধরন দেখে তিনি জেনে যান, প্রাকৃতিকভাবেই কোন শিশুগুলো স্প্রিন্টার হওয়ার যোগ্য। ব্যস! এর পর থেকেই প্রশিক্ষণ।
লক্সলের সামনে এখন ছয়-সাত বছর বয়সী একটি দল। এরা প্রস্তুতি নিচ্ছে ৪ –১০০ মিটার রিলে রেসের জন্য। মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে অ্যান্ডারসন বলছেন, ‘এরাই হচ্ছে গতি! দেখুন, এরাই গতি!’
ছয়-সাত বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ‘গতি’ দেখে ফেলতে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁরা অলিম্পিকে এসে বিদ্যুতের ঝলক দেবেন না, গতির ঝড় তুলবেন না তো কারা তুলবেন?

কোলাহল সর্বত্রই
কোত্থেকে আসেন বোল্ট-ব্লেকরা?
ছেলে আর মেয়েদের জন্য জ্যামাইকায় যে চ্যাম্পিয়নশিপ হয়, তাতে অংশগ্রহণ করেই তারকা বনে যায় শিশুরা। পাড়ায় সেরা, স্কুলে ক্লাসসেরা, স্কুলসেরা শিশুরা চলে আসে এই প্রতিযোগিতায়। কিংসটনের জাতীয় স্টেডিয়ামে ৩০ হাজার দর্শক গ্যালারিতে বসে দেখে এই প্রতিযোগিতা। টেলিভিশনে লাইভ দেখে আরও লাখ লাখ জ্যামাইকাবাসী।
রাস্তায় প্রচণ্ড কোলাহলের মধ্যেই বড় হয় এই হবু স্প্রিন্টাররা। তাই অলিম্পিক কিংবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে গিয়ে এরা মানসিক চাপে ভোগে না।
আর হ্যাঁ, সাংস্কৃতিক দিকটাকেও অগ্রাহ্য করা যায় না। এই বোল্টই তো একজন কফিবাগানের শ্রমিকের ছেলে। বাড়িতে ছিল না পানীয় জলের কল। তাই কয়েক মাইল দূর থেকে কাঁধে করে নিয়ে আসতে হতো জলের পাত্র। ফ্রেজার প্রাইসের মা ছিলেন ফুটপাতের দোকানি। অতিকষ্টে চলত তাদের সংসার। ২১ বছর বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত ফ্রেজার স্প্রিন্টকে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি। দারিদ্র্যও তাহলে কখনো কখনো মানুষকে সত্যি মহান করে তোলে!

কোত্থেকে আসে এই গতি
শুরুতেই একটা কথা বলে রাখা ভালো। জ্যামাইকান শিশুরা দৌড়াতে ভালোবাসে। বেঁচে থাকার তাগিদেই তাদের দৌড়ের প্রশিক্ষণ হয়ে যায়। আর খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসটাও ওদের শরীর গড়ে তুলতে সাহায্য করে। জ্যামাইকার ফাস্ট ফুড চেইনের জুসি প্যাটিসে গিয়ে দেখুন তো, হবু স্প্রিন্টারদের খাদ্যতালিকায় কী আছে? দেখবেন, সকালের নাশতা হিসেবে ওরা পছন্দ করছে নুনে জড়ানো মাছ, মিষ্টি আলু, কলা আর মিন্ট চা। অ্যাকি নামে একটি ফলও আছে খাদ্যতালিকায়, যা দেখতে অনেকটা ডেউয়ার মতো। স্প্রিন্টাররা দৌড়ের প্রস্তুতি নেওয়ার আগে এই খাবারগুলোই খান।
এর পুষ্টিগুণ অসামান্য। মিষ্টি আলু আর কলায় রয়েছে শ্বেতসার। আছে গ্লুকোজ। দৌড়ের জন্য পেশিতন্তুকে ঠিকভাবে কাজ করাতে এদের জুড়ি নেই। কৃষ্ণবর্গীয় মানুষ বলে জ্যামাইকানদের হাত-পা দীর্ঘ, ত্বকের নিচে খুব কম চর্বি জমে তাদের, ফলে সেই ওজনটাই তারা বহন করে, যা স্প্রিন্টের জন্য একেবারে উপযোগী। নিতম্ব খুব ছোট, দৌড়ানোর সময় হাঁটু তুলতে পারে অনেক ওপরে। স্প্রিন্টের জন্য হাঁটু যত ওপরে উঠবে, দুই পা ততই দূরত্বে মেলে ধরা যাবে, ফলে মাটিতে পা পড়ার দৈর্ঘ্য বাড়বে।

