মেডিকেলে ভর্তি-এ বছর পরীক্ষা হতেই হবে by সৌমিত চন্দ জয়দ্বীপ

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যে 'ফলাফল'সর্বস্ব হয়ে যাচ্ছে_ সেটা বলাই বাহুল্য। এসএসসি-এইচএসসিতে যারা গোল্ডেন এ প্লাস কিংবা এ প্লাস পাচ্ছে, তাদেরই শুধু 'মেধাবীতম'র স্বীকৃতি দেওয়া খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এসব পর্যায়েও তো কোচিং চলছে


শিক্ষাকে 'যুগোপযোগী' করতে বর্তমানের জন্য অ-জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিল সরকার। এই সিদ্ধান্তটা আপাত সঠিক, আপাত ভুল হলেও হঠকারী অবশ্যই। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা হবে না_ শিক্ষা-সড়কে এটা এখন বার্নিং ইস্যু। হঠাৎ মেডিকেলের 'ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি' বাতিলের ভাবনা ও সিদ্ধান্তটা যে হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর সেন্টিমেন্টের বিপক্ষে অবস্থান_ এটা কি নীতিনির্ধারকরা ভেবেছেন?
মেডিকেলে এসএসসি-এইচএসসির জিপিএ অনুযায়ী ভর্তি করা হবে_ এ সিদ্ধান্ত সাধুবাদযোগ্য। কারণ একটা ভর্তি পরীক্ষা মানে নানা ধরনের কর্মযজ্ঞ। আর ভর্তি পরীক্ষা সামনে রেখে মাথাচাড়া দেয় কোচিং বাণিজ্য। যার কারণে সন্দেহ করা হচ্ছে, 'সর্বদা ভর্তি পরীক্ষা'র পক্ষে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার পেছনে কোচিং সেন্টারগুলোর হাত রয়েছে। তেমনি শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্টম্ফূর্ত আবেগকেও অসম্মান জানানোর সুযোগ নেই। তাছাড়া বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিবাদে মাঠে নেমেছে। আবার বামপন্থিরাই বারবার কোচিং বাণিজ্য বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। তো এমন পরিস্থিতিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সরলীকরণ করলে 'ঘোলা পানিতে মাছ শিকার' করার মতোই অবস্থা হবে।
কোচিং বাণিজ্যের আস্টম্ফালন থামাতে সরকারকে যেমন শিক্ষাদস্যুদের বিপক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান নিতে হবে (কোচিং প্রভাবমুক্ত ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও চিন্তা করা যেতে পারে); তেমনি ভর্তি পদ্ধতি পরিবর্তনের মতো কিছু কৌশলেরও শরণাপন্ন হতে হবে। তারপরও প্রশ্ন ওঠা বাঞ্ছনীয়, মেডিকেলে ভর্তি প্রক্রিয়া শুধু কি কোচিং সেন্টারকে ঠেকাতে পারলেই স্বচ্ছ হয়ে উঠবে? প্রতি বছর মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার গুঞ্জন ওঠে কেন? এতে কোচিংয়ের এক শ্রেণীর দালাল যেমন যুক্ত থাকে, তেমনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের লোকজনও যুক্ত থাকে। সরকারের এটা বিবেচনায় থাকতে পারে হয়তো। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার দায়ভার তো সরকারের। আবার, বসবাস-অযোগ্য ঢাকাকে জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অতিরিক্ত মানব-চাপমুক্ত রাখতে চাওয়াটাও একটা কারণ হতে পারে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যটি থেকে সেটা কিছুটা আঁচ করা যায়। ভর্তি পরীক্ষার কারণে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের জন্য রাজধানীতে আসতে এবং বাসা ভাড়া করতে হয়।
