আজ বিশ্ব সেবা দিবস-সরকারি হাসপাতালে নার্স-সংকট by শেখ সাবিহা আলম

সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে নার্স-সংকট প্রকট। কোথাও কোথাও নার্স আছেন অনুমোদিত পদের প্রায় অর্ধেক। ফলে রোগীরা মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না। অথচ নিয়োগের অপেক্ষায় থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার নার্সের সরকারি চাকরি পাওয়ার বয়স পেরিয়ে গেছে। প্রশিক্ষিত আরও প্রায় নয় হাজার নার্স আছেন বেকার।


এই সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাত হাজার নার্স নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু নার্স নিয়োগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ ঘুরপাক খাচ্ছে চিঠি চালাচালিতে।
এই বাস্তবতায় আজ ১২ মে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব সেবা দিবস।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিভিন্ন জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব স্থানে নার্সের অনুমোদিত পদের প্রায় অর্ধেকই শূন্য। নার্স-সংকটের কারণে হূদেরাগ, নিউরো সার্জারি, ক্যাজুয়ালটি, বার্ন ও জরুরি বিভাগে সেবা দিতে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রাতের পালায় সংকট আরও তীব্র হয়।
এক হাজার ৭০০ শয্যার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গড়ে ভর্তি থাকে সাড়ে তিন হাজার রোগী। বহির্বিভাগে সেবা নেয় গড়ে দৈনিক এক হাজার রোগী। এই হাসপাতালে নার্স আছেন ৬০০-র কিছু বেশি। ফলে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই হাসপাতালে কমপক্ষে এক হাজার নার্স দরকার। জরুরি, নিউরো সার্জারি, ক্যাজুয়ালটি ইত্যাদি বিভাগ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখনো খবর নেই।
পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে নার্সের অনুমোদিত পদ ৩৭টি, আছেন ১৮ জন। নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনুমোদিত ১৫টি পদের বিপরীতে নার্স আছেন আটজন। ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্স মনোয়ারা খাতুন বলেন, অসুবিধা হলেও অর্ধেক জনবল দিয়ে তাঁদের কাজ চালাতে হচ্ছে।
দেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালের অবস্থাই এ রকম।
অথচ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা ফারজানা আক্তার বলেন, তিনি সরকারি চাকরির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বয়সই পেরিয়ে গেছে। তাই এখন ঘরকন্নায় মন দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ডিপ্লোমা বেকার নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বেকার নার্সের সরকারি চাকরির বয়স চলে গেছে। প্রশিক্ষিত নয় হাজার নার্স রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। অথচ সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই বলেন নার্সের অভাবে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।
তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরও নার্স নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। যাঁদের সরকারি চাকরির বয়স চলে গেছে, তাঁদের জন্য কী করা যায়, তা নিয়েও আলাপ-আলোচনা চলছে।
নার্স নিয়োগের নথির ঘুরপাক: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ সালের ১৬ জুন সাত হাজার নার্স নিয়োগের ঘোষণা দেন। এর মধ্যে দুই হাজার শূন্যপদে নিয়োগসহ নতুন পাঁচ হাজার সিনিয়র স্টাফ নার্সের পদ সৃষ্টি করা হবে।
শেখ হাসিনা ২০১১ সালের নার্স সমাবেশেও একই ঘোষণা দেন। ওই সমাবেশের পর ২১ আগস্ট স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিপুল চাহিদা মেটাতে বেশি সংখ্যায় নার্সের পদ সৃষ্টি করা আবশ্যক।
নথিপত্রে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত বছরের ১৯ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে অনুরোধ করা হয়। নার্স নিয়োগ নিয়ে ১৯ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি কর্মকমিশনের মধ্যে চার দফা চিঠির আদান-প্রদান হয়েছে। কিন্তু নিয়োগপ্রক্রিয়া এগোয়নি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন সময়ের দাবিদাওয়া ও বেকার নার্সদের আন্দোলনের কারণে ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিপ্লোমাধারী নার্সদের ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নার্সদের পদমর্যাদা তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করায় নার্স নিয়োগের বিষয়টি এখন সরকারি কর্মকমিশনের হাতে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় দুই হাজার শূন্যপদে আগের নিয়মে নিয়োগ দিতে চাইলেও এ কারণে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন শহীদুল ইসলাম, পঞ্চগড় ও মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালী]

No comments

Powered by Blogger.