গুরুর কথা
স্প্রিন্ট নিয়ে জ্যামাইকার রয়েছে নিজস্ব দর্শন। একটা সময় ছিল, যখন জ্যামাইকার গরিব স্প্রিন্টাররা মরিয়া হয়ে দৌড়াত, যাতে মার্কিন মুলুকে একটা স্কলারশিপ পাওয়া যায়। সেখানে কোচিং ভালো, সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ ভালো। কিন্তু সেখানে সব বিদেশির মধ্যে অসহায় বোধ করা বিচিত্র ছিল না। এখন তা থেকে বেরিয়ে এসেছে জ্যামাইকানরা। জ্যামাইকান গুরু বাহাত্তুরে বুড়ো ডেনিস জনসনের কথা এখানে বলতেই হচ্ছে। ষাটের দশকে ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসে বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় স্প্রিন্টার ছিলেন তিনি। দেশে ফিরেছেন নতুন ভাবনা নিয়ে। তিনি মনে করেন, নির্ভারচিত্তে দৌড়ালে জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। স্প্রিন্ট শুরু হওয়ার আগে সব ধরনের মানসিক চাপ বিদায় করেই দাঁড়াতে হবে ট্র্যাকে। তাহলেই জয়! এই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কিছু ড্রিল, কিছু প্রক্রিয়া দাঁড় করিয়েছেন তিনি। তবে হ্যাঁ, ভাবনাটির জন্য জনসন কৃতিত্ব দেন সাবেক নৌ বৈমানিক বাড উইন্টারকে। আমরা এখন বুঝতে পারি, কী করে উসাইন বোল্ট স্প্রিন্টের আগে নিজেকে এতটা নির্ভার করে তুলতে পারেন!
ডেনিস জনসনের কথাই শুনি আমরা, ‘গতি সম্পর্কে মানুষের রয়েছে ভুল ধারণা। নির্ভার স্প্রিন্টার তার গতি ধরে রাখতে পারে। যে স্প্রিন্টার মানসিক চাপের মধ্যে থাকে, মনোযোগী হতে চায় বেশি, সে দৌড়ের শুরুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং সমাপ্তিরেখায় যাওয়ার আগেই পিছিয়ে পড়ে। তুমি কি দেখেছ, উসাইন বোল্ট পেছন থেকে দৌড়ে সামনে চলে আসে এবং অন্যদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়? দেখেছ? তাহলে বলতেই হচ্ছে, তুমি ভুল দেখেছ।’
তাহলে সত্যটা কী?
‘সত্যটা হলো, অন্য স্প্রিন্টাররা ক্লান্ত হয়ে গতি হারাচ্ছে। কারণ, দৌড় শুরু করার ছয় সেকেন্ড পর বা ৬০ মিটার পার হওয়ার পর তুমি আর গতি বাড়াতে পারো না। সেটা শারীরিকভাবে সম্ভব না।’ যে স্প্রিন্টার নির্ভার থেকে একই গতিতে এগিয়ে যেতে পারেন, তিনিই অন্যদের ক্লান্তির সুযোগে প্রথম স্থান দখল করেন।
এই তাহলে ব্যাপার! শিশুকাল থেকেই স্প্রিন্টার হওয়ার স্বপ্ন লালন করে জ্যামাইকানরা। কোচরা নিজেদের উজাড় করে দিয়ে গড়ে তোলেন ক্যাম্পবেল ব্রাউন, ওটি, ম্যাকেনলি, কুয়েরিদের। ওদের পথ ধরেই এগিয়ে চলেন বোল্ট-ব্লেক-প্রাইসরা।
সিএনএন অবলম্বনে
জাহীদ রেজা নূর

No comments

Powered by Blogger.