তবে সবকিছুর ঊধর্ে্ব প্রক্রিয়াটি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। সরকারের ভুললে চলবে না যে, এই সিদ্ধান্তটা নিতে তাড়াহুড়া হয়েছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যে 'ফলাফল'সর্বস্ব হয়ে যাচ্ছে_ সেটা বলাই বাহুল্য। এসএসসি-এইচএসসিতে যারা গোল্ডেন এ প্লাস কিংবা এ প্লাস পাচ্ছে, তাদেরই শুধু 'মেধাবীতম'র স্বীকৃতি দেওয়া খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এসব পর্যায়েও তো কোচিং চলছে। এদের ঠেকানোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে কি 'সোনার কাঠি' আছে? কোচিং বন্ধের সিদ্ধান্ত তো শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন অব্দি চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন করতে পারল না! সরকার কি এটাও ভেবে দেখেছে যে, একজন কলেজ শিক্ষার্থী চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসার জন্য পুরোপুরি ২৪ মাস সময় পায় না। সেই সময়টুকু তো অন্তত তাকে দিতে হবে। শুধু বৈতরণী পার করে শিক্ষিত তৈরি হয়। স্বশিক্ষিত কি হয়? আর শিক্ষা পদ্ধতি ও পরীক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন না করলে এ ধরনের প্রক্রিয়া শুধু বেনিয়াবৃত্তিই শেখাবে। উদাহরণ তো মেডিকেলই। মেডিকেল শিক্ষা সেবাদানের পরিবর্তে অর্থ উপার্জনেরই লাভজনক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। আবার, ভর্তির নূ্যনতম যোগ্যতা বলা হয়েছে জিপিএ ৮। এখানেও তো ফরম বাণিজ্য হবে। পাগলও জানে, মেডিকেলের সরকারি-বেসরকারি মিলে যে সিট সংখ্যা (৮,৫১৪), তাতে অধিকাংশ সিট পাবে ডাবল গোল্ডেন এ প্লাসধারীরা। কোটার সুবিধাতেও ডাবল এ প্লাসরাই এগিয়ে থাকবে। বাকিরা তো তাহলে সরকারের ফরম-বাণিজ্যেরই শিকার হবে, যেখানে গুটিকয়েক 'গোবরে পদ্মফুল'ও থাকতে পারে!
সুতরাং উচ্চশিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষার দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া ও ভর্তিবাণিজ্য এড়াতে 'ড়হব পধহফরফধঃব ড়হব ভড়ৎস'-এর দাবি কয়েকটি বামপন্থি সংগঠন করলেও সরকার দক্ষ উদ্যোগীর পরিচয় দিতে পারেনি। এবার মেডিকেলের ক্ষেত্রে প্রশংসাযোগ্য উদ্যোগ দেখাল বটে, তবুও সেটা যধষভ-ফড়হব এবং পরিকল্পনাহীন। এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই দুই বছর আগে পরিবর্তনের ঘোষণা দিতে হতো। ২০১২ সালে যারা এইচএসসি পাস করল, তারা ২০১০ সালে এসএসসি পাস করেছে। তারাই এবার উচ্চশিক্ষার ভর্তিযুদ্ধে নামবে। মেডিকেলে ভর্তিটা হবে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার জিপিএর ভিত্তিতে। সুতরাং একজন শিক্ষার্থীকে তো সেই ভাবনার সময়টুকু দিতে হবে যে, এই দুই পাবলিক পরীক্ষায় ফল খারাপ হলেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ! সেই মোতাবেক এবারের উদ্যোগটাকে আরও তিন বছর পরে শুরু করাই যুক্তিযুক্ত। যারা ২০১৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেবে তাদের কাছে এমন বার্তা পেঁৗছে দেওয়া উচিত যে, ২০১৫ সালে যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় থাক না কেন, মেডিকেলে আর ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে না। কেননা, শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে দাবি না মানা শিক্ষাবান্ধব আচরণ নয়।

সৌমিত চন্দ্র জয়দ্বীপ : সাংবাদিক
sc.joydip@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.