চরাচর-বিলীন হচ্ছে কাঁকড়া by আজিজুর রহমান

বাংলাদেশের সব মানুষের কাছেই কাঁকড়া অতি পরিচিত। এটি আর্থপোড শ্রেণীর শক্ত খোলসবিশিষ্ট অমেরুদণ্ডী জলজ প্রাণী। এরা সমুদ্র, নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর ইত্যাদি সব ধরনের জলাশয়ে বাস করে। দেহের উপরিভাগে প্রায় গোলাকৃতির প্রশস্ত ক্যারাপেস ও দেহের নিচের দিকে গোটানো ছোট আকারের উদর থাকে।


কাঁকড়ার দেহ একাধিক খণ্ডে বিভক্ত। বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়ার আকার, আকৃতি, বর্ণ ভিন্ন ভিন্ন হলেও সবাই জীবতাত্তি্বক ও সাধারণত অঙ্গসংস্থানিক দিক থেকে একই রকম। প্রজাতিভিত্তিক মিঠা ও লোনাপানি উভয় জলজ পরিবেশেই কাঁকড়া বাস করে। বাংলাদেশে ১৫ প্রজাতির কাঁকড়ার সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে মিঠাপানিতে চার প্রজাতির এবং লোনাপানিতে ১১ প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। লোনাপানির কাঁকড়া সমুদ্রে এবং মিঠাপানির কাঁকড়া অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে বাস করে। লোনাপানির অর্থাৎ সামুদ্রিক কাঁকড়া আকারে বেশ বড় হয়, আর মিঠাপানির কাঁকড়া আকারে ছোট হয়। দৈহিক বৃদ্ধির জন্য এরা খোলস পরিবর্তন করে। মূলত নিজেদের লুকিয়ে রাখতেই কাঁকড়া গর্ত খুঁড়ে থাকে। লোনাপানির কাঁকড়া প্রজননকালে এসব গর্ত ব্যবহার করে। কাঁকড়া প্রায় সারা বছরই প্রজনন করে। তবে সামুদ্রিক কাঁকড়ার প্রজননকাল মে থেকে আগস্ট ও ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস। একটি স্ত্রী কাঁকড়া এক থেকে আট মিলিয়ন ডিম দিতে পারে। লোনাপানির কাঁকড়ার বয়স সাধারণত ১৬ থেকে ১৮ মাস হলেই পূর্ণবয়স্ক বা প্রজননক্ষম হয়। তখন এসব কাঁকড়ার ওজন হয় ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম। ডুবন্ত গাছের শিকড়ে অথবা ডালপালায় এরা আশ্রয় নেয়। তাই ম্যানগ্রোভ এলাকায় এদের বেশি পাওয়া যায়। কাঁকড়া হেঁটে হেঁটে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খুব সহজে যেতে পারে। কাঁকড়া এর শক্ত সাঁড়াশি বা চিমটা দিয়ে প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলতে পারে। কাঁকড়া সর্বভুক। সামুদ্রিক কাঁকড়া সাধারণত জীবন্ত খাদ্য খেতে পছন্দ করে। ছোট মাছ, সামুদ্রিক কৃমি, শামুক, ঝিনুক, কীটপতঙ্গ খেয়ে থাকে। তবে ময়লা ও পচা জৈব পদার্থও এরা খায়। বঙ্গোপসাগরসহ ভারতীয় উপকূল ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ এলাকায় লোনাপানির কাঁকড়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। মোহনার জোয়ার-ভাটার সন্ধিস্থলে বিশেষত সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্রের প্রধান প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বুনো শুয়োর, শিয়াল, বানর, মোহনার কুমির, পাখি ও বড় মাছের খাদ্য হচ্ছে এই কাঁকড়া। বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী খাদ্য হিসেবে কাঁকড়া ব্যাপকভাবে গ্রহণ না করলেও বিদেশে রপ্তানি করে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে। আশির দশক থেকেই বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ কাঁকড়া রপ্তানি শুরু হয়। বর্তমানে রপ্তানীকৃত কাঁকড়ার প্রায় সবটাই আহরণ করা হয় প্রকৃতি থেকে অর্থাৎ সমুদ্রের মোহনা, নদী এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল থেকে। কিছু সংগ্রহ করা হয় উপকূলীয় চিংড়ি খামার থেকে। ১১ প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে ইতিমধ্যে দুই প্রজাতির কাঁকড়া মাত্রাতিরিক্ত আহরণের কারণে বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। সামুদ্রিক সাঁতারু কাঁকড়া ও তিন দাগবিশিষ্ট সাতারু কাঁকড়া বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকায় উঠে আসায় সম্প্রতি সরকার এই দুই প্রজাতির কাঁকড়া আহরণ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে।
আজিজুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.