টেলি নেটওয়ার্ক উন্নয়ন-৭৫ কোটি টাকা লোপাটের তোড়জোড় by কাজী হাফিজ

জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি বা জাইকার ঋণের অর্থে দেশে দেড় হাজার কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপনে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে কমপক্ষে ৭৫ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা বলছেন, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতেই এমন অভিযোগ করা হচ্ছে।


জানা যায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) মাধ্যমে বাস্তবায়নের অপেক্ষায় 'টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট' প্রকল্পে ওই কাজের প্রাক্কলিত মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার বা ৯৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। একনেক তা অনুমোদন করে। কিন্তু ঋণচুক্তির সময় জাপানি পরামর্শক কাওয়াবাতা কার্যপরিধি কিছু কমবেশি করলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিটিসিএল ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা রহস্যজনকভাবে ওই প্রাক্কলন অতিমূল্যায়িত করে এ কাজের জন্য প্রায় ৮৮ কোটি টাকা বেশি নির্ধারণ করেন। বিটিসিএল কয়েক বছর ধরে অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপনে মিটারপ্রতি মূল্য ৫০০ টাকার কাছাকাছি নির্ধারণ করে এলেও আলোচিত এ কাজের ক্ষেত্রে এর মূল্য এক হাজার টাকার ওপরে নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ঋণচুক্তির সময় প্রকল্পের কার্যপরিধি কিছু কমবেশি হওয়ায় ওই কাজের মূল্য বড়জোর দুই মিলিয়ন ডলার বাড়তে পারে। কিন্তু বাড়ানো হয়েছে ১১ মিলিয়ন ডলার।
বিটিসিএলের একজন কর্মকর্তার মন্তব্য, টেলিকম ইক্যুইপমেন্টের দাম যখন প্রতিদিনই কমছে, তখন এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে কেন দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়ছে সে প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া দরকার।
এদিকে একটি সূত্র জানায়, প্রকল্পটির প্রাক্কলন অতিমূল্যায়িত করার পরপরই সংশ্লিষ্টদের একজন প্রতিনিধি সম্ভাব্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। প্রস্তাব দেওয়া হয়, কাজ পেতে চাইলে বিশেষ চুক্তিতে রাজি হতে হবে। কিন্তু বিশেষ চুক্তিতে রাজি না হওয়ায় ওই কাজে প্রাক-যোগ্যতার দরপত্রে অংশগ্রহণকারী পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটি বাতিল করা হয়।
বাদ পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে তুরস্কের নেটাস। এ কম্পানির ঢাকা-কক্সবাজার ট্রান্সমিশন লিংকসহ বিটিসিএলের অপটিক্যাল নেটওয়ার্কের বেশির ভাগ কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। নেটাস তাদের অন্যায়ভাবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে- এই অভিযোগে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধি অনুসারে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) রিভিউ প্যানেলের শরণাপন্ন হয়। রিভিউ প্যানেল গত ৬ মার্চ তাদের সিদ্ধান্তে নেটাসের সঙ্গে বিটিসিএলের আচরণকে 'অসঙ্গত কার্য' উল্লেখ করে কম্পানিকে ওই প্রকল্পের কাজে যোগ্য ঘোষণা করে এবং সে অনুযায়ী বিটিসিএলকে ব্যবস্থা নেওয়ারও আদেশ দেয়। এ অবস্থায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় গত ১৮ মার্চ বিটিসিএলকে রিভিউ প্যানেলের ওই আদেশ বাস্তবায়নের জন্য জরুরি নির্দেশ দেয়। ২১ মার্চ বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের সভাতেও সদস্যরা মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশ তথা রিভিউ প্যানেলের আদেশ বাস্তবায়নের তাগিদ দেন। একই সঙ্গে ওই সভায় সদস্যরা কেন আলোচিত প্রকল্পের কাজের প্রাক্কলন অতিমূল্যায়িত করা হলো সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে পরিচালনা পর্ষদকে জানানোরও নির্দেশ দেন। কিন্তু বিটিসিএলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ওইসব নির্দেশ আমলে না নিয়ে গত ৩ মে তাঁদের মূল্যায়নে যোগ্য দুটি কম্পানির আর্থিক দর খোলার ব্যবস্থা করেন।
বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি অনেক জটিল। এ কারণে এখনই কিছু বলা সম্ভব না।
তবে ওই প্রকল্পের পরিচালক অশোক কুমার মণ্ডল বলেন, 'আমরা আইনবহির্ভূত কিছুই করছি না। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৬-এর ২৯ ধারা অনুসারে প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের রিভিউ প্যানেলে আবেদনের কোনো এখতিয়ারই নেই। আমরা এ বিষয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলাম। হাইকোর্ট গত বৃহস্পতিবার রিভিউ প্যানেলের ওই আদেশের ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন।'
অন্যদিকে নেটাসের প্রতিনিধি মুশফিক আনাম বলেন, 'আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ সাত দিনের মধ্যে রিভিউ প্যানেলের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য বিটিসিএলকে নির্দেশ দিয়েছেন। বিটিসিএল তাদের রিট আবেদনের ক্ষেত্রে এ তথ্য গোপন করেছে।
কাজের অতিমূল্য নির্ধারণ সম্পর্কে অশোক কুমার মণ্ডল বলেন, অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন কাজের ব্যয় প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করে কার্যপরিধিতে কী কী আইটেম ব্যবহৃত হবে, সেসব আইটেমের কনফিগারেশন, কোন কারিগরি পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে, কী ধরনের এলাকায় ফাইবার স্থাপন হবে ইত্যাদি বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি এবং সেগুলোর খরচের ওপর। বিটিসিএলের মাধ্যমে আগে যেসব অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন হয়েছে তার চেয়ে আলোচিত এ প্রকল্পের কাজের মান হবে অনেক উন্নত। এ প্রকল্পের কার্যপরিধিতে প্রায় ৭২ কিলোমিটার ফোর ওয়ে, ১১০ মিলিমিটার পিভিসি ডাক্ট ও ১৬০টি ম্যানহোল রয়েছে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দুটি নদীর তলদেশ দিয়ে বোরিং করে স্টিল পাইপ স্থাপনের মাধ্যমে ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার অপটিক ফাইবার কেব্‌ল স্থাপন করা হবে। এটাও ব্যয়বহুল। এ ছাড়া এই প্রকল্পে অপটিক ফাইবার কেব্লের অর্ধেকই অত্যাধুনিক হরাইজন্টাল ডাইরেকশনাল ড্রিলিং (এইচডিডি) পদ্ধতি ব্যবহার করে স্থাপন করা হবে। ওপেন কাট পদ্ধতিতে অপটিক ফাইবার কেব্‌ল স্থাপন অপেক্ষা এইচডিডি পদ্ধতিতে অপটিক ফাইবার কেব্‌ল স্থাপনের ব্যয় অনেক বেশি। এ পদ্ধতিতে অপটিক ফাইবার কেব্‌ল স্থাপন করা হলে মাটির অনেক নিচ দিয়ে কেব্‌ল বসানো যায়। ফলে তা নিরাপদ থাকে।
তিনি আরো জানান, ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে অনুমোদিত প্রকল্পের ডিপিপিতে ফাইবার নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য অনেক কম (৮২৪ কিলোমিটার) উল্লেখ রয়েছে। সরকার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য পরে যত দূর সম্ভব বেশি এলাকা অপটিক ফাইবার নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে গিয়ে নেটওয়ার্কের পরিধি বেড়ে এক হাজার ৫১৪ কিলোমিটার করা হয়েছে, ফলে স্বাভাবিকভাবে ওই কাজের প্রাক্কলিত মূল্যও বেড়েছে। নেটওয়ার্কের এই পরিধি বৃদ্ধির বিষয়টি পরবর্তীতে ডিপিপির সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.