সপ্তাহের হালচাল-সাংসদেরা কি পথ হারাইয়াছেন? by আব্দুল কাইয়ুম

রাজনীতি যে এক ধরনের শিল্পকলা, মূর্তরূপে সুন্দরের প্রকাশ ঘটানোর ক্ষমতা না থাকলে যে রাজনীতি চলে না, এ ব্যাপারে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা সম্ভবত উদাসীন। নইলে সংসদ অধিবেশনে সাংসদদের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হয় কীভাবে? এটা যে লজ্জার ব্যাপার, সেটাও হয়তো তাঁরা বুঝতে চান না।


স্পিকার যখন বললেন, সংসদ অধিবেশনে আর কাউকে অশালীন কথা বলতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ বলেন, তাহলে তাঁকে তিনি অধিবেশন থেকে বের করে দিতে বা তাঁর মাইক বন্ধ করে দিতে পারেন। তখন সবারই খুশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদীন ফারুক কঠোর ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে স্পিকারের কাছ থেকে সাংসদদের নতুন করে আচরণবিধি শেখার প্রয়োজন নেই। কারণ তিনি পাঁচবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। পাঁচ মেয়াদে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর যদি একজন সাংসদের শিক্ষার মান এই পর্যায়ে নামে, তাহলে আর বলার কী-ই বা থাকে।
আমাদের দেশে সংসদে মারামারির রক্তাক্ত ঘটনাও আছে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ১৯৫৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কয়েকজন সদস্যের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী নিহত হন। মাসখানেক পর ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের সংবিধান বাতিল করা হয়। শুরু হয় আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। পাকিস্তানের অবস্থা হয়তো বাংলাদেশে হবে না। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে যে দুবার সামরিক শাসন আসতে পেরেছে এবং সম্প্রতি যে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তার অন্যতম কারণ, অকার্যকর সংসদ ও গণতন্ত্রের দুর্বলতা। যাঁরা দেশ চালান, আর যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁদের এ কথাটা বুঝতে হবে—গণতন্ত্র ও সংসদকে দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।
সংসদের গুরুত্ব আমাদের রাজনীতিবিদেরা বোঝেন না—এ কথা বলা যাবে না। এরশাদ সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আশির দশকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বাম দলগুলোর নেতৃত্বে তিন জোট এক হয়ে যে দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল, সেটি ছিল ‘সর্বাগ্রে সার্বভৌম সংসদ নির্বাচন’। এরশাদের চাতুরি ধরা পড়ে গিয়েছিল। তিনি চাইছিলেন, প্রথমে উপজেলা নির্বাচন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতার ভিত পাকাপোক্ত করে তাঁর অধীনে সংসদ নির্বাচন করতে। কিছুটা সফলও হন তিনি। কিন্তু ‘সার্বভৌম সংসদ’ নির্বাচনের দাবিতে তিন জোট অটল থাকে। এখানে ‘সার্বভৌম’ কথাটির অর্থ বুঝতে হবে। এরশাদের সময় ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। তাতে একনায়কতন্ত্রীদের সুবিধা। কারণ সংসদ ক্ষমতাহীন। তিন জোট এর অবসানের জন্য আন্দোলন করছিল। ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর তিন জোটের ঘোষণায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিন্ন রূপরেখায় সার্বভৌম সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনসম্মত কার্যকর পদক্ষেপগুলো বর্ণনা করা হয়। এরই ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান। এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হয়। পরবর্তীকালে আমাদের দেশে সূচিত হয় গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায়। ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়।
এত রক্ত দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে লাভ কী হলো? প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আজ নিজেদের মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে ঝগড়া করছে। সংসদ ক্রমাগত অকার্যকর হয়ে পড়ছে। সংসদকে অর্থবহ করতে হলে সংসদ-নেতা, অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে সংসদে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। কিন্তু এটা দুঃখজনক যে চলতি নবম সংসদের ৮৭ কর্মদিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদিও ৮১ দিন উপস্থিত ছিলেন, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন মাত্র চার দিন। একটানা তিন মাস তো বিরোধী দল অধিবেশন বর্জন করল। বাকি কয়েক দিন সংসদে যোগ দিলেও, প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো অজুহাতে সাময়িক ওয়াকআউট করেছেন। সংসদীয় রীতিতে ওয়াকআউট চলে। কিন্তু ওয়াকআউট-সর্বস্ব সংসদ চলতে পারে না।
