উপজেলা-ব্যবস্থার কী হবে?-সাংসদদের হাতে ১৫ কোটি টাকা

স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার যে অঙ্গীকার ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল, স্থানীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রত্যেক সাংসদকে পাঁচ বছরের জন্য গড়ে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্তটি তার সঙ্গে স্পষ্টতই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বলছেন, এর মধ্য দিয়ে দুর্বল উপজেলা-ব্যবস্থা আরও দুর্বল হবে।


বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ ভাগের তৃতীয় পরিচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ৫৯): ‘আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ স্থানীয় শাসন বলতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ‘জনসাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন’ও রয়েছে। অর্থাত্ বর্তমান সরকার ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় পাঁচ বছরের জন্য যে মোট চার হাজার ৬৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, সে অর্থ ব্যবহারের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার কথা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের ওপর, সংসদ সদস্যদের ওপর নয়। সংবিধানের পঞ্চম ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ৬৫): ...এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইনপ্রণয়ন-ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত হইবে।’ এ বিবেচনায় সঠিক প্রতিক্রিয়াই জানিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, বর্তমানে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম হাফিজউদ্দিন খান: স্থানীয় সরকারের কাজ দেওয়া হচ্ছে সাংসদদের। বিষয়টি শুধু অস্বস্তিকর নয়, অসাংবিধানিকও।
রাষ্ট্রকে ক্রমশ অধিকতর গণমুখী করতে, সামগ্রিক শাসনব্যবস্থাকে ক্রমশ আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে সংবিধানের শাসন-সংক্রান্ত দিকনির্দেশনাগুলো অনুসরণ করা উচিত। আইনের চুলচেরা বিশ্লেষণে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে যদি অসাংবিধানিক নাও বলা হয়, এটা নিশ্চিত যে সিদ্ধান্তটি সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
শুধু সংবিধান বা তাত্ত্বিক দিক থেকে নয়, বাস্তবিকভাবে সংসদ সদস্যদের প্রায় সর্বময় ক্ষমতা যে এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও শাসনব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক হয়নি, এ নিয়ে দ্বিমত খুব কম। সেই সঙ্গে স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন—এই উপলব্ধি, এবং এর পক্ষে ব্যাপক জনমতও রয়েছে। সে কারণে স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থার উন্নতি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাইতে দেখা যায় সব রাজনৈতিক দলকেই। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে কোনো দলকেই সত্যিকার অর্থে সে রকম পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। বিরোধী দলগুলোও এ বিষয়ে সরকারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করে না। এটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক।
সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সে দেশের সংসদ সদস্যদের জন্য বছরে দুই কোটি রুপি বরাদ্দ রাখার নিয়ম চালু আছে। তবে সেখানে অর্থ ব্যবহারের অনুমোদনের এখতিয়ার রয়েছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের হাতে। তবু সেখানে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয় বলে সমালোচনা রয়েছে। সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং ও একটি সংবিধান পর্যালোচনা কমিটি ওই প্রকল্প বাতিলের সুপারিশ করেছিলেন। আমাদের দেশে সাংসদদের ত্রাণসামগ্রী নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অতীতে বিস্তর উঠেছে, কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হয়েছেন। পরিকল্পনামন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, উল্লিখিত প্রকল্পে সাংসদদের দুর্নীতির সুযোগ থাকবে না। এর পরও এ বিষয়ে নিশ্চয়তা কম। এ ছাড়া কাজের এখতিয়ার প্রসঙ্গে উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত সাংসদদের যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে তা আরও জটিল হয় কি না, সেটিও বিবেচনা করা প্রয়োজন। প্রকল্পটির অর্থ ব্যবহারের কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ সম্পর্কে পুনরায় ভেবে দেখা যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.