সহজিয়া কড়চা-স্বাধীনতা ও মুক্তি: সংকল্পনা ও বাস্তবতা by সৈয়দ আবুল মকসুদ

আর এক বছর পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স হবে ৪০ বছর। স্বাধীন বাংলাদেশের এই চার দশকের অর্জন কী? স্বাধীনতা একটি শব্দ মাত্র নয়। স্বাধীনতা একটি অমূল্য প্রত্যয়—একটি অতি সম্মানজনক অবস্থা এবং এক বিরাট আয়োজনের নাম স্বাধীনতা।


সেই আয়োজনে ৪০ বছরে আমাদের সার্থকতা কতটুকু, আমাদের ব্যর্থতার পরিমাণ কতখানি, তা কি আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেছি? চার দশকের বেসামরিক ও সামরিক শাসকেরা যেন হ্যামিলনের বাঁশিবাদক, অবুঝ বালকের মতো বিশাল জনগোষ্ঠী ছুটেছে তাদের পেছনে। প্রশ্নহীন আনুগত্য নিয়ে তাদের পেছনে ছুটে আমরা যে ডুবে মরব, সেটা ভাববার মতো বিচারবোধও সম্ভবত আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
স্বাধীনতা আর মুক্তিও এক জিনিস নয়। সম্পূর্ণ স্বাধীন বহু দেশের মানুষের জীবনেই মুক্তি আসে না। জনগণের মুক্তি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। অন্যদিকে স্বাধীনতা চাইলেই কি স্বাধীনতা পাওয়া যায়? স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করলেই কি স্বাধীনতা আসে? রক্ত দিলেই কি স্বাধীনতা প্রাপ্তি সুনিশ্চিত? তা যদি হতো তা হলে পৃথিবীতে এখন স্বাধীন রাষ্ট্র থাকত হয়তো দুই হাজারের বেশি।
স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করলেই স্বাধীনতা পাওয়া গেলে বহু আগে স্বাধীন হতো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সেই ‘পাখতুনিস্তানে’র জাতির পিতা হতেন খান আবদুল গাফফার খান। ‘সিন্ধুদেশ’ও বাংলাদেশের আগেই স্বাধীন হতো। জাতির জনক হতেন ‘জিয়ে সিন্ধ্’ নেতা জি এম সৈয়দ। কাশ্মীর স্বাধীন হতো শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে। স্বাধীন হয়ে পাঞ্জাবের নাম হতো ‘শিখস্থান’। তিব্বত তো স্বাধীন হতোই, চীন থেকে বেরিয়ে গিয়ে রাষ্ট্র গঠন করত বহু জনগোষ্ঠী। কখনো-কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ধাক্কা থেকে থাইল্যান্ড, নেপাল, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশও বাদ যায়নি। সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করা সত্ত্বেও ক্ষুদ্র শ্রীলঙ্কা থেকে বেরিয়ে গিয়ে তামিলরা রাষ্ট্র গঠন করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত প্রভাকরণকে জীবন দিতে হলো স্বাধীনতা পাওয়ার আগেই।
দক্ষিণ এশিয়ার যখন এই অবস্থা, পৃথিবীর অন্য এলাকার কথা না বলাই ভালো। উত্তর আয়ারল্যান্ডে স্বাধীনতার সংগ্রাম চলছে। স্বাধীনতা চাইলেই স্বাধীনতা পাওয়া গেলে কানাডা এত দিন অখণ্ড থাকত না। ফরাসিভাষী এলাকা কুইবেকের স্বাধীনতার জন্যে লড়ছে Parti Quebecois (pq)। ওসবের খুব কম প্রচার দেয় পশ্চিমি প্রচারমাধ্যম। দুনিয়ার মানুষ আসাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা যত জানে তার এক ভাগও জানে না দি ওয়েস্টার্ন কানাডা কনসেপ্ট (ডব্লিউসিসি) নামক রাজনৈতিক সংগঠনের কথা, যারা চাইছে কানাডার পশ্চিম অংশে তেনসমৃদ্ধ অঞ্চল নিয়ে আলবার্টা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। আমাদের দুই দলের বাগিবতণ্ডায় এবং তাদের সহযোগী একশ্রেণীর লেখক-সাংবাদিকের রচনা পড়ে আমাদের সরলপ্রাণ কিশোর-কিশোরীরা শুধু নয়, নব্বই বছরের অনেক বুড়োও মনে করছেন, ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বা কালুরঘাট থেকে ঘোষণা দিলেই স্বাধীনতা পাওয়া যায়। বিশ শতকের রাজনৈতিক বাস্তবতা অত সহজ ছিল না।
কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় ভূগোল তখনই পুনর্গঠিত হয়, যখন সেখানকার মানুষের সঙ্গে দুনিয়ার যারা অধিপতি তাদের স্বার্থও রক্ষা করা সম্ভব। আমরা বলছি আমেরিকা ও চীন এককাট্টা হয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। বিরোধিতা করেছিল ঠিকই, কিন্তু সত্যি সত্যি ষোল আনা বিরোধিতা করলে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা তারা ঠেকাতে চাইলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আরও বহু বছর প্রলম্বিত হতো। আমেরিকা কতটা বিরোধিতা করেছিল এবং চীন কেন বিরোধিতা করেছে, তা নিক্সন-কিসিঞ্জার এবং মাও ঝেদোঙ-ঝৌ এনলাইয়ের বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলেই জানা যাবে। আমেরিকার নমনীয় মনোভাব ১৯৭১-এ ঢাকায় তার কনস্যুল জেনারেল আর্চার কে ব্লাডের অগোছালোভাবে লেখা স্মৃতিকথাটিতে পাওয়া যায়।
আসল কথা হলো, আমরা সেদিন একদিকে বিপদে এবং অন্যদিকে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলাম। আমাদের স্বার্থ আর জগতের আরও অনেকের স্বার্থ মিলে গিয়েছিল। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে দেশটি স্বাধীন হলে এবং দুর্বল বুর্জোয়া-নেতৃত্বে পরিচালিত হলে অনেকের লাভ। ভারতের লাভ, চীনের লাভ, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের লাভ, আমেরিকা-ব্রিটেন-কানাডা-অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমি পুঁজিবাদী বিশ্বের তো লাভের সীমা-পরিসীমা নেই। তারা জানত, তাদের কারিগরি ও আর্থিক সাহায্য ছাড়া জনবহুল দেশটি টিকে থাকতে পারবে না। এর মধ্যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পাশবিক বর্বরতার ফলে বিশ্বজনমত আমাদের অনুকূলে আসে। আশি লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে যাওয়ায় তা শুধু ভারত সরকারের নয়, জাতিসংঘেরও মাথাব্যথার কারণ হয়। বাংলাদেশ প্রশ্নে তারাও আর নীরব থাকতে পারে না। কিন্তু সবকিছুর ওপরে ছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ। তা অগ্রাহ্য করার শক্তি পৃথিবীর কারও ছিল না। সুতরাং পাকিস্তানিদের নাকে খত দিয়ে মাথা নিচু করে চলে যাওয়া ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো পথ রইল না। পরাজয়ের পরে কলাবোরেটরদের কেউ কোলে তোলে না। যাওয়ার জায়গা না থাকায় পাকিস্তানি কলাবোরেটররাও বাংলাদেশেই পড়ে রইল। কারও জায়গা হলো জেলে, কেউ রইল গা-ঢাকা গিয়ে এদিক-ওদিক পালিয়ে কিছুদিন।
এখন সেমিনার ও গোলটেবিলের বক্তারা যত কথাই বলুন, সেদিনের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজি তাঁর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করায় বাংলার মানুষ যেমন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে, দলিলটিতে শুধু জেনারেল অরোরার স্বাক্ষর থাকায় তারা অস্বস্তিও বোধ করেছে। কথাটি আমি কুণ্ঠিতভাবে জেনারেল অরোরাকে বলেছিলাম। তিনি আমার সঙ্গে একমত হলেন, এবং বললেন, সেটাই নেচারাল—খুব স্বাভাবিক। প্রধান নেতা দেশে নেই। তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। কবে আসবেন নিশ্চয়তা ছিল না। আদৌ ফিরবেন কি না তাও কেউ জানে না। বাঙালি নেতাকে ফাঁসি দিতে পাকিস্তানি জেনারেল ও বিচারকদের বুক কাঁপবে না। এদিকে প্রবাসী সরকার ভারতে। তাদের বল কম। হাত-পা বাঁধা। ঢাকা রেসকোর্সে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর হলো পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। সে চুক্তিতে স্বাক্ষর শেখ মুজিব, ইন্দিরা গান্ধী ও ইয়াহিয়া করেননি—করেছেন ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তারা। ওই অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষের আনন্দের মধ্যেও অস্বস্তি থাকাই স্বাভাবিক।
১০ দিন পরে কলকাতা থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতারা ঢাকায় এসে পৌঁছান। নেতারা এক বিমানে এলেও, প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী-আমলারা দুটি অদৃশ্য ভাগে বিভক্ত হয়ে আসেন। ছোট ভাগটি ভারতের প্রতি অনুগত ও কৃতজ্ঞ। আরেকটি ভাগ, সেটি বড়, ভারতবিরূপতা হূদয়ে ধারণ করে আসে। বাইরে থেকে বোঝা যেত না। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল কারা কোন ভাগে ছিলেন।
ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতাসংগ্রামে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল কম। মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেনদরবার ও দর-কষাকষি করেছেন গান্ধী-জিন্নাহ-নেহেরু। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অন্য রকম জনযুদ্ধ। মুক্তিকামী জনগণ যারা যেখানে যেভাবে পেরেছে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। একাত্তরের নয়টি মাস বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ সরকার’ ছিল না—একটি পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন ছিল।
সেদিন কোনো রকম কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই স্বাধীনতাকামী মানুষ ঐক্যবদ্ধ ছিল। এমনই ঐক্যবদ্ধ ছিল, যা অতীতে কোনো দিন ছিল না। বিস্ময়ের ব্যাপার, মুক্তিযুদ্ধের পরে যখন বাংলাদেশ সরকার অধিষ্ঠিত হলো তখন মানুষের সংহতি ও ঐক্যটি আর থাকল না। প্রশ্ন হতে পারে: সরকার সেদিন কলকাতায় না থেকে যদি দেশের মধ্যে থাকত, তাহলে কি মুক্তিযোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারতেন? মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ঐক্য থাকল, নেতৃত্বহীন অবস্থায় ঐক্য থাকল, কিন্তু স্বাধীনতার পরে বিভেদ দেখা দিল কেন?
যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে কোনো দেশ স্বাধীন হলে সে দেশে দুটি পক্ষ থাকবেই। বিজয়ের পরে বিজয়ী পক্ষের প্রাথমিক কাজ হলো জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করা। পরাজিত পক্ষকে তাদের ভুল সংশোধন এবং যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের সঙ্গে থেকে যে অপরাধ করেছে তার জন্য অনুশোচনার সুযোগ দেওয়া। মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধীদের অবশ্য শাস্তিই প্রাপ্য। লঘু অপরাধের জন্য অনুকম্পার ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা অনুশোচনা প্রকাশের প্রয়োজন বোধ করেনি, নেতৃত্বও জাতীয় সংহতি সৃষ্টির চেষ্টা করেনি। ফলে সংহত জাতি গঠিত না হয়ে শুরু থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সমান্তরাল দুটি পরস্পরবিরোধী ধারা। এই পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক ধারাই দেশের অস্তিত্বের জন্য আজ বড় হুমকি।
স্বাধীনতার আগে ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ডান-বাম ও মধ্যপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মপন্থী বিভিন্ন দল ও উপদল ছিল। স্বাধীনতার পরে তারা তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করতে পারে না। প্রায় সব দলের নেতা-কর্মীই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তিন-চারটি জনসমর্থনহীন দল ছাড়া। গণতন্ত্রে নানা দল-উপদলের অস্তিত্ব থাকাই স্বাভাবিক। এবং প্রতিষ্ঠাপর্বে কোনো রাষ্ট্রে মতাদর্শের অথবা কায়েমি স্বার্থের সংঘাত থাকতেই পারে। আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে বহুদিন তা ছিল। সেখানকার নেতৃত্ব তা কাটিয়ে উঠতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। সেখানে এক রাজ্যের সঙ্গে আরেক রাজ্যের সংঘাতও ছিল; বাংলাদেশের তা ছিল না।
জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন সৈনিক। তাঁর রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ, সাধারণের কল্যাণের জন্য আকাঙ্ক্ষা এবং নিঃস্বার্থ-পক্ষপাতহীনতা ছিল সীমাহীন। একা ক্ষমতার ব্যবহার করতেই চাননি। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। তিনি ছিলেন একজন চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, কূটনীতিবিদ ও প্রকাশক। তাঁর বয়স হয়েছিল, তা ছাড়া তিনি ছিলেন বাত ও পিত্তপাথরির রোগী। শেষ জীবনে গাড়িতে পর্যন্ত উঠতে পারতেন না। কিন্তু দেশের জন্য ভাবতেন, ছিলেন দূরদর্শী। বিভিন্ন রাজ্যের সমন্বয়ে একটি কনফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র গঠনে তাঁর ভূমিকা বিশাল। সকলে মিলে বসে খুব চিন্তাভাবনা করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয়েছিল। স্বাধীনতাকে সংহত করতে বহু বছর ধরে ফ্রাঙ্কলিন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করতেন। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা-পিতাদের শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ছাড়াও বহু কাজ করতে হয়েছিল। ফ্রান্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও মৈত্রী চুক্তি করতে হয়েছে। গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে করতে হয়েছে শান্তি ও স্বাধীনতার চুক্তি। আমাদেরও স্বাধীনতার পর পরই জনগণের মতামত নিয়ে ভারতের সঙ্গে হতে পারত সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব চুক্তি। পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল বহু বাঙালি। বাংলাদেশে আটকে ছিল বহু পাকিস্তানি। এসব সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে পাকিস্তানের সঙ্গেও শান্তি ও সমঝোতা চুক্তি করার দরকার ছিল। সেসব পথে আমাদের নেতারা যাননি।
ফ্রাঙ্কলিন বলেছেন, ‘জনকল্যাণকামী নাগরিকদের অবিশ্রাম পরিশ্রম এবং সদা সতর্ক দৃষ্টির ওপরই স্বশাসনের সার্থকতা নির্ভর করে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনা হলো দক্ষতার সঙ্গে পাশা খেলার মতো। সহজে ত্রুটিহীন নতুন সরকার গঠনের আশা আমরা করতে পারি না। আমাদের খেলোয়াড় অনেক। তাদের প্রত্যেকের আদর্শ আলাদা। তাদের সংস্কার শক্তিশালী। বিনা বাধায় কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করা সম্ভব নয়।’ ৯ জুন ১৭৮৮ এক সহকর্মীকে ফ্রাঙ্কলিন লেখেন, ‘সবচেয়ে বিজ্ঞ যারা তাদের কিছু অযৌক্তিক দাবিও মেনে নিতে হবে। তার ফলে আমাদের সুদূরপ্রসারী গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করা সহজ হবে।’
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সরকারের নেতারা অন্য দলের বিজ্ঞ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন মনে করেননি। সেই সময়ের যোগ্যতর ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ‘সর্বোত্তম সরকার’ গঠিত হতে পারত। ‘এক নেতা এক দেশ’ স্লোগান দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বহু মতের সমন্বয় ঘটালেই তা হয় গণতন্ত্র। শীর্ষ নেতা থাকবেন মাথার ওপরে—সমতলে থাকবেন বহু নেতা। কোনো কোনো সময় কোনো যোগ্যতর নেতার ‘অযৌক্তিক’ দাবি মানতে হয় জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে। ভিন্নমতাবলম্বী নেতার ‘যুক্তিপূর্ণ’ কথাটি মানাই গণতান্ত্রিক চেতনা। বাহাত্তরে আওয়ামী লীগের বাইরের কারও কোনো পরামর্শকেই মূল্য দেওয়া হয়নি। তখন দেশে ডান-মধ্য ও বামপন্থী বহু নিবেদিত নেতা ছিলেন, যাঁরা ২৪ বছর পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন; জেল-জুলুম ভোগ করেছেন। ফলে পঁচাত্তরে যেদিন বিপর্যয় ঘটে সেদিন কেউই এগিয়ে আসেননি।
পাকিস্তানে গণতন্ত্র থাকলে অত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি উঠত না। গণতন্ত্র চেয়ে নির্যাতিত হয়ে বাংলার মানুষ পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে গণতন্ত্র বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয়নি। সেক্যুলারিজমের কথা আমরা সংবিধানে লিখেছিলাম। কিন্তু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ও আদিবাসী নেতাদের মতামত আমরা নিইনি। যেখানে ভাসানী, মণি সিংহ, আতাউর রহমান খান, মোজাফফর আহমদের মূল্য নেই, সেখানে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দাবির মূল্য কী?
