নারীনীতি-নারীর অগ্রযাত্রা ও বিকাশে সহযাত্রী চাই by বহ্নিশিখা জামালী

নারীনীতিতে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে কোথাও নারীদের সমান অধিকারের উল্লেখ না থাকলেও চিহ্নিত ধর্ম ব্যবসায়ীরা উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অপপ্রচার চালিয়ে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ও তাণ্ডব সৃষ্টি


করে চলেছে স্বাধীনতার গত ৪০ বছরে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নানা প্রতিশ্রুতি নিয়ে অনেকে ক্ষমতায় এলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীদের জীবনের মৌলিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। কোনো সরকারের আমলেই গৃহীত পদক্ষেপগুলোয় নারীদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। ভোটের প্রয়োজনে সবাই নারী ও নারী উন্নয়নের কথা বলেছে, কিন্তু নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আজও পূরণ হয়নি।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান মহাজোট সরকার গত ৭ মার্চ ২০১১ 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি' ঘোষণা করেছে। এ নিয়ে দেশে ১৯৯৭ সাল থেকে চতুর্থবারের মতো নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করা হলো। কিন্তু এসব এখনও পর্যন্ত কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ। নারী উন্নয়ন নীতিতে বিভিন্ন সরকার যেসব সংস্কারমূলক কথাবার্তা বলেছে বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার বিপরীতেই সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। নারী উন্নয়ন নীতি হবে রাষ্ট্রের সব নারীর জন্য। নারীর অধিকার ও মর্যাদার সপক্ষে প্রয়োজনীয় আইন ও ব্যবস্থা গ্রহণের মানসিকতা থেকে ধর্ম-বর্ণ ও জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে বৈষম্যমূলক সব আইন বাতিল করে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে একই ধরনের আইন প্রতিষ্ঠা করাই নারী সমাজের আকাঙ্ক্ষা।
দীর্ঘকাল ধরে নারী সমাজ নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির পাশাপাশি শোষণ, নিপীড়ন, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসমুক্ত সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়ার দাবিতে দেশজুড়ে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত নারীর ওপর নির্মম শোষণ যেমন বন্ধ হয়নি, তেমনি হত্যা, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, যৌন দাসত্ব, এসিড নিক্ষেপ, নারী পাচার প্রভৃতি কোনোকিছুই দূর হয়নি। লাখ লাখ শ্রমজীবী-মেহনতি-কর্মজীবী নারীদের নূ্যনতম মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারেরও কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় নানা সংস্কার এবং বৈষম্যমূলক রীতিনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নারী যেন প্রতিবাদ করতে পারে, আত্মমর্যাদা-আত্মসম্মান নিয়ে দারিদ্র্য, অজ্ঞানতা, অশিক্ষা ও পরনির্ভরতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে সমাজে নারী যেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, নারীনীতিতে নারী সমাজ এ আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন দেখতে চেয়েছিল।
কিন্তু বর্তমান নারীনীতিতে এ আকাঙ্ক্ষার বিশেষ প্রতিফলন নেই। নারী নিজেকে শুধু পণ্য ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত না হয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার লক্ষ্যেই দশকের পর দশক ধরে সংগ্রাম করে আসছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রচিত সংবিধানে নারীদের মৌলিক অধিকারের যেটুকু স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল গত ৪০ বছরে কোনো সরকারের আমলেই সে অধিকার বাস্তবায়নে আন্তরিক ও কার্যকরী উদ্যোগ দেখা যায়নি। বস্তুত এবারও নারীর প্রতি সীমাহীন শ্রেণী ও পুরুষতান্ত্রিক শোষণ, নিপীড়ন ও চরম বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত হয়নি। বর্তমান নারী উন্নয়ন নীতিমালা বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারধর্মী পদক্ষেপ, সদিচ্ছা ও ভালো ভালো শব্দ এবং বাক্যবিন্যাস দিয়ে সাজানো হয়েছে। নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত কিছু সাধারণ কথাবার্তাও উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানে স্বীকৃত নারী অধিকার সংবলিত ধারা এবং নারী অধিকার সংক্রান্ত সিডো সনদের কিছু শব্দ ও বাক্যকে নারীনীতিতে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান নারীনীতিতে সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করার কোনো কথা নেই। ১৯৯৭ সালের ঘোষিত নারীনীতিতে এ ব্যাপারে সরকার যেটুকু উল্লেখ করেছিল এখন সেখান থেকেও সরকার সরে এসেছে। বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, সন্তান লালন-পালন, কৃষি শ্রম, গার্হস্থ্য কাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমানাধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণের ব্যাপারেও এই নারীনীতিতে সুনির্দিষ্ট কিছু নেই। এসব বিষয়ে ধর্ম-বর্ণ ও জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের গণতান্ত্রিক দাবিও চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে।
