ফুলবাড়ী দিবস- ‘ফুলবাড়ী চুক্তি বাস্তবায়ন না করার পরিণতি হবে ভয়াবহ’ by আনু মুহাম্মদ

শিরোনামের কথাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাঁর এই বাক্যের প্রেক্ষাপটে আছে ঐতিহাসিক ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থান। এ বছর তার ষষ্ঠ বার্ষিকী, এর স্মরণেই প্রতিবছর ২৬ আগস্ট ‘ফুলবাড়ী দিবস’ পালিত হয়। এই দিনটি এ বছর আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে,


ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না করে বাংলাদেশে কয়লা সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার কিংবা বৃহৎ অর্থে বাংলাদেশের জ্বালানি-নিরাপত্তার কোনো স্বচ্ছ ও টেকসই পথ নির্মাণ করা যাবে না।
ঘটনার শুরু ১৮ বছর আগে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়লা কোম্পানি অস্ট্রেলিয়ার বিএইচপি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ফুলবাড়ীতে কয়লা সম্পদ অনুসন্ধানের লাইসেন্স-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৯৪ সালের ২০ আগস্ট। একপর্যায়ে ফুলবাড়ীতে সমৃদ্ধ কয়লাখনির অস্তিত্ব সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়। রহস্যজনক ঘটনা ঘটে এই সময়, এশিয়া এনার্জি নামে লন্ডনে তালিকাভুক্ত একটি নতুন কোম্পানি গঠিত হয়। কয়লাখনি সম্পর্কে অনভিজ্ঞ নতুন এই কোম্পানি এশিয়া এনার্জির হাতেই বিএইচপি তার লাইসেন্স হস্তান্তর করে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। দুটো প্রশ্ন এখানে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কেন এ রকম সমৃদ্ধ খনির অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও কয়লাখনি সম্পর্কে অভিজ্ঞ বিএইচপি বড় ব্যবসার সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করল? দ্বিতীয়ত, কারা ঠিক ওই সময়েই ফুলবাড়ী কয়লাখনি লক্ষ্য করে একটি নতুন কোম্পানি খুলল? কেন বিএইচপি তার হাতেই নিজের লাইসেন্স হস্তান্তর করল?
প্রথম প্রশ্নটির স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশি ভূতত্ত্ববিদ নজরুল ইসলামের কাছ থেকে, যিনি বিএইচপির কনসালট্যান্ট জিওলজিস্ট হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। ২০০৮ সালের জুন মাসে সিডনিতে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হলে তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের কথা ভেবেই বিএইচপিকে নিয়ে গিয়েছিলাম দেশে। কিন্তু এখন এশিয়া এনার্জির প্রকল্প দেখে আমি আতঙ্কিত। এটা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের সর্বনাশ হবে এবং আমি নিজেকে কোনো দিন ক্ষমা করতে পারব না।’ কেন বিএইচপি চলে গেল, সে সম্পর্কে তিনি লিখেছেন (নিউ এজ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮; ডেইলি স্টার ৩০ মে ২০১০)। ‘গ্রামের নাম ফুলবাড়ী’ নামে এক ছোট্ট তথ্যচিত্রেও তিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন (www.youtube.com/watch?v=huFnWBkuQP4)
নজরুল ইসলামের বক্তব্যের সারকথা হলো, ‘উন্মুক্ত খনি বিএইচপির জন্য নিশ্চয়ই অনেক লাভজনক হতো। কিন্তু তার জন্য যে গভীরতায় কয়লার স্তর থাকা দরকার, ফুলবাড়ীর কয়লা এর চেয়ে অনেক গভীরে, ১৫০ থেকে ২৬০ মিটার। অসংখ্য নদীনালা, খালবিল, মৌসুমি ভারী বৃষ্টি, বন্যাপ্রবণ এই অঞ্চলে অস্ট্রেলীয় মান তো দূরের কথা, যেকোনো দেশের বিধি রক্ষা করে উন্মুক্ত খনি পরিচালনা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া বিএইচপি চায়নি, পাপুয়া নিউগিনির ওক-টেডি কপার খনির মতো আরেকটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের দায় নিতে, যেখানে খনির বিষাক্ত পানি নিকটবর্তী নদীতে ভয়াবহ দূষণের সৃষ্টি করেছিল এবং নিচের বিশাল অঞ্চল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। বিএইচপিকে অল্প দিন পরেই প্রকল্প বাতিল করে ফিরে আসতে হয়েছিল এবং বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। বাংলাদেশের পানির আধার ও অন্য সবকিছু মিলে পরিস্থিতি আরও অনেক জটিল।’ বিএইচপি তাই বুঝেশুনে আগেভাগেই বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। (www.thedailystar.net/newDesign/news-details.php?nid=140553)