১৯৫৮ সাল থেকে পূর্ব বাংলায় কংগ্রেসের রাজনীতি স্থগিত করে রাখা হয়। কৌশলগত কারণে ষাটের দশকে কংগ্রেস-নেতারা আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মধ্যে কাজ করতেন। স্বাধীনতার পর বাংলার হিন্দু কংগ্রেসপন্থী নেতারা আশা করেছিলেন, কংগ্রেস পুনরুজ্জীবিত হবে। কিন্তু অতি দ্রুত ভারতবিরোধী ভাবপ্রবণতা সৃষ্টি হওয়ায় কংগ্রেস-নেতারা দল পুনর্গঠন করার সাহস পাননি, তা করলে নির্ঘাত তাঁদের ভারতের দালাল পার্টি বলা হতো। ভারতীয় কংগ্রেস থেকেও সায় দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর বঙ্গবন্ধু ও মোশতাকের মন্ত্রিসভায় ছিলেন।
কংগ্রেসের নেতারা ১৯৭২—১৯৭৪-এ মিডিয়াকে না জানিয়ে ঘরোয়াভাবে সম্মিলিত হয়েছেন। ১৯৭৩ সালে পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে এক বাড়িতে কংগ্রেসের একটি সভায় আমি গিয়েছিলাম মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা ও সুধাংশু শেখর হালদারের সঙ্গে। বিভিন্ন জেলার জনা তিরিশ প্রবীণ নেতা এসেছিলেন। আশির দশকে নেত্রকোনার কংগ্রেস-নেতা দুর্গেশ পত্রনবিশ ও মহাদেব সান্যালের সঙ্গে এক দিন-এক রাত একত্রে ছিলাম। মনোরঞ্জন ধরের বাড়িতেও যেতাম। কংগ্রেস নিয়ে তিনি স্মৃতিচারণামূলক কিছু লিখছিলেন। কংগ্রেস-নেতাদের আমার প্রাজ্ঞ মনে হয়েছে। দুর্গেশবাবু বোধ হয় এখনো বেঁচে আছেন।
কংগ্রেস আত্মপ্রকাশ করুক তা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও চাননি। কংগ্রেস পুনরুজ্জীবিত হলে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হতো। তারা সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারতেন। তখন আওয়ামী লীগ হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার একক দাবিদার হতে পারত না। ভোটবাক্সের রাজনীতি বন্ধ হতো।
সেক্যুলারিজমের ধাক্কায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে মুসলমানি রাজনীতি থাকবে না, তা যাঁরা ভেবে থাকেন তাঁরা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো সরল। ভারতে যেমন স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রাধান্য, বাংলাদেশে মুসলমানি তথা ইসলামি রাজনীতি থাকবেই এবং সেটাই হবে ভোটের বাজারে জনপ্রিয় রাজনীতি। বাংলাদেশকে ‘মুসলিম গণতান্ত্রিক দেশ’ বললে একশ্রেণীর প্রগতিশীল গোসসা হন। বাস্তবতা অস্বীকার করা বোকামি। ভারতের লোকসভার স্পিকার মীরা কুমারের বাবা প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ দিল্লিতে এক জনসভায় বাংলাদেশকে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বলে আখ্যায়িত করেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে প্রথম জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ।’ এ কথা তিনি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বলেননি; বাস্তবতা। মুসলিম রাষ্ট্র হোক, হিন্দু রাষ্ট্র হোক, বৌদ্ধ রাষ্ট্র হোক—ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে কোনো ধর্মই বাধা নয়। যেমন তুর্কমেনিস্তান। ইসলামধর্মও অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনে কোনো বাধা নয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম নিষিদ্ধ হয়। স্বাধীনতার পরে ধর্মীয় তথা ইসলামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন বন্ধের সুপারিশ করা হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মুসলমানদের সঙ্গে নাস্তিকদের যুদ্ধ ছিল না। যেখানে গণতন্ত্র আছে সেখানে সব মতাদর্শী রাজনীতিই থাকবে। ভারতে হিন্দুত্ব ও ইসলামধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে। বাংলাদেশে না থাকার যুক্তি কী? জওহরলাল নেহরু যা বিশ্বাস করতেন আমিও তা-ই বিশ্বাস করি। আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় কোনো জাতি শিক্ষিত হয়ে উঠলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়ক রাজনীতির স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের আগে দরকার খাঁটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা।
মুক্তির প্রাথমিক পদক্ষেপ বৈদেশিক শত্রু থেকে স্বাধীনতা অর্জন। সেটা আমরা করেছি ৩৯ বছর আগে। মুক্তি অনেক বড় ব্যাপার। তা নিজের সঙ্গে লড়াই করে বহু সাধনায় অর্জন করতে হয়। মুক্তি আমাদের অর্জিত হয়নি। স্বাধীনতার পর নেতারা ভুল করেছিলেন। তার খেসারত তাঁরাও দিয়েছেন, ৪০ বছর ধরে আমরাও দিচ্ছি। এখন নেতারা বড় কোনো ভুল করলে আগামী ১০০ বছরেও জাতির মুক্তি আসবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.