সদরে অন্দরে-তবু যেতে হবে অনেক দূর by মোস্তফা হোসেইন

উল্লাসে মাতোয়ারা শিক্ষার্থীরা। স্কুল প্রান্তরে উচ্ছ্বসিত শত শত ছাত্রছাত্রী। কোনো বাধা নেই শিক্ষকদের কাছ থেকে। তাঁরাও সেই প্রাণের উচ্ছ্বাসে শরিক। আপ্লুত হয়েছিলাম আমরা অভিভাবকরাও। ঘটনা ৭ মের। এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন।


পরদিন পত্রিকাগুলো বড় হেডিং দিয়ে সেই উচ্ছ্বাসের ছবি প্রকাশ করে আমাদের আবারও জানিয়ে দেয়- ওই দেখো বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ। সত্যিই মন ভরে যায় শিক্ষার্থীদের এই বিজয় দেখে। আগামী বাংলাদেশের সাফল্য চিন্তা করে। তাই তো। একে একে আমাদের সোনামণিরা কত এগিয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতো ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। আর এখন কৃতকার্য হয় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। শাবাশ আমাদের সন্তানরা! ফলের দিক থেকে এই অগ্রগতি আমাদের উচ্ছ্বসিত করছে ঠিকই, তবে ফলের ভিত্তি তথা গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়? প্রশ্নটি এসে যায় বিজ্ঞজনদের মন্তব্য শোনার পর। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী থেকে শুরু করে অনেক গুণীজনই সন্দেহ পোষণ করেছেন শিক্ষার মান নিয়ে। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের একটি বক্তব্যেও সেই ইঙ্গিতই রয়েছে। সংগত কারণেই এবার আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে শিক্ষার মানের দিকে নজর দিতে হবে। আর এই মানের প্রশ্ন এলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষালয়ের অবস্থানগত দিক, পারিপার্শ্বিক আরো কিছু বিষয় আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে।
আমাদের দেখতে হবে, স্থানিক বিবেচনায় ফলের তারতম্য এখনো বিশাল। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ৮২ হাজার ২১২ জন জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে বড় একটি অর্জন। কিন্তু এই সুফলের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা সুবিধা ও শিক্ষা পরিবেশের বৈষম্যটিও স্পষ্টভাবে দেখা দেয়। এবারও গ্রামের শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বোর্ডের ফল বিশ্লেষণ করা যেতে পারে- এখানে উত্তীর্ণদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৫ হাজার ৬২৯ জন। তাদের ১৫ হাজার ৩৬৮ জনই ঢাকা মহানগর এলাকার স্কুলগুলোর শিক্ষার্থী। বাকি ১০ হাজার ২৬১ জন শিক্ষার্থী ঢাকা বোর্ডের অধীন আরো ১৭টি জেলার অধিবাসী। এতেই বোঝা যায়, গ্রাম আর শহরের ব্যবধান কতটা। পরীক্ষার্থীর সংখ্যার অনুপাতেও সেই হিসাব আমাদের ভাবিয়ে দেওয়ার মতো।
সেরা স্কুলের চিত্র যদি দেখি তাহলে সেখানেও গ্রাম আর শহরের ব্যবধান আমাদের না ভাবিয়ে পারে না। উদাহরণ হিসেবে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা বোর্ডের পরিসংখ্যানের দিকে তাকাতে পারি। চট্টগ্রাম বোর্ডের সেরা কুড়িটি স্কুলের মধ্যে ১৪ ও ১৫তম স্থান লাভকারী দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবই শহর এলাকার। কুমিল্লা বোর্ডের সেরা কুড়িটির মধ্যে নিভৃত পল্লীর একটি প্রতিষ্ঠানও স্থান লাভ করতে পারেনি। কুমিল্লা বোর্ডে ১৪তম স্থান লাভকারী কুমিল্লার লাকসাম পাইলট হাই স্কুল ও ২০তম স্থান লাভকারী নোয়াখালীর হাতিয়া এ এম হাই স্কুল দুটি জেলা শহরের বাইরে হলেও দুটিই উপজেলা কেন্দ্রে অবস্থিত। গ্রাম স্পষ্টতই সেখানে অনুপস্থিত।
সেরা কুড়িতে স্থান না পেলেও গ্রামের স্কুলগুলো যদি মোটামুটি ভালো ফল করতে পারত তাহলেও হয়তো উদ্বেগের কারণ হতো না। গ্রামের অধিকাংশ স্কুলই বোর্ডের পাসের হার থেকে অনেক পিছিয়ে। যে ১৪ স্কুলের শিক্ষার্থীদের শতভাগ অকৃতকার্য হয়েছে সেগুলোও গ্রামেরই প্রায় সব। গ্রামের স্কুলগুলোর অবস্থা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার কিছু তথ্য জানার সুযোগ হয়েছে। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৯। এই উপজেলায় শতভাগ অকৃতকার্য হওয়া স্কুলের রেকর্ড যেমন আছে আবার বোর্ডের হারের চেয়ে প্রায় অর্ধেক হারে শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। সেখানকার স্কুলগুলোর খারাপ ফল করার কারণ সম্পর্কে চান্দলা কে বি হাই স্কুল, সিদলাই আশরাফ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, শশীদল আলহাজ আবু তাহের কলেজের অধ্যক্ষ, চান্দলা কে বি হাই স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খান চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে খারাপ ফল করা অন্য স্কুলগুলো সম্পর্কেও ধারণা হবে। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শতভাগ অকৃতকার্য হওয়া স্কুলটি এ বছরই প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। যে কারণে উপজেলার সামগ্রিক ফলচিত্রকে মলিন করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখলেও মানিয়ে নেওয়ার যুক্তি থাকে। কিন্তু শতবর্ষী পুরনো কোনো স্কুল যদি বোর্ডে পাসের হারের চেয়ে প্রায় অর্ধেক হারে শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয় তখন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হয়।