এখন বিরোধী দল সংসদ অধিবেশনে যায় শুধু ওয়াকআউটের উপলক্ষ খুঁজতে। আর সরকারি দলও যেন প্রায় প্রতিদিন এক একটা উপলক্ষ বিরোধী দলের হাতে তুলে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাংসদেরা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে সংসদে অবমাননাকর ও ব্যক্তিগত বিষয়ে কটু মন্তব্য করছেন। আর বিএনপি সেটা লুফে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একই কায়দায় অবমাননাকর কথা বলে চলেছেন। মনে হয়, একে অপরকে ঘায়েল করাই যেন দুই প্রধান দলের একমাত্র লক্ষ্য এবং এই উদ্দেশ্যে তারা দুই দলের দুই প্রয়াত নেতার বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভাষায় কথা বলতে দ্বিধা করছে না। এতে যদি সত্যিই কারও ক্ষতি হয়, তাহলে হচ্ছে ওই দুটি দলের এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের। দুই দল একে অপরের বিরুদ্ধে লাগতে গিয়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে।
দেশে কি সমস্যার অভাব আছে? এই যে গরম না পড়তেই প্রতিদিন চার-পাঁচবার করে বিদ্যুত্ যায়, গরমে মানুষ কষ্ট পায়, পানির অভাবে দুর্ভোগ পোহায়, সেসব বিষয় নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় না কেন? জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। সরকার বলছে, ব্যবসায়ীদের অসাধু সিন্ডিকেট নাকি এর জন্য দায়ী। যদি তা-ই হয়, সরকার কী করছে? ঢালাওভাবে ব্যবসায়ীদের দায়ী না করে সরকার পথে পথে দলীয় নামধারীদের চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও তো বাজার কিছুটা শান্ত হয়। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে শুধু বক্তৃতাই দিচ্ছে, কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। সংসদে বিরোধী দল এসব বিষয়ে বিতর্ক করতে পারে। সরকারকে জবাবদিহিতে বাধ্য করাই তো সংসদে বিরোধী দলের প্রধান কাজ। সেটা তারা করছে না কেন? তীব্র যানজটে রাজধানীবাসী কষ্ট পায়, এ নিয়ে সাংসদদের যদি বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা থাকত, তাহলে হয়তো সংসদে আলোচনা উঠত। সেখানে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হলেও একটা সান্ত্বনা থাকত যে মানুষের ভালো-মন্দ নিয়ে সংসদে ঝগড়া হচ্ছে।
ভারতেও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এ নিয়ে লোকসভায় গত মাসে তীব্র বিতর্ক হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা সুষমা স্বরাজ ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে ‘সম্পূর্ণ ব্যর্থ’ বলে দাবি করে মুলতবি প্রস্তাবের ওপর আলোচনার সুযোগ ও ভোট চাইলে সংসদে অচলাবস্থা দেখা দেয়। স্পিকার মিরা কুমার প্রথমে আধা দিন, পরে পুরো এক দিনের জন্য অধিবেশন মুলতবি করেন। এর আগেও বিভিন্ন বিষয়ে লোকসভায় গরম বিতর্ক হয়েছে। বিরোধী দল বিজেপির সাংসদেরা আসন ছেড়ে স্পিকারের দিকে তেড়ে গেছেন। সেসময় সরকার দলীয় সাংসদেরা টু শব্দটি করেননি। আর স্পিকার মিরা কুমার স্বভাবসুলভ আস্থাশীল ভঙ্গিতে মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখে শুধু বলে চলেছেন, আপ বলনা ক্যায়া চাহতে, বলিয়ে, সিট পার বৈঠিয়ে! কিছুক্ষণ পর লোকসভার অধিবেশন শান্ত হয়েছে। আবার বিতর্কে মুখর হয়েছে।
গণতন্ত্রের মূল শক্তি হলো কার্যকর সংসদ। সংসদ ভালোভাবে না চললে সরকার নিজেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। বিরোধী দলের বাড়তি কিছু করতে হবে না। তাই এখন গায়েপিঠে হাত বুলিয়ে হলেও বিরোধী দলকে সংসদে ধরে রাখার জন্য সরকারি দল আওয়ামী লীগের সচেষ্ট হওয়া দরকার। বিএনপির সাংসদেরা তীব্র বাক্যবাণ ছুঁড়ে দেবেন, আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংসদেরা হাসিমুখে তা লুফে নেবেন। স্পিকার তো বেশ রসিক। তিনি মাঝেমধ্যে টিকা-টিপ্পনী কেটে সংসদকে সরস রাখতে পারেন। এ ধারায় কয়েক দিন সংসদ চলুক। একটু মিলমিশ করে চলতে হবে। রাজনীতি যে শিল্পকলা, তার মাধুর্য প্রস্ফুটিত করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাহায্য করুক। নইলে ব্যর্থতার দায় যে তাদেরই বহন করতে হবে।
সংসদে প্রাণসঞ্চারে ব্যর্থ হলে সবাই বলবে, সাংসদেরা কি পথ হারাইয়াছে? বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস কপালকুণ্ডলার নায়ক নবকুমার তীর্থযাত্রার পথে নৌকা থেকে নেমে সহযাত্রীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তখন অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী এক নারী এসে তাকে একই ভাষায় জিজ্ঞেস করেছিল, পথিক অর্থাত্ নবকুমার নৌকাবঞ্চিত হয়ে তার অভীষ্ট পথ হারিয়েছে কি না?
আজ সাংসদদের কে পথ দেখাবে?
আব্দুল কাইয়ুম : সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.