২৪০০০ কোটি টাকা- ঈদ বাজার ঘিরেই গোটা অর্থনীতি আবর্তিত by মিজান চৌধুরী

গোটা অর্থনীতি আবর্তিত হচ্ছে ঈদ বাজারকে ঘিরে। শেয়ারবাজারে ধসের পরও এ বছর পোশাকের বাজারে ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেশি লেনদেন হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে বেড়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ। ফলে গ্রামাঞ্চলেও অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে বুধবার থেকে শুরু হয়েছে ঈদ উৎসব।


ঈদ বাজারের অর্থনীতি নিয়ে এ পর্যন্ত কোন গবেষণা বা রেকর্ড পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবছর একটি সম্ভাব্য হিসাব তৈরি করে। ওই এ্যাসোসিয়েশনের দেয়া তথ্য মতে, শুধু ফুটপাথে ঈদের পোশাক বাজার ঘিরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার লেনদেন ছাড়াবে। ঢাকাসহ সারাদেশে পোশাকের বাজারে লেনদেন ২৪ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করবে। এটি গত বছরের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ বেশি।
জানা গেছে, ঈদ সামনে রেখে ইতোমধ্যে প্রবাসীদের রেমিটেন্স এসেছে ১২ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা শুধু বোনাস পেয়েছে প্রায় ১৬শ’ কোটি টাকা। সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বোনাস বাবদ পেয়েছে প্রায় ৬শ’ কোটি টাকা। এই টাকার পুরোটাই ব্যয় হবে ঈদকে ঘিরে। এর সঙ্গে আরও যোগ হবে বেসরকারী খাতের ব্যয়।
ঈদ বাজারের ব্যবসায়ীদের মতে, শেয়ারবাজারের বড় ধরনের ধসের একটি প্রভাব পড়েছে। না হলে আরও বেশি বেচাবিক্রি হতো। শেয়ারবাজারে ধসের কারণে অনেক পরিবার ঈদের কেনাকাটার বাজেট কাটছাঁট করেছে। এরপরও মার্কেট, শপিংমল, বিপণি বিতানে মানুষের ভিড়ের কমতি নেই।
বুধবার থেকে সরকারী ছুটি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ঈদ উৎসব শুরু হয়েছে। শেষ সময়ে কেনাকাটার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রাজধানীর মার্কেটগুলোয়। গোটা রাজধানী রূপ নিয়েছে ঈদ মার্কেটে। কেনাকাটা চলছে গভীর রাত পর্যন্ত। উপজেলাগুলোতে ঈদ বাজার জমে উঠেছে। পোশাকের সঙ্গে গৃহস্থালি জিনিসপত্রের বাজারে বেচাবিক্রি ভাল হচ্ছে।
ঈদ পোশাকের অর্থনীতি ॥ কমপক্ষে ২৪ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হবে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। যদিও ঈদ বাজারে পোশাকের অর্থনীতি নিয়ে অন্য কোন সংস্থার কাছে হিসাব নেই। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আমির হোসেন খান জনকণ্ঠকে বলেন, পোশাকের দাম কিছুটা বেশি। বেচাবিক্রি কিছুটা কম হলে মূল্য বেশি থাকায় গত বছরের তুলনায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেশি লেনদেন হচ্ছে।
আমরা দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে প্রতিবছর একটি হিসাব বের করার চেষ্টা করি। এ বছরও ওই হিসাব বের করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখন উপজেলা পর্যন্ত পোশাকের বড় বড় বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে বেচাবিক্রিও বাড়ছে। এছাড়া ঈদ উপলক্ষে গৃহস্থালি জিনিসপত্রের কেনাকাটাও চলছে। ফলে ওই মার্কেটও চাঙ্গা রয়েছে।
ফুটপাথের ঈদ পোশাকের অর্থনীতি ॥ ঈদ সামনে রেখে ফুটপাথে কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হবে। এ তথ্যও পাওয়া গেছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির কাছ থেকে। ইতোমধ্যে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তরা হুমড়ি খেয়ে ফুটপাথের পোশাকের বাজারে পড়েছে। হাকডাক দিয়ে বিক্রেতারা সেখানে পোশাক বিক্রি করছেন। ফুটপাথের পোশাকের বাজার বড় ধরনের একটি চাহিদা মেটাচ্ছে। একবারে ছোট একটি দোকানিও প্রতিদিন ঈদ উপলক্ষে এক থেকে দুই হাজার টাকার পোশাক বিক্রি করছেন, যা সাধারণ দিনে সম্ভব হতো না।