এ ক্ষেত্রে নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার বেঞ্জামিন ডি কস্টার বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। তাঁর কথা শিক্ষার্থীর ভালো ফল করার পেছনে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের যৌথ প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা প্রয়োজন হয়। স্বাভাবিক কারণেই এই তিন উদ্যোগের সঙ্গে আরো কিছু বিষয়ও যোগ হতে পারে। তা হচ্ছে ব্যবস্থাপনাগত ও পরিবেশগত। অভিভাবক সচেতনতা না থাকলে শিক্ষার্থীর ভাগ্য খোলা কঠিন। শহরের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার জন্য যেভাবে অভিভাবককে লেগে থাকতে দেখা যায়, গ্রামে কি সেই অবস্থা আছে? এই প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল আলহাজ আবু তাহের কলেজের অধ্যক্ষ এবং চান্দলা কে বি হাই স্কুল পরিচালনা কমিটির বিদ্যোৎসাহী সদস্য ছৈয়দ আবদুল কাইউমের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা যায়। এক রাতে ৯টার দিকে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া তদারকি করতে এক বাড়িতে গিয়ে দেখেন ছাত্রী লেপ গায় দিয়ে ঘুমোচ্ছে, বাবা-মা তার বিছানার পাশে বসে টেলিভিশন দেখছেন। একজন শিক্ষকের উপস্থিতির পর বাবা-মা বুঝতে পেরেছেন তাঁর সন্তানটির লেখাপড়ায় তাগাদা দেওয়ার দায়িত্ব তাঁরও।
শিক্ষার্থীর অনিয়ম কিংবা শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কোনো পরামর্শের প্রয়োজনে অভিভাবককে যদি স্কুলে ডাকা হয় তাহলেও তিনি সেখানে যান না কম প্রয়োজনীয় মনে করে। অভিভাবকের ধারণা, তাঁর সন্তানটি স্কুলে গেছে সুতরাং ওই শিক্ষার্থীর সামগ্রিক দায়িত্ব এখন স্কুলের। তাঁদের সামনে উদাহরণ থাকে কোনো মেম্বার কিংবা সভাপতিকে অনুরোধ করে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি। মেম্বার কিংবা প্রেসিডেন্টও চিন্তা করেন কোনো অভিভাবকের যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক সুপারিশ কার্যকর করতে পারলে ওই অভিভাবকের সমর্থন থাকবে তার প্রতি। অভিভাবকের সমর্থন প্রত্যাশার কারণে শিক্ষার্থীর ফল বিপর্যয়কে ডেকে আনলেও গ্রামের স্কুলগুলোতে সে কাজটিই হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে।
গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সবচেয়ে বড় অভাব হচ্ছে দক্ষ শিক্ষকের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় শিক্ষক নিয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। স্থানীয় কিংবা অস্থানীয় নির্বিশেষে শিক্ষকদের মধ্যে বড় ঘাটতি থাকে দক্ষতার। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষতাসম্পন্ন দায়িত্বজ্ঞানপূর্ণ শিক্ষক না থাকায় ফল খারাপ হবেই। এটা আটকে রাখার সুযোগ নেই। দক্ষ শিক্ষক শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে উৎসাহ বোধ করেন না। গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের একাডেমিক কাজে হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায় কোথাও কোথাও। যে কারণে শিক্ষা পরিবেশ বিঘি্নত হয়।
গ্রামের পরিবেশ ও অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবকে পুঁজি করে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও শিক্ষা উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কোনো কোনো এলাকায় স্কুল পরিচালনায় দলীয় প্রভাবও ব্যাপকতর। শিক্ষায়তনগুলো সুষ্ঠু কর্ম পরিচালনার এবং তদারকির জন্য সরকার যথাযথ ভূমিকা পালন করলেও গ্রামের এই দুরবস্থা কেটে উঠতে পারত। উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা কর্মকর্তা এবং একাডেমিক সুপারভাইজার কাজ করে থাকেন। তাঁদের তদারকি যদি সুষ্ঠু হয় তাহলেও কিছুটা উপকার হতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে স্কুলকে নিজেই নিজের পথ প্রশস্ত করতে হবে। দক্ষ শিক্ষকের অভাব পূরণ করা, অভিজ্ঞ এবং দক্ষ প্রধান শিক্ষক থাকা, ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও আন্তরিকতা, শিক্ষার্থীকে উদ্বুদ্ধকরণ ও পথনির্দেশনার মতো জরুরি কাজগুলো যথাযথ না হলে গ্রামের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের ফল বিপর্যয় এড়ানো যাবে না।
লেখক : সাংবাদিক
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.