সন্তান ধারণ, জন্ম নিরোধ ও গর্ভপাত, কর্মসংস্থান ও মজুরির ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বিদ্যমান বৈষম্যের মূলোৎপাটন, শ্রমজীবী-কর্মজীবী মায়েদের জন্য প্রসূতিকালীন সবেতনে অন্তত ছয় মাস ছুটির ব্যবস্থা, অবিবাহিত, স্বামী পরিত্যক্তা ও তালাকপ্রাপ্ত নারীদের উপযুক্ত সম্মান এবং মর্যাদা নিয়ে স্বাধীনভাবে বসবাস করা, তাদের অর্থনৈতিক ও আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা, নারীকে যৌনতার প্রতীক হিসেবে পণ্যে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করা, নারীর সম্মান ও মর্যাদার জন্য ক্ষতিকর সব অপতৎপরতা নিষিদ্ধ এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, সব পর্যায়ে নারীবিদ্বেষী তৎপরতা নিষিদ্ধ করা, খুন, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নারীর ওপর সব সহিংস তৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও শাস্তি প্রদান এবং সর্বোপরি নারীকে পুরুষের মতো স্বাধীন ও পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য করে নীতি প্রণয়নের ব্যাপারেও ঘোষিত নারীনীতিতে সুনির্দিষ্টভাবে বিশেষ কিছু বলা হয়নি।
একদিকে আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকারের প্রগতিশীলতার মুখোশ আর অন্যদিকে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নানা অপপ্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে একূল-ওকূল দুই কূল রক্ষা করতে গিয়ে সরকারের মধ্যে যে দ্বিধা, দোদুল্যমানতা, সীমাবদ্ধান্তহীনতা, পশ্চাৎপদতা ও পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব কাজ করছে নারীনীতিতে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। এ কারণে নারীনীতির প্রশ্নে সরকারের অবস্থান একদিকে প্রচারসর্বস্ব ও অন্যদিকে আত্মসমর্পণমূলক। যেমন সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকারে নারীদের সমানাধিকারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসে ধর্ম ব্যবসায়ীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সরকারের নীতিনির্ধারকরা এখন সকাল-বিকেল বলে চলেছেন, সরকার ধর্মীয় বিধিবিধানের পরিপন্থী কোনো নীতি ও আইন প্রণয়ন করবে না।
২০১১ সালের নারীনীতিতে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে কোথাও নারীদের সমান অধিকারের উল্লেখ না থাকলেও চিহ্নিত ধর্ম ব্যবসায়ীরা উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অপপ্রচার চালিয়ে দেশব্যাপী সাধারণ মাুনষকে বিভ্রান্ত করে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ও তাণ্ডব সৃষ্টি করে চলেছে। সারাদেশে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের মধ্যে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে একটি ধর্মীয় ফ্যানাটিক গোষ্ঠীকে তারা রাস্তায় নামাতে পেরেছে। এদের এ তৎপরতার সঙ্গে আসলে ধর্ম রক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। এরা নারীর আব্রু রক্ষার কথা বলে, কিন্তু নারীকে পণ্যে পরিণত করার বিরুদ্ধে কথা বলে না।
বাস্তব প্রয়োজনে নারীকে আজ ঘরের চার দেয়াল থেকে বেরিয়ে জীবন-সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছে। প্রাকৃতিক ও সামাজিক নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে নারীরা একদিকে যেমন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আবার তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সামাজিক উৎপাদনে যুক্ত হয়ে তারাই পরিবার ও সমাজকে অনেকখানি রক্ষা করে, এগিয়ে নেয়। নারীর এই আত্মশক্তি ও সৃজনী ক্ষমতার তাৎপর্য এবং গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজ আমাদের যেটুকু অগ্রগতি তার পেছনে রয়েছে আমাদের নারীদের বিশাল ভূমিকা। একটি আধুনিক, সভ্য, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে নারীর অগ্রযাত্রা ও তার সার্বিক বিকাশে সহযাত্রী হওয়া, তার এগিয়ে চলার পথ প্রশস্ত করে দেওয়া। কিন্তু এ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সরকার দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান নারীনীতিতেও তার ছাপ রয়েছে। এই নারীনীতিতে কিছু সাধারণ সংস্কারের সঙ্গে কেবল অনেকগুলো সদিচ্ছা ব্যক্ত করা হয়েছে। এসব সদিচ্ছা কোনো আইন নয়। নারীর জীবনে বাস্তব পরিবর্তন ঘটাতে হলে এসব সদিচ্ছাকে আইনে পরিণত করতে হবে। কিন্তু ধর্মান্ধদের আক্রমণের মুখে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত সরকারের পক্ষে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন যে সুদূরপরাহত তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে।

বহ্নিশিখা জামালী : শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর আহ্বায়ক

No comments

Powered by Blogger.