ঈদ উপলক্ষে রেমিটেন্স আসায় গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা ॥ ঈদ সামনে রেখে অন্যান্য সাধারণ মাসের তুলনায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৃদ্ধি পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত পহেলা জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত এই ৪০ দিনে ১২ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার রেমিটেন্স এসেছে। ফলে গ্রামগঞ্জে রেমিটেন্সের টাকা পেয়ে ঈদ মার্কেটে কেনাকাটা করছে প্রবাসীদের পরিবার পরিজনরা। রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার জনতা ব্যাংকের শাখায় গত মঙ্গলবার কথা হয় রেমিটেন্স গ্রহণকারী আব্বাস আলীর সঙ্গে। কুয়েত থেকে তাঁর মা ঈদের পোশাক কেনার জন্য ৩০ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। এই টাকা তুলে ওইদিনই পোশাক কেনার জন্য মার্কেটে যাবেন বলে জানান তিনি। এছাড়া গ্রামগঞ্জের অনেক পরিবারের কাছে রেমিটেন্সের টাকা চলে আসায় তাঁরাও এখন ব্যস্ত কেনাকাটায়।
তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বোনাস ॥ তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা বেতন বোনাস পেয়ে কেনাকাটায় মেতে উঠেছে। ঈদে কমপক্ষে ১৬শ’ কোটি টাকার বোনাস পেয়েছেন শ্রমিকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক বিজিএমইএ নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, তার একটি ফ্যাক্টরিতে ঈদ বোনাস গুনতে হয়েছে ৪ কোটি টাকা। তাঁর মতে, কমপক্ষে ২শ’ তৈরি পোশাক শিল্প এবং তার চেয়ে বড় আরও দেড় শ’ শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া মাঝারি ধরনের অসংখ্য তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। তাঁর ধারণা বোনাসের টাকা ১৬শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তবে কত টাকা বেতন-বোনাস দেয়া হয় বা প্রতি মাসে এই শিল্পের ৩৫ লাখ শ্রমিকের বেতন বাবদ ব্যয় কত এই হিসাব পাওয়া যায়নি। তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা বেতন-বোনাস পেয়ে কেনাকাটা শুরু করেছেন। আত্মীয় পরিবার ও পরিজনের জন্যও পোশাক ক্রয় করছেন। ফলে বোনাসের পুরোটাই ব্যয় হচ্ছে ঈদ বাজারে।
সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ঈদ ব্যয় ॥ সরকারের হিসাবে প্রতি মাসে ১৮শ’ কোটি টাকা বেতন বাবদ দেয়া হচ্ছে। ওই হিসাবে এক-তৃতীয়াংশ বোনাস হলেও সরকারের বোনাস খাতে ব্যয় হবে প্রায় ৬শ’ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বেতন-বোনাস পেয়েছেন। আগস্টের বেতনও তাঁরা পেয়ে গেছেন। ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদের কেনাকাটায় মেতে উঠেছেন তাঁরা। অবশ্য বোনাসের টাকার পুরোটাই তাঁরা ব্যয় করেন পোশাক কোনাকাটায়। নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আগস্ট মাসের বেতন পেয়ে ভাল হয়েছে। এ বছর কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করা যাবে।
এরপরও দারিদ্র্যসীমার নিচে প্রায় ৩২ শতাংশ লোক অর্থাৎ ৪ কোটি ৮০ লাখ লোকের এ উৎসবের কেনাকাটায় যোগ দেয়ার সামর্থ্য নেই। যদিও বাধ্য হয়েই এদের অনেকে ধারকর্জ করে হলেও শেষ পর্যন্ত ঈদ কেনাকাটায় যোগ দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। মূলত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা ঈদ কেনাকাটায় যোগ দিচ্ছে বেশি। ঈদের কেনাকাটার জন্য উচ্চবিত্ত পরিবার দেশের বাইরেও চলে যাচ্ছে।
সারাদেশে ২০ লাখ স্থায়ী দোকানের অর্ধেকই ঈদের কেনাকাটার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বাকিগুলোতেও ঈদ মৌসুমের প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর ফুটপাথের আড়াই লাখ দোকানেও ঈদের আগে জমজমাট কেনাকাটা চলে। এছাড়া শুধু ঈদ কেন্দ্র করে পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠে উপহার সামগ্রী, পোশাক ও খাদ্যদ্রব্যের মৌসুমী স্টল। এছাড়া ঈদ ঘিরে পরিবহন খাতে সৃষ্টি হয় প্রাণচাঞ্চল্য। ঈদ সামনে রেখে জমে ওঠে ঈদকার্ড, অডিও-ভিডিও এবং সিনেমার ব্যবসা। অন্যান্য বিনোদনেও ব্যয় হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ।

No comments

Powered by Blogger.