কুকুরের মমতা by পবন চক্রবর্তী

সেদিন বিকেলে মিশেলের হাঁটতে ইচ্ছে হলো। তিনি উঁচু গলায় ডাকলেন, ‘মিকি, বজ, এদিকে এসো।’ দুটো কুকুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উড়ে এল। তারা মিশেলের পায়ের কাছে বসে লেজ নাড়ছে। মিশেলের বয়স ৬৬ বছর। হাঁটার জন্য ৬৬ খুব মারাত্মক বয়স নয়।


এই বয়সে লোকে বরং একটু বেশি হাঁটে। মনের সুখে হাঁটে, এ রকম নয়। এই সময়ের হাঁটাহাঁটির ইতিহাস বিচিত্র। তবে সবচেয়ে কমন। কারণ, বালামুসিবত থেকে দূরে থাকতে হবে। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ—এসব ঠেলে মজা পুকুরে ফেলে দিতে হবে।
এই মুহূর্তে মিশেলের ক্যাথরিনের কথা মনে পড়ছে। তিনি যত দিন ছিলেন, তাঁরা রোজ হাঁটতেন। নিয়ম করে হাঁটাচলা করেও ক্যাথরিন রক্ষা পেলেন না। মারা গেলেন ক্যানসারে। স্ত্রীর মৃত্যুতে মিশেল খুব চোট পেলেন। তাঁর হাঁটাচলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। সারা দিন ঘরে থাকেন। তিনি প্রাণপণে একা থাকার অভ্যাস করতে লাগলেন।
মিকি আর বজ আসার পর মিশেলের অভ্যাসে ছেদ পড়ল। জ্যাক রাসেল টেরিয়ার প্রজাতির এই দুটো কুকুর তিনি খুব দ্রুত পছন্দ করে ফেললেন। এখন বাড়িতে তারা তিনজন।
তিনজন মিলেই সেদিন বেড়াতে বের হয়েছিলেন। ব্রিক্সহ্যাম জায়গাটা বেশ নির্জন। এ রকম স্থানকে কবিরা বলেন নৈসর্গিক। মিশেল ভাবলেন, তিনি নিসর্গ ভালোবাসেন। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, মিকি আর বজকেও তিনি ভালোবাসেন। নিজের ভালোবাসার ক্ষমতায় তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
সরু রাস্তা, দুই দিকে খাঁড়ি। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছেন মিশেল। কুকুর দুটো তাঁর পেছন পেছন আসছে। হঠাত্ মিশেলের পা পিছলে গেল। পড়তে পড়তে নিচের দিকে তাকিয়ে মিশেল ঘাবড়ে গেলেন। নিচের গাছগুলোকে ছোট দেখাচ্ছে। তিনি দিব্যচোখে ক্যাথরিনকে দেখতে পেলেন। সেখানে পৌঁছাতে আর দেরি নেই তাঁর। এই আশু মিলনের কল্পনায় তিনি আনন্দিত হলেন না, তাঁর বুক ধুকপুক করতে লাগল।
ধপাস করে মিশেল একটা গাছের সঙ্গে বাড়ি খেলেন। তারপর গিয়ে আটকে গেলেন আরেকটা গাছে। জেসাসকে ধন্যবাদ! একেবারে তলায় গিয়ে গোত্তা খাননি। ঘাড় ঘোরাতে চাইলেন, কোনো সুবিধা হলো না। বাড়ি খেয়ে তাঁর ঘাড় ভেঙেছে। একটু পর আবিষ্কার করলেন, হাতের কনুই অচল। মিশেল অষ্টবক্রের মতো নিশ্চল পড়ে আছেন।
কিছুক্ষণ পর মিশেল অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিকি আর বজ। তাঁর শরীরের দুই জায়গার হাড় ভেঙেছে। তার পরও গভীর আনন্দ হলো তাঁর। মিশেলের শরীর অচল, কিন্তু তাঁকে পাহারা দেওয়ার জন্য আছে মিকি আর বজ। তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী।
সন্ধ্যা নামছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে। মিশেল শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে আরম্ভ করলেন। দুটো জ্যাক রাসেলের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো না। দুজন মিলে জড়িয়ে ধরল মিশেলকে। প্রায় কোলে তুলে নিয়েছে ওরা।
রাত বাড়ছে। একটা একটা করে তারা ফুটছে আকাশে। মিকি আর বজের দিকে তাকালেন মিশেল। গভীর ভালোবাসা নিয়ে ওরা তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। শীতে ওদের অবস্থাও কাহিল।
মিকি আর বজের কোলের মধ্যে মিশেলের ১৬ ঘণ্টা পার হলো। এক পথচারী ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি প্রায় হোঁচট খাচ্ছিলেন মিশেলের সঙ্গে। এ রকম অদ্ভুত ঘটনা তিনি বোধহয় আগে কখনো দেখেননি। জবুথবু অবস্থায় প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে আছেন একটা লোক, পাশে বসে পাহারা দিচ্ছে দুটো কুকুর। মিশেলের অবস্থা তখন ভয়াবহ। শরীর নিস্তেজ হয়ে গেছে। ভাঙা ঘাড় আর কনুইয়ে অসহ্য ব্যথা করছে।
পথচারী লোকটি ইমারজেন্সি সার্ভিসে খবর দিলেন। ডেভন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে নেওয়া হলো টরবে হাসপাতালে। সেখানে মিশেলের সার্জারি হয়েছে। চিকিত্সকেরা আশা করছেন, শিগগিরই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন তিনি।
আর মানুষ মনে রাখবে মিকি আর বজকে। মানুষের মতোই ওরা ভালোবাসতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.