কপোতাক্ষ-মধুমতীর তীর থেকে-চিংড়ি চাষে বিপন্ন জীবন by আমিরুল আলম খান

বিশ্বব্যাপী চলছে পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড। সে জন্য প্রধানত দায়ী বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। বিজ্ঞানীরা এখন মোটামুটি একমত যে বিশ্ব উষ্ণায়ন হচ্ছে মানুষের সীমাহীন লোভের ফল। উন্নয়নের পশ্চিমা মডেল প্রত্যাঘাত হানছে মানব সভ্যতাকেই।


আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার ভিত্তি জীবাশ্ম জ্বালানি আর তা থেকে উত্পন্ন কার্বন গ্যাস বিশ্ব তাপমাত্রা এমনভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে যে তাপমাত্রার আর মাত্র দেড় থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পৃথিবীর ধ্বংসের কারণ হতে পারে। কোপেনহেগেন সম্মেলনের পর মানব জাতি এর কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারবে কি না সে জন্য আমাদের আরও বছরখানেক অপেক্ষা করতে হবে। তবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল যে মারাত্মক হুমকির মুখে তা এখন সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে। জার্মানওয়াচ-এর এক গবেষণায় বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে বাংলাদেশ।
কিন্তু স্থানীয়ভাবে আমাদের কর্মকাণ্ডও কি এ জন্য কম দায়ী? এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপন্ন। বিপন্ন জীববৈচিত্র্য। সে চিত্র এখন প্রতিদিনের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। ২০০৭ সালের নভেম্বরে ভয়ংকর সিডর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হানে। তার ক্ষত নিরাময় হওয়ার আগেই দক্ষিণ-পশ্চিম সমুদ্র উপকূলে পুনরায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। প্রাচীরের মতো দুর্ভেদ্য সুন্দরবন না থাকলে সে আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি কত ভয়াবহ হতো তা কল্পনা করাও অসম্ভব।
বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, অনাবৃষ্টি-দাবদাহ, বন্যা-তুষারঝড়, ভূকম্প, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস-সুনামি এখন নিত্য সংবাদ। প্রতি মাসে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও অস্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে। এমনকি, ইউরোপ-আমেরিকার যেসব দেশের এ ধরনের পুরোনো অভিজ্ঞতা প্রায় নেই, সেসব দেশও এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার। বিপুল অর্থ-বিত্ত, উন্নত প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে তারা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন বাংলাদেশের নিত্যসঙ্গী। গরিব ও অনুন্নত দেশ বলে তার ধকল সামলে ওঠা বাংলাদেশের জন্য খুব কঠিন। সিডর-আইলাদুর্গত এলাকার মানুষের জীবন এখনো বিপন্ন। সাম্প্রতিককালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা প্রতিবেদন পাঠ করলে তার কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লোনাপানির মধ্যে বাস করা লাখ লাখ মানুষের এখন খাবার পানির প্রবল সংকট। সংকট মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপ খুবই অকিঞ্চিত্কর। প্রতিদিন ট্রলারে করে তাদের কাছে খাবার পানি পৌঁছে দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এ অঞ্চলের মানুষ পুকুরের বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সেই মিষ্টিপানি পান করে। লোনাপানি ঠেকানোর জন্য নির্মিত বেড়িবাঁধ সিডর-আইলার আঘাতে ভেঙে যায়। প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাসে লোনাপানি পুকুরে ঢুকে পড়ায় মিষ্টিপানির সেই উৎস গেছে নষ্ট হয়ে। প্রায় দুই বছর পরও তাদের খাবার পানির কোনো সমাধান হয়নি। প্রথম আলোয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চকবাড়া গ্রামের আবুল হোসেন গাজীর বক্তব্য পাঠ করলে কারবালার দৃশ্যই যেন মানসপটে ভেসে ওঠে—‘লোনাপানির সঙ্গে লড়াই করে হেইরে গেলাম। এত দিন পেটের পীড়া সহ্য করে গাঙ্গের পানি খেইয়েছি, এখন তাও লোনা হয়ে বিষের মতো হই গেছে। কী করব, তাই সবকিছু নিয়ে গ্রামছাড়া হচ্ছি।’ (প্রথম আলো, ১০-২-২০১০)। কিন্তু বেড়িবাঁধগুলো ভাঙল কেন?
