পদ্মা সেতু- বিশ্বব্যাংককে রাজি করাতে সময় আছে মাত্র সাত দিন

হাতে সময় মাত্র সাত দিন। এর মধ্যেই পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা শেষ করতে হবে। এ জন্য পূরণ করতে হবে বাকি দুটি শর্ত। একটি হচ্ছে মন্ত্রী পদমর্যাদার একজন উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়া এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে একটি সমঝোতা করা।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতু নিয়ে একাধিকবার যোগাযোগ হয়েছে। দীর্ঘ ছুটিতে ওয়াশিংটনে থাকার পর চলতি আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে ফিরেছেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ প্রধান (কান্ট্রি ডিরেক্টর) অ্যালেন গোল্ডস্টেইন। এর পরই ইআরডির মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথাবার্তা কিছুটা এগিয়েছে। এ সময় বিশ্বব্যাংকের অর্থ পেতে সরকারকে কী কী করতে হবে, তা-ও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী সরকার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন চুক্তি বাতিল করলেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকা তাদের ঋণচুক্তির মেয়াদ এক মাস বাড়িয়ে দিয়েছে। ৩১ আগস্ট এই মেয়াদ শেষ হবে। এর মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে। কেননা, বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করলেও প্রতিশ্রুত অর্থ এখনো বাংলাদেশের নামেই রয়েছে। তবে এডিবির নিয়ম ভিন্ন। ঋণ বাতিল করা হলে অর্থ ফেরত নিয়ে নেওয়া হয়। ফলে একবার বাতিল হলে সেই অর্থ আবার পাওয়া সহজ হয় না। এ কারণেই আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আলোচনা সম্পন্ন করার একধরনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলে তিনি আশাবাদী।
এডিবি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা ইতিবাচক দিকে মোড় নিলে তারাও ঋণচুক্তির মেয়াদ বাড়াবে। আর এ ক্ষেত্রেও সবগুলো শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, তারা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করতে প্রস্তুত। তবে এ জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে তারা। এর বাইরে একজন উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়া হবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে বিশ্বব্যাংকের অর্থ পেতে হলে ওই উপদেষ্টাকে সরিয়ে দিতেই হবে।
সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার এখন বিশ্বব্যাংকের দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের বিষয়ে ইতিবাচক সংকেত দিলে ওই উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কেবল শর্ত পূরণ হলেই সংস্থাটি অর্থায়নের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে। ফলে বিষয়টি নিয়ে এখনো একধরনের অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থ পেতে হলে সরকারকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য কী করতে হবে তা বাংলাদেশকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের আপাতত করণীয় কিছু নেই। তিনি আরও বলেন, সরকার পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্বব্যাংককে আনুষ্ঠানিকভাবে জানালে তবেই ওয়াশিংটনে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী একটি চিঠি তৈরি করছেন। শীর্ষপর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত হলে এই চিঠি পাঠানো হবে।
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগে বিশ্বব্যাংক গত ২৯ জুন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন চুক্তি বাতিল করে দেয়। মূলত তিনটি শর্ত পূরণ না হওয়ায় ১২০ কোটি ডলারের এই চুক্তি বাতিল করা হয়। শর্তগুলো ছিল: (১) যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের ছুটি প্রদান, (২) অভিযোগ তদন্তের জন্য দুদকের অধীনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ এবং (৩) আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিশ্বব্যাংকের নিয়োগ করা একটি প্যানেলের কাছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার, যাতে এই প্যানেল তদন্তের অগ্রগতি, ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উন্নয়ন-সহযোগীদের নির্দেশনা দিতে পারে।
শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন গত ২৩ জুলাই পদত্যাগ করলেও গত বৃহস্পতিবার তা গৃহীত হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও সরকারের অবস্থান ছিল—বিশ্বব্যাংক ইতিবাচক সংকেত দিলে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে। সম্প্রতি পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়। এর আগে সরিয়ে দেওয়া হয় সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং সাবেক প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে। বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তালিকায় নাম থাকা একজন উপদেষ্টার ক্ষেত্রে আবার একই নীতি নিয়েছে সরকার। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকের ইতিবাচক সংকেত পেলে সরে যেতে হবে হবে ওই উপদেষ্টাকে।
অন্যদিকে, দুদকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করার বিষয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে খোদ সরকারের সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতু বিষয়ে কমিশনের কোনো করণীয় নেই। যদি সরকার ও বিশ্বব্যাংক কোনো ধরনের সমঝোতা চুক্তিতে আসতে পারে, তবে দুদকের পক্ষ থেকে টার্ম অব রেফারেন্সের কিছু শর্ত; যেমন, বিশ্বব্যাংকের চাহিদামতো তদন্তের তথ্য দেওয়া বা জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের (যাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, তাঁর আপত্তি না থাকলে) থাকতে দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে।’
এদিকে, নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর প্রস্তুতিও সরকার নিয়ে রেখেছে। সেতু বিভাগ এ জন্য নতুন করে দরপত্র আহ্বানের জন্য খসড়া দরপত্র তৈরি করে রেখেছে। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়া চূড়ান্ত প্রস্তাব দেবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি এক সপ্তাহের মধ্যে বহুপক্ষীয় দাতাদের ঋণ দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে। এ কারণে খানিকটা অপেক্ষার নীতি নিয়েছে সেতু বিভাগ।
নতুন করে অর্থায়ন চুক্তি হলে বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ১২০ কোটি ডলার, এডিবি থেকে ৬০ কোটি ডলার এবং জাইকা থেকে ৪১ কোটি ডলার পাবে। এ ছাড়া ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক বা আইডিবি দিচ্ছে ১৪ কোটি ডলার।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের উচিত বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়নের বিষয়টি একটি ইতিবাচক জায়গায় নিয়ে যাওয়া। তবে হাতে সময় বেশি নেই। এডিবির ঋণচুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কাজগুলো করতে হবে। আশা করা যায়, সরকার সেভাবেই আলোচনা চালিয়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.