শেকড়ের ডাক-বাংলাদেশের জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ by ফরহাদ মাহমুদ

বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ দুয়েকটি থাকলেও দুঃসংবাদের অন্ত নেই। সুসংবাদ হলো_দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি, গণতন্ত্রের সূচকে আট ধাপ অগ্রগতি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি। আর প্রতিদিনের কাগজে দুঃসংবাদের অন্ত নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রধানতম একটি দেশ।


জঙ্গিবাদ কিছুটা কমলেও সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তি দিন দিনই বাড়ছে। অসহনীয় যানজটে নাকাল হচ্ছে নগরবাসী। আর তাই যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী 'দি ইকোনমিস্ট'-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) জরিপ অনুযায়ী, বসবাস অনুপযোগী বা নিকৃষ্ট শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরীর অবস্থান আবারও দ্বিতীয় হয়েছে। ইআইইউ বিশ্বের ১৪০টি বড় শহরের বসবাসযোগ্যতা নিয়ে প্রতিবছরই এই জরিপ চালায়। আগের মতোই এক নম্বরে আছে জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারে। ঢাকার অবস্থান হলো তার পরই। নিকৃষ্টতম ১০টি শহরের মধ্যে উপমহাদেশের আরো দুটি শহর রয়েছে। সে দুটি হলো করাচি (৬ নম্বর) এবং কলম্বো (১০ নম্বর)।
ইআইইউ এই জরিপে প্রধান পাঁচটি ক্যাটাগরিতে মোট ৩০টি উপক্যাটাগরি বা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এ তালিকা তৈরি করেছে। প্রধান পাঁচটি ক্যাটাগরি হলো : স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো। স্বাধীনতার পরও ঢাকার চেয়ে কলকাতার অবস্থা অনেক খারাপ ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। সেই কলকাতা কিন্তু এখন তালিকায় অনেক ওপরে স্থান পেয়েছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এর কারণ বা কিছু ইঙ্গিত রিপোর্টেও পাওয়া যায়। একটি প্রধান কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। অথবা বলা যায়, নগরের বৃদ্ধিতে স্বেচ্ছাচারিতা। ১৯৯২ সালে বিশিষ্ট নগরবিদদের তত্ত্বাবধানে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রায় এক দশক লেগে যায় সেটিকে আইনে পরিণত করতে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তারপর এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো তার প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। শোনা যায়, এখনো রাজউক থেকে উৎকোচের বিনিময়ে আইন প্রণয়নের আগের তারিখ দিয়ে অর্থাৎ 'ব্যাক ডেট' দিয়ে প্ল্যান পাস করানো যায়। সেভাবেই গড়ে উঠছে ঢাকা মহানগরী। গায়ে গায়ে লাগানো বহুতল বাড়ি। রাস্তাঘাটের কোনো বালাই নেই। ঢাকা শহরে এমন বহু গলি আছে, যেখানে আগুন লাগলে দমকলবাহিনীর গাড়ি ঢুকতে পারে না। এমনকি একজন মুমূর্ষু রোগীকে আনার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে পারে না। ঢাকা শহর থেকে সবুজের হাতছানি প্রায় বিদায়ই নিয়েছে।
জরিপে বিবেচিত বিষয়গুলোর মধ্যে সংস্কৃতি ও পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাটাগরি ছিল। ঢাকা মহানগরীর সাংস্কৃতিক পরিবেশের কতটা অবনতি হয়েছে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। বছর তিনেক আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামের এক প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে বছরে ১৫ হাজার মানুষ মারা যায় পরিবেশদূষণ বা মূলত বায়ুদূষণের কারণে, যার সিংহভাগই মারা যায় ঢাকা মহানগরীতে। আর যত লোক মারা যায়, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ অসুস্থ হয়ে কর্মক্ষমতা হারায়। এখানে ওয়াসার সরবরাহ করা পানীয়জল প্রায় পানের অযোগ্য। পুরনো লাইন ফুটো হয়ে স্যুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। অনেক এলাকার বাসিন্দারাই এমন অভিযোগ করেন। কোনো কোনো এলাকার পানি পরীক্ষা করেও দেখা গেছে, পানিতে কলিফর্ম জীবাণুর পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৫০০ গুণ বেশি। তার পরও শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য রীতিমতো হাহাকার শুরু হয়ে যায়। কারণ প্রতিবছরই পানির স্তর কয়েক মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে অনেক পাম্পে ঠিকমতো পানি ওঠে না। গ্যাস-বিদ্যুতের অবস্থাও তথৈবচ। নালা বা পানি নিষ্কাশনের অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই রাজপথে হাঁটু বা কোমর সমান পানি জমে যায়। পয়ঃনিষ্কাশনের অবস্থাও একই রকম। গত ১৫ বছরে ঢাকার লোকসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দেড়-দুই কোটিতে পেঁৗছলেও এগুলো প্রায় আগের অবস্থায়ই রয়ে গেছে। এ রকম হাজারটা উদাহরণ দেওয়া যাবে। এটাই বাস্তবতা। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, দ্রুত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে অচিরেই ঢাকা মহানগরী সম্পূর্ণরূপে বসবাসযোগ্যতা হারাবে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে ঢাকার যে অবকাঠামোগত সুবিধা রয়েছে তা ৫০ লাখ মানুষের জন্যও যথেষ্ট নয়, সেখানে জনসংখ্যা তিন কোটি ছাড়িয়ে গেলে তখন অবস্থাটা কী দাঁড়াবে?
বর্তমানে ঢাকা মহানগরীতে প্রতিদিন পানির চাহিদা গড়ে সোয়া দুই লাখ লিটার বলে উল্লেখ করা হয়, কিন্তু প্রকৃত হিসাবে তা আরো বেশি। এর মধ্যে ওয়াসা প্রতিদিন ১৮০ থেকে ১৮৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে। এই পানির ৮৭ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে অর্থাৎ গভীর নলকূপের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। বাকি ১৩ শতাংশ আসে নদীর পানি শোধনের মাধ্যমে। কিন্তু এই প্রধান দুটি উৎসই ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত। এর মধ্যে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে পানি উত্তোলন দ্রুত কমিয়ে না আনলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা করছেন ভূবিজ্ঞানীরা। কারণ ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে ইতিমধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করতে না পারায় প্রতিবছর তা প্রায় তিন মিটার করে নিচে নামছে। এ প্রক্রিয়া ঠেকানো না গেলে ১০ বছর পর পানির স্তর আরো অনেক নিচে নেমে যাবে। তখন কী হবে? বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নিচের মাটিতে ক্রমেই বেশি করে শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে। এই শূন্যস্থান বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে বড় কোনো ভূমিকম্পের সময় ঢাকা মহানগরীর অনেক স্থানে ব্যাপক ভূমিধস হতে পারে। আর তার পরিণাম কি হবে তা কি ভাবা যায়? সম্ভাব্য সেই বিশাল মানবিক বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য বিজ্ঞানীরা ভূগর্ভের পানি উত্তোলন বন্ধ করার এবং ভূগর্ভে পানি প্রবেশ করিয়ে দ্রুত শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। অথচ বাস্তবে হচ্ছে তার উল্টোটা। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর তাগিদ থেকে ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া ওয়াসার একটি প্রকল্পে ১৫০টি গভীর নলকূপ প্রতিস্থাপন এবং ১৩০টি গভীর নলকূপ নতুন করে স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি এবং সামান্য পরিমাণে বুড়িগঙ্গার পানি শোধন করে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু অতিরিক্ত দূষণের কারণে শুকনো মৌসুমে এখনই এসব নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত পরিমাণে শোধনকারী রাসায়নিক বস্তু ব্যবহার করতে হয়, যা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তদুপরি ট্যানারি, ডায়িং ও অন্যান্য কারখানা থেকে এমন সব বিষাক্ত রাসায়নিক বস্তু নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে, যেগুলো শোধনাগারে শোধন হয় না। সেগুলো নিশ্চিতভাবে মানুষের শরীরে বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে। কাজেই দূষণ বন্ধ করা না গেলে অদূর-ভবিষ্যতে এসব নদীর পানিও সম্পূর্ণভাবে শোধনের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।
