গ্যাস সংকট প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা by মো. ফজলুল হক

প্রাকৃতিক গ্যাস আল্লাহর নিয়ামত, যা বিবিধ শক্তির উৎস। ২০১১ সালের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ২৩টি সচল গ্যাস ফিল্ডে ৮৯টি গ্যাসকূপ রয়েছে। বর্তমানে দৈনিক দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হয়ে থাকে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে আমাদের দৈনিক দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে।


ঘর-বাড়ি, কল-কারখানা, পরিবহন বৃদ্ধির কারণে প্রতিবছর ৭ শতাংশ হারে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য, ৪০ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে, ১৭ শতাংশ শিল্প-কারখানায়, ১৫ শতাংশ ক্যাপটিভ পাওয়ার, ১১ শতাংশ গৃহস্থালি কাজে, ১১ শতাংশ সার উৎপাদনে, ৫ শতাংশ সিএনজি বা পরিবহনে, ১ শতাংশ বাণিজ্যিক ও কৃষিকাজে ব্যয় হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ কম থাকায় ২১ জুলাই ২০০৯ তারিখ থেকে শিল্প-কারখানায় এবং ১৩ জুলাই ২০১০ থেকে আবাসিক এলাকায় নতুন সংযোগ প্রদান বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। কারণ ওই সময়ে গ্যাসের ঘাটতি ছিল। এ ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার পরই নতুন সংযোগের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু কিছু দুর্নীতিবাজের কারণে সরকারের সদিচ্ছা প্রতিফলিত হচ্ছে না। মাটির নিচে পুঞ্জীভূত গ্যাসের সঠিক পরিমাণ নির্ণয় অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। গ্যাস গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যার দ্বারা দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হচ্ছে। নাগরিক জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ গ্যাস ও বিদ্যুৎ এ দুটির মধ্যে গ্যাসের গুরুত্ব সর্বোচ্চ। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনেও গ্যাস প্রয়োজন হয়। এক ঘণ্টা গ্যাস বন্ধ থাকলে হরতাল, ভাঙচুরসহ অনেক ঘটনাই ঘটে থাকে, যা আমাদের দেশে একটা সাধারণ রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, এক দিন গ্যাস বন্ধ থাকলে লাখ লাখ টন কাঠের প্রয়োজন হবে। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় কালো ধোঁয়ার কারণে মানুষ শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবে। ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হবে পুরো দেশ। সুতরাং গ্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এ বিষয়টি আমাদের সবার উপলব্ধি করতেই হবে। গ্যাস বর্তমানে দুভাবে সরবরাহ হয়, পাইপলাইন ও সিলিন্ডারের মাধ্যমে। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই সিলিন্ডারের মাধ্যমে সরবরাহ হয়। পাইপলাইনের গ্যাস বিভিন্ন কারণে অপচয় হয়ে থাকে। যেমন- রান্নার কাজে অসতর্কতার কারণে অপচয় সবচেয়ে বেশি হয়। তা ছাড়া শীতকালে অনেক ক্ষেত্রে রুম গরম রাখার জন্য এবং একটি ম্যাচের কাঠি ব্যবহারের ভয়েও অনেকে গ্যাসচুল্লি জ্বালিয়ে রাখে। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, একটি ডিম ভাজি বা চায়ের পানি বা দুধ তাপ দিতেও চুল্লির চাবি সামান্য ঘুরাতে হয়; কিন্তু দেখা যায় অজ্ঞতার কারণে পুরো মাত্রায় চাবি ঘুরিয়ে গ্যাস ছাড়া হয়। এতে সাধারণত কয়েকটি সমস্যা হতে পারে। যেমন- গ্যাসের অপচয়, অতিমাত্রায় কার্বনডাই-অক্সাইড তৈরি, প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য পুড়ে যাওয়া, খাদ্যের গুণগতমান নষ্ট হওয়া ইত্যাদি। অনেক সময় পানি বা দুধ ফুটন্ত অবস্থায় পড়ে চুল্লি নিভে গিয়ে নির্গমনকৃত গ্যাস দ্বারা অগি্নসংযোগের মতো দুর্ঘটনাও ঘটে থাকে। অন্যদিকে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহারে খরচ বেশি, অপচয় কম। ইটখোলা এবং বিভিন্ন মিল, কল-কারখানায় অপচয়ের মাত্রা অনেক বেশি। গ্যাস সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়ে থাকে