তবে দ্বিতীয় প্রশ্ন ও রহস্যের কিনারা আজও হয়নি। বিএইচপির মতো অভিজ্ঞ সংস্থা যা সাহস করেনি. তা করার কথা বলে নতুন কোম্পানি কীভাবে লাইসেন্স পেয়ে গেল? পরিবেশগত সমীক্ষা করার আগেই তারা ছাড়পত্রও পেল! পরে তাদের করা সমীক্ষা আর পুনর্বাসন পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন স্বাধীন আন্তর্জাতিক খনি বিশেষজ্ঞ রজার মুডি ও পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ জেনিফার কেলাফাত। এর আগে এশিয়া এনার্জি জমাকৃত ‘খনি উন্নয়ন পরিকল্পনা’ পরীক্ষা করে মতামত দেওয়ার জন্য সরকার বুয়েটের অধ্যাপক ড. নূরুল ইসলামকে প্রধান করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটি তাদের রিপোর্টে এই প্রকল্প অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও আইনগত বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য বলে সিদ্ধান্ত দেয়। এরপর কোনো সরকারই এ বিষয়ে আর সিদ্ধান্ত জানায়নি। কিন্তু নানা রকম গোপন ও অসচ্ছ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
কোনো রকম সমীক্ষা ও আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের আগেই বিশ্বব্যাংক-সমর্থিত আইআইএফসি নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কয়লানীতি প্রস্তুত করে, যেখানে ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়া যথাক্রমে এশিয়া এনার্জি ও টাটার নামে দেখানো হয় (২০০৫-০৬)। টাটা তখন বাংলাদেশে বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে টাটা গ্রুপের আবাসিক পরিচালক মানজের হুসেন বলেন, এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প যে শর্তে দেওয়া হচ্ছে, তাঁরাও একই শর্তে বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত খনি করতে আগ্রহী (প্রথম আলো, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৬)।
তার মানে ঘটনাবলি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিল, তাতে জনগণ যদি নিষ্ক্রিয় থাকত, এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়া দুই ক্ষেত্রেই উন্মুক্ত খনি হতো। এমনিতেই উত্তরবঙ্গের বহু স্থানে এখন পানির সংকট, এত দিনে তা হাহাকার পর্যায়ে যেত। বহু নদীনালা, খালবিলের দশা বুড়িগঙ্গার চেয়ে ভয়াবহ হতো। জীবিকা ও ঘরবাড়ি হারিয়ে লাখ লাখ মানুষ নতুন করে ঢাকার রাস্তায় আশ্রয় নিত।
২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট লক্ষাধিক মানুষ এশিয়া এনার্জির ধ্বংসাত্মক প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ফুলবাড়ী শহরজুড়ে জমায়েত হয়। একপর্যায়ে প্রশাসন এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ী থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে সময়সীমা ঘোষণা করে সমাবেশ শেষ হয়। তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী সমাবেশ লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। শহীদ হন আল-আমিন, সালেকিন ও তরিকুল নামে তিন তরুণ। গুলিবিদ্ধ হন ২০ জন, আহত হন দুই শতাধিক। ভীতসন্ত্রস্ত করার লক্ষ্যে এই হত্যা-জখম ঘটানো হলেও নারীর সদম্ভ নেতৃত্বে মানুষের প্রতিরোধ ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম দেয়। এই অসাধারণ পর্বে ক্রমে নানাভাবে শরিক হন সারা দেশের মানুষ। এশিয়া এনার্জিকে বিতাড়িত, উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধ করা এবং জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে কয়লা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয়।