যানজট ঢাকা মহানগরীর আরেকটি বড় সমস্যা। কুড়িল-গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে। কিন্তু এই ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষ হতে হতে ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা আরো কয়েকগুণ বাড়বে। বাস্তবে যানজট কমার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না_যদি না সামগ্রিকভাবে ঢাকার যানজট সমস্যা দূর করতে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরে দুই দশক আগেও যে যানজট ছিল, তার তুলনায় ঢাকায় তখন কোনো যানজটই ছিল না। সেই কলকাতায় এখন যানজট নেই বললেই চলে। আর আমাদের দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে এক ঘণ্টা লেগে যায়। কিভাবে কলকাতায় এমন পরিবর্তন সম্ভব হলো? সেখানে যানজট কমাতে বড় ধরনের অবদান রেখেছে ভূগর্ভস্থ রেল বা মেট্রো রেল। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তারা বিশাল দীর্ঘ ফ্লাইওভার না করলেও গুরুত্বপূর্ণ প্রায় প্রতিটি মোড়ে ছোট ছোট ফ্লাইওভার করেছে। ফলে একদিকের গাড়ি যেতে দেওয়ার জন্য আরেক দিকের গাড়ি থামিয়ে রাখার প্রয়োজন হচ্ছে না। আবার ঢাকার রাস্তায় গাড়ি একবার নামাতে পারলেই হলো, আয়ু শেষ হয়ে গেলেও সেই গাড়ি রাস্তা থেকে ওঠানো যাবে না। কয়েক দিন আগে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, সরকারি হিসাবেই ঢাকায় ফিটনেসহীন গাড়ি চলছে ৮৫ হাজারের মতো। আর বেসরকারি হিসাবে অর্থাৎ ঘুষ দিয়ে ফিটনেস আদায় করা গাড়ির সংখ্যা কত, তার হিসাব কে রাখে? এরা প্রতিনিয়ত শহরের বায়ুদূষণ করছে। যেখানে-সেখানে নষ্ট হয়ে যানজটের সৃষ্টি করছে।
আগেই বলেছি, ঢাকায় যে স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা রয়েছে তা ৫০ লাখ মানুষের জন্যও যথেষ্ট নয়। ২০২০ সালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে সম্পূর্ণ নতুন করে স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ড্রেন বা পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। বাড়ি নির্মাণকে নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। রাজউক এসব নিয়ন্ত্রণ করার কথা থাকলেও বাস্তবে করে উল্টোটা। অর্থাৎ রাজউকের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অপরিকল্পিত, এমনকি অবৈধ নির্মাণকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালার কোনো তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। যেসব ভবন তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে মানসম্মত নির্মাণসামগ্রী পরিমাণ মতো ব্যবহার করা হচ্ছে কি না_তা দেখারও কেউ নেই। ফলে ভূমিকম্প নয়, এমনিতেই ভবন ধসে পড়ার বহু ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটেছে।
দি ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভূমিকম্পের ঝুঁকির দিক থেকেও ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এখানে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা এত বেশি হবে_যা কল্পনাও করা যায় না। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের জরিপে আরো যেসব বিষয় বিবেচনায় আনা হয় সেগুলো হচ্ছে_আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি, সরকারি হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্যসেবার অত্যন্ত নিম্ন মান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শৃঙ্খলাহীনতা, মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার লঙ্ঘন ইত্যাদি। এসবের কোনো দিক থেকেই ঢাকা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। সরকারকে বিষয়গুলো এখন থেকেই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে ঢাকা অচিরেই বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়বে।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.