নিজ নিজ বিভাগের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে। উল্লেখ্য, গত ২১ জুন পত্রিকায় প্রকাশিত 'ঢাকায় লক্ষাধিক অবৈধ গ্যাস সংযোগ' শিরোনামটিতে পেট্রোবাংলার কিছু অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে অবৈধ সংযোগের ঘটনা ঘটে, যা এ জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এর সত্যতা প্রমাণিত হলে কয়েকটি প্রশ্ন জাগে। যারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের সততা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, দেশপ্রেম- সবই প্রশ্নবিদ্ধ। বিগত কোনো সরকারই গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সমস্যা সমাধানে শতভাগ সফলতা দেখাতে পারেনি এই দুষ্ট চক্রের কারণে। আমাদের দেশে উত্তোলন ও সরবরাহের জটিলতাই বড় সমস্যা বলে ধারণা করা যায়। গ্যাসের প্রচুর মজুদ রয়েছে। পেট্রোবাংলার ভাষ্যমতে, বর্তমানে দৈনিক উৎপাদন দুই হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট ছাড়িয়ে গেলেও তা সরবরাহের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। বর্তমানে জ্বালানি তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। উল্লেখ্য, কুইক রেন্টাল দ্বারা সাময়িক বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ সম্ভব। তবে এর ধারাবাহিকতা বহাল থাকলে দেশ দেউলিয়া হতে বাধ্য। আমাদের উত্তোলনের জন্য প্রযুক্তির অভাব। ফলে বেশির ভাগ গ্যাস বা টাকা নিয়ে যাচ্ছে উত্তোলনকারী বিভিন্ন বিদেশি কম্পানি। সিলেটের হরিপুর গ্যাসকূপ থেকে বিগত পাকিস্তান আমল থেকে গ্যাস বের হয়ে যাচ্ছে। এমনকি পাহাড়ের গায়েও ভাত-তরকারি রান্না করে খাচ্ছে স্থানীয় অনেকেই। ওই কূপটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে পাকিস্তান আমলেই। এভাবে অপচয় হতে থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে গ্যাস ফুরিয়ে যাবে। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হচ্ছে, সমুদ্রজয়ে আমাদের অতিরিক্ত প্রাপ্তি ১২টি ব্লক, সেখান থেকেও আমরা পাব আরো অনেক গ্যাস। গ্যাসের অপচয় রোধে নিজ নিজ বাসাবাড়ির গ্যাস ব্যবহারে আন্তরিক হতে হবে। ঢালাওভাবে গ্যাস সরবরাহের পরিবর্তে সিলিন্ডারের মাধ্যমে সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অপচয় রোধকল্পে বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন পর্যায়ে গ্যাস মিটারের ব্যবস্থা করা অতীব জরুরি। অবৈধ সরবরাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সিএনজি, ইটখোলায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা প্রয়োজন। বিগত সরকার যে উদ্দেশ্যে গ্যাসচালিত সিএনজি গাড়ি আমদানি করেছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি। মিটারের মাধ্যমে ভাড়া আদায় তো দূরের কথা, ৫০ টাকার দূরত্বের জন্য ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। সিএনজিচালিত পরিবহনের অবাধ চলাচলের কারণে যানজটের মাত্রা বেড়েই চলছে ঢাকাসহ অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরে। গ্যাসচালিত গাড়ির সংখ্যা হ্রাস পেলে যানজটও হ্রাস পাবে- এটাই বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। সব কথার শেষ কথা, সবাইকে হতে হবে সৎ ও দেশপ্রেমিক। এ জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা। আমাদের দেশে বর্তমানে যেহেতু গ্যাসের মজুদ অনেকটাই আশাব্যঞ্জক, তাই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণে প্রাধান্য দিতে হবে। শুধু গ্যাসই নয়, সব ক্ষেত্রেই সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ স্থান থেকে দেশের সার্বিক উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে সবাইকে। তবে গ্যাসের পাশাপাশি বিদ্যুতের অভাবও দূর হবে, যা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশাবাদী।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।
fhoque.hstu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.