জন্মদিন-মানুষকে ভালোবাসতেন যিনি by জাহীদ রেজা নূর

বলা হয়, মানুষ একবারই জন্ম নেয়, মরে বারবার। আপসে আপসে নিজেকে বদলে নেয় যখন-তখন। নিজের ভুলগুলো অক্লেশে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে শরীরে মেখে নিতে চায় শুভ্রতার রং। কিন্তু যে মানুষটিকে নিয়ে কথা, তিনি যেন একবারই মরবেন বলে করেছিলেন ধনুর্ভঙ্গপণ।


বহুদিন ধরে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় এগিয়ে যাওয়া এই জনপদে একসময় স্বাধীনতার ইতিহাস এগিয়েছে তারই চলার পথ ধরে। নইলে একটি মানুষের অবয়বে কী করে ধরা পড়ে গোটা দেশের মানচিত্র? কী করে একজন মানুষের অঙ্গুলিহেলনে ঐক্যবদ্ধ হয় গোটা জাতি?
আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু মানুষ ছিলেন। মানুষের বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা, ক্রোধ, ঘৃণা, ভুল সবই ছিল তাঁর ভেতরে। মানুষ বলেই সেগুলো ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষকে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট যখন প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় গুণ কী?’ উত্তর এল, ‘আমি মানুষকে ভালোবাসি।’ সেয়ানা সাংবাদিক ফ্রস্টের পরের প্রশ্ন, ‘আর দুর্বলতা?’ এবারের উত্তর, ‘আমি মানুষকে বড় বেশি ভালোবাসি।’ প্রশ্ন ও উত্তরের এই দ্বৈরথেই অনুভব করা যায় মানুষটিকে। মানুষকে বেশি ভালোবাসার পরিণাম যে ভালো হয়নি, তা তো ইতিহাসই বলে দিচ্ছে। নাকি প্রসঙ্গটির অন্য রকম ব্যাখ্যা আছে? তিনি যাদের মানুষ বলে মনে করতেন, তাদের অনেকেই দেখতে মানুষের মতো হলেও মানুষ ছিল না। ওদের ব্যাপারে শহীদ কাদরীর কবিতা থেকে ধার নিয়ে বলা যায়, ‘অস্বীকার করার উপায় নেই, ওরা মানুষের মতো দেখতে/ এবং ওরা মানুষই/ ওরা বাংলার মানুষ/ এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি শুনব না কোনোদিন।’
দুটো ঘটনার কথা বলি, যা জানিয়ে দেবে, শেখ মুজিব কেন মরার আগে মরার কথা ভাবেননি কখনো। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়, সে মামলা চলতে থাকে। সে সময় ফুঁসে উঠতে থাকে ছাত্র-জনতা। ১৯৬৯ সালের শুরুতে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে কেঁপে ওঠে আইয়ুব খানের ক্ষমতার মসনদ। প্রাণ দেন আসাদ, মতিউর। সে সময় তড়িঘড়ি করে গোলটেবিল বৈঠকের ডাক দেন আইয়ুব খান। কিন্তু শেখ মুজিবকে বলা হয়, প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হবে। ভেবে দেখা যাক পরিস্থিতি। শেখ মুজিব প্যারোলে মুক্তি নিয়ে যাচ্ছেন আইয়ুব খানের সঙ্গে কথা বলতে। কারাগারে থাকছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩৮ জন আসামি। তিনি তাঁদের কী জবাব দিতে পারতেন? একজন অভিযুক্ত আসামি হয়ে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়া হলে মামলাটিও তো পেয়ে যায় গ্রহণযোগ্যতা। সুতরাং, জননেতা হিসেবে তিনি বেছে নিলেন বন্দিত্বই। আসামির তকমা গায়ে জড়িয়ে গেলেন না গোলটেবিলে অংশ নিতে। আইয়ুবকে বোঝালেন, এখন দেশের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য শেখ মুজিবকে আমলে রাখতে হবে। জনগণের প্রবল গর্জনে ভীত আইয়ুবশাহি প্রত্যাহার করে নিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেলেন শেখ মুজিব। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনসভায় তাঁকে দেওয়া হলো ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি। এই জোয়ারেই বাংলার মানুষ চিনে নিল তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতের। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেপ্তার করেছিল বঙ্গবন্ধুকে। এ নিয়ে অনেকেই করেন তাঁর সমালোচনা। ভেবে দেখেন না, বঙ্গবন্ধু জাতীয় নেতাদের বলে দিয়েছিলেন প্রস্তুতি গ্রহণ করতে। তিনি কেন গেলেন না? গেলেন না এই জন্য যে নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা পালিয়ে যেতে পারেন না। বিশ্ব জানবে, পাকিস্তানি সরকার অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করেছে জননেতাকে। বিশ্ব জানবে, জনগণের এই সংগ্রাম আসলে মুক্তিযুদ্ধ; বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়।
সেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারত পাকিস্তানিরা। এই ঝুঁকি ছিলই। তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়িতে থেকে যাওয়ার ঘটনা তাই রাজনৈতিক বিজ্ঞজনোচিত সিদ্ধান্ত। ইতিহাস বলে, তিনি ভুল করেননি। যে কারণে স্বাধীনতার এই স্থপতি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কারাগারে থাকলেও তাঁরই প্রেরণা ছড়িয়ে গেছে সত্তায় সত্তায়, এ কথা অস্বীকার করবে কে?
১৯২০ সালের এই দিনে জন্ম নেওয়া লোকটি তাঁর শৈশব কাটিয়েছেন টুঙ্গিপাড়ার গ্রামে। গ্রামের জল-হাওয়া তাঁকে মানুষ করেছে। তাই তিনি কথাও বলতেন সেই খেটে খাওয়া মানুষের ভাষাতেই। তাঁর কথা বুঝত অজপাড়াগাঁয়ের শিক্ষাবিহীন মানুষটাও।
নেতা অনেক আছেন। সুললিত ভাষায়, কাব্যিক কণ্ঠে কথা বলে মন হরণ করে নিতে পারেন অনেকেই। কিন্তু গ্রামবাংলার জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠে যে ভাষা, যে ভাষায় থাকে মায়ের সত্যিকারের আদরের ছোঁয়া, সে ভাষা চর্চায়-চর্চায় শিখে নেওয়া যায় না, সে ভাষা তৈরি হয় আপনা-আপনি, নিজের ভেতর। সে ভাষার অধিকারী ছিলেন শেখ মুজিব।
তাঁর কি ভুল ছিল না? ছিল। তিনি মানুষ ছিলেন। তাঁর ভুলগুলোও ছিল মানুষের মতোই। ভুল সিদ্ধান্তের কারণে হয়তো ক্ষতিও হয়েছে। কিন্তু জেনেশুনে কাউকে আঘাত করার কথা ভাবতেই পারেননি তিনি। সেই শৈশব থেকে তাঁর ভাবনায় ছিল মানুষ। মানুষের সেবা করে যাওয়ার পথেই হয়তো কখনো ছন্দপতন হয়েছে, কিন্তু তা তাঁর বিশালত্বকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। সত্যিই তো, একটি মানুষের কণ্ঠে লক্ষ-কোটি মানুষের কণ্ঠধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে, এ রকম কটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে এই বাংলায়? আদৌ কি যাবে?
শেখ মুজিবের কথা মনে হলেই তাই চোখে ভেসে ওঠে একটি সবুজ জমিনে রক্তলাল পতাকা, যা পতপত করে উড়তে উড়তে জানিয়ে দেয়, বাঙালিকে ‘দাবায়া’ রাখা যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.