২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট যে ঐতিহাসিক ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়, তার প্রতি পূর্ণ সংহতি জানান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ৪ সেপ্টেম্বর ২০০৬ ফুলবাড়ীর মানুষকে অভিনন্দন জানিয়ে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের উদ্দেশে অবিলম্বে সেই চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলেন। একই ভাষণে তিনি সরকারের উদ্দেশে আরও বলেছিলেন, ‘এই চুক্তি বাস্তবায়ন না করার পরিণতি হবে ভয়াবহ’ (প্রথম আলো, ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৬)। এটা আমাদের সবারই কথা। চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিএনপি (চারদলীয় জোট) এবং প্রকাশ্য অঙ্গীকারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এই চুক্তি বাস্তবায়নে দায়বদ্ধ।
কিন্তু বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছর পার হলেও সেই চুক্তির মূল ধারাগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। বরং উল্টো দেশের জন্য সর্বনাশা প্রকল্পের পক্ষে সরকারের ভেতর থেকেই নানা তৎপরতা চলছে। উইকিলিকসের মাধ্যমে জেনেছি, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত এর জন্য তদবির করেছেন, তাঁর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে জনমত তৈরির চেষ্টা চলছে। বর্তমান রাষ্ট্রদূতও একই সুরে কথা বলছেন। অথচ ২৫ মাইল দূরে লেক, পার্কসহ ভূ-বৈচিত্র্য বিনষ্ট হবে এই যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন কানাডাকে তার মনটানা সীমান্তের কাছে উন্মুক্ত কয়লাখনি করতে দেয়নি (ওয়াশিংটন পোস্ট, ৯ মার্চ ২০০৭)।
দেশে সরকার থাকতে কী করে একটি বিদেশি কোম্পানি দেশের সম্পদ নিয়ে বিদেশে অবৈধভাবে শেয়ার ব্যবসা করতে পারে? কোনো বৈধ অনুমোদন না পেলেও ফুলবাড়ীর কয়লাখনির ওপর লন্ডনে এখনো শেয়ার ব্যবসা করছে এশিয়া এনার্জি (বর্তমান নাম গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট বা জিসিএম)। কোনো সরকারই এটা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়নি। বরং দেখা যাচ্ছে, শেয়ার ব্যবসার মুনাফার একাংশ ছড়িয়ে দেশে সমর্থক গোষ্ঠী তৈরির চেষ্টা চলছে।
বিশেষজ্ঞ যখন কোম্পানির স্বার্থে কাজ করেন, তখন যতই ডিগ্রি থাকুক, তাঁকে বিশেষজ্ঞ নয় কোম্পানির প্রচারক হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। এরাই ‘বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’ আওয়াজ তুলে দেশের গ্যাস ভারতে রপ্তানির জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। এরাই বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ নিয়ে রপ্তানিমুখী চুক্তি করতে প্রচারণার কাজ করেছে। উন্মুক্ত খনি করতে গিয়ে দেশের অমূল্য আবাদি জমি, পানিসম্পদ, মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস হোক, উত্তরবঙ্গ মরুভূমি হোক, দেশ ও দেশের মানুষকে ধ্বংস করে কয়লা বিদেশে পাচার হোক, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। কোম্পানির মুনাফা আর নিজেদের সুবিধা বা কমিশনই তাদের লক্ষ্য।
বিদ্যুতের কথা বলেই এসব সর্বনাশা প্রকল্প জায়েজ করার চেষ্টা চলে। প্রকৃতপক্ষে জ্বালানি সম্পদের ওপর শতভাগ মালিকানা, রপ্তানি নিষিদ্ধ ও জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের মাধ্যমে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তার বাস্তবায়নে স্বল্প দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ জোগান ও জ্বালানি-নিরাপত্তা খুবই সম্ভব। প্রমাণিত হয়েছে, রাষ্ট্রীয় নীতি ও সম্পদের ওপর দেশি-বিদেশি লুটেরা গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব থাকলে এটা কখনোই সম্ভব নয়। সরকার যদি জনগণের সম্পদ ও স্বার্থ রক্ষার বিপরীতে অবস্থান নেয়, তাহলে জনগণকেই পাহারাদারের ভূমিকা নিতে হয়। জনগণ বারবার এই ভূমিকা নিয়েছে বলেই বাংলাদেশ নিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন আমরা দেখতে পারি। ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থান এবং এখন পর্যন্ত জনগণের সজাগ অবস্থান তাই আমাদের সাহস ও নিশানা।
 আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.