‘বেড়িবাঁধগুলানকে ঘের-বাড়ির লোকেরা আগে থাকি ঝাঁজরা বানাই রাখিছে। বাঁধ কাটি স্লুইস বানাই আর ফুটা করি পাইপ ঢুকাই বাঁধের হায়াত আগেই অর্ধেক শেষ করি রাখিছে। সিডর আর আইলার ধাক্কায় তাই সব বাঁধ হুড়মুড় করে ভাঙ্গি পড়িছে।’ (প্রথম আলো, ৯-২-২০১০)। খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের জালাল গাজীর এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে এসব বেড়িবাঁধ ভাঙার মূল কারণ চিংড়ি ঘের মালিকদের সীমাহীন লোভ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ।
প্রথম আলো আরও জানাচ্ছে,‘পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার বিভাগীয় কার্যালয়ের হিসাবে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার এক হাজার ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আইলা ও সিডরের আঘাত থেকে রক্ষা পেয়ে এখনো টিকে আছে। স্থানীয় চিংড়ি ব্যবসায়ীরা এই বাঁধগুলোতে অবৈধভাবে প্রায় আড়াই হাজার স্লুইসগেট করেছেন। বাঁধে প্রায় ১০ হাজার ফুটো করে পাইপ দিয়ে লোনাপানি ঢোকানো হচ্ছে ভেতরে।
দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়ন, কয়রা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নদীপথ ধরে বেড়িবাঁধের যেখানেই যাওয়া গেছে, সেখানেই দেখা গেছে অসংখ্য অবৈধ স্লুইসগেট। বাঁধ কেটে আনাড়িভাবে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি এই স্লুইসগেটগুলোর দুই পাশের মাটি সরে যাচ্ছে। ফলে জোয়ার-ভাটার পানি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বাঁধের নিচের অংশে ফুটো করে পাইপ ঢোকানো আছে বেশির ভাগ জায়গায়। চিংড়িঘের মালিকেরা বাঁধের এই সর্বনাশ করেছেন ঘেরে পানি ঢোকানোর জন্য।’ (প্রথম আলো, ৯-২-২০১০)।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চিংড়ি চাষ যে অব্যাহতভাবে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে চলেছে, এটি তার একটি খণ্ডিত পার্শ্বচিত্র। তিন দশক আগে সাতক্ষীরায় বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ির চাষ শুরু হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে খুলনা, বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকায়। চিংড়ি চাষকে কেন্দ্র করে উদ্ভব হয়েছে এক নব্য ধনিক শ্রেণীর। তারা শত শত বছরের সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে দিয়ে শোষণ-নির্যাতনের এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে।
চিংড়ির চাষ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশ ধ্বংস করেছে। লোনাপানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করার ফলে জমিতে লবণাক্ততা বেড়েছে ভয়াবহ মাত্রায়। ফলে ধানের চাষ বন্ধ হয়ে গেছে। গবাদিপশু এখন নেই বললেই হয়। বহু প্রজাতির পশুপাখি, জলজপ্রাণী, গাছপালা হয় বিলুপ্ত, নয়ত বিলুপ্তির মুখে। নদী ভরাট হয়ে এখন আবাদি জমি পড়ো জমিতে পরিণত। বাসস্থান, হাটবাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির জলমগ্ন। গত কয়েক বছরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীগুলো ভরাট হয়ে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরার প্রায় ১০টি উপজেলাকে গ্রাস করেছে। ফলে মানুষ গরিব থেকে নিঃস্ব হয়েছে। ধানের জমিতে লোনাপানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধে দাকোপে প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
চিংড়ি চাষ একসময় মানুষের যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিল, তেমনি বাস্তুচ্যুত করেছে অসংখ্য মানুষকে, ক্ষতি করেছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি মানুষকে। এখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে চিংড়ি চাষ আমাদের অর্থনীতিতে যে ইতিবাচক অবদান রেখেছে, ক্ষতি করেছে তার চেয়ে শত গুণ বেশি। সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারছে না মানুষ। কেননা, মানুষ যত সহজে অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে, প্রাকৃতিক ক্ষতি সেভাবে পুষিয়ে নিতে পারে না। বাংলাদেশের মতো গরিব, অনুন্নত ও প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশের পক্ষে তা কত অসম্ভব সিডর-আইলার দুই বছর পরও মানুষের ঘরে ফিরতে না-পারা, খাবার পানির ব্যবস্থা করতে না-পারা, আবাদ করতে না-পারা থেকে তা কিছুটা অনুমান করা যায়। তবে বাস্তব দুরবস্থা সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করা কঠিন। আর বিবেকবর্জিত মুনাফাখোর এবং তাদের মুরব্বিদের পক্ষে তা উপলব্ধি করা হয়তো একেবারেই অসম্ভব!
আমিরুল আলম খান, শিক্ষাবিদ।
amirulkhan7@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.