সাদাকালো-সংকটতাড়িত প্রাণিকুল ও অসহায় মহীরুহদের জন্য সাহায্য চাই by আহমদ রফিক

প্রায় এক যুগ আগে কেশবপুরের হনুমান নিয়ে দৈনিক যুগান্তরে একটি কলামে লিখেছিলাম, 'পশুপীড়ন পাশবিক নয়, মানবিক অপরাধ'। তখনো কেশবপুরের বিরল প্রজাতির হনুমানের জীবনধারণের সংকট দেখা দেয়নি। গাছগাছালি যথেষ্ট, বিশেষ করে কলাবাগান। তখনই এক অমানুষ কেশবপুর থানার পাশে একটি গাছে বসা হনুমানের লেজ কেটে নিয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে।


রক্তাক্ত লেজ নিয়ে ওই হনুমান সদলবলে পাশে অবস্থিত থানায় হাজির হয়েছিল_স্থানীয় কারো কারো ধারণা, বিচারের আশায়। কিন্তু লেজ কাটার বিচার কি আর থানার অফিসারদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে?
ওই কাহিনীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো_নির্যাতিত হনুমানটি সুবিচার না পেয়ে অনশন ধর্মঘটের আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবাদ হিসেবে। সহৃদয় মানব প্রতিবেশীদের দেওয়া ফলমূল মর্মাহত হনুমান ছুঁয়েও দেখেনি। যাকে বলে অহিংস অনশন ধর্মঘট। কিন্তু অপরাধীর সাজা না হওয়ার কারণে তার সঙ্গী হনুমানের দল সহিংস প্রতিবাদী আন্দোলনে নেমে পড়ে। অবশ্য সেটা তাদের মতো করে। হয়তো মানুষের আন্দোলন দেখেই তাদের ওই প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া।
যেমন_গাছের ফল পেড়ে ছুড়ে ফেলা, গাছের কচি ডাল ভাঙা, ছাদের টালি ভেঙে ফেলা, মানুষের খাদ্যসামগ্রী নষ্ট করা, ঘরের চাল থেকে খড় তুলে নেওয়া ইত্যাদি হেন কাজ নেই, যা ওই ক্ষুব্ধ হনুমানের দল করেনি। অবাক কাণ্ড যে ওই হনুমানের প্রতিবেশী স্থানীয় কিছুসংখ্যক মানুষ শেষ পর্যন্ত সত্যি থানায় গিয়ে লেজকাটার মতো নিষ্ঠুরতার বিচার দাবি করেছিল। কিন্তু আসামি শনাক্ত করা যায়নি। এ কাহিনী গালগল্প নয়, রীতিমতো সত্য ঘটনা এবং এ বিষয়ে ঢাকার একটি দৈনিকে প্রতিবাদী সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল।
তখন ভাবিনি যে দীর্ঘদিন পর কেশবপুরের হনুমানদের নিয়ে আবার কিছু একটা লেখার প্রয়োজন হতে পারে। সেবার ওই সমস্যা মিটে যায় কিছুসংখ্যক মানুষের ফলমূল দিয়ে হনুমান-সেবার কারণে। এরপর দিন ভালোই কেটেছে। মানুষ ও হনুমানের প্রাকৃতিক সহাবস্থানে কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। কিন্তু এবারকার সমস্যা অনেক জটিল। বেশ কিছুদিন ধরে এ দেশের মানুষ গাছ কেটে অরণ্য-বন উজাড় করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কোনো এক রাষ্ট্রপতির গাছ কাটার 'অবসেশন' তাদের উৎসাহী করেছে কি না জানি না।
তবে বছর কয় ধরে দেখা যাচ্ছে, নানা অজুহাতে, উপলক্ষে কিংবা বিনা উপলক্ষে নিছক ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থের টানে গাছ কাটা চলছে, আর এতে ছায়াবৃক্ষ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। সুরক্ষিত বনও এসব দুর্নীতিবাজ মানুষের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। কোথাও বা চলছে বন কেটে বসত গড়ার প্রতিযোগিতা। আবার কাঠ ও টাকার লোভে বর্ষীয়ান বৃক্ষও কাটা পড়ছে। এতে বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
তবে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানাতে বিরত থাকছে না। কারণ বনভূমি উজাড় হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার বিপদ সম্পর্কে তারা সচেতন। বাংলাদেশে নির্বিচারে প্রাণী হত্যার মতো উদ্ভিদ হত্যা চলছে ব্যাপকভাবে। যশোরের কেশবপুর অঞ্চলও নানাভাবে সে হত্যাযজ্ঞের শিকার। তাই আবাসহীন হয়ে পড়ছে কেশবপুরের বিরল প্রজাতির হনুমানগোষ্ঠী। থাকার জায়গা নেই, খাবারদাবারের অভাব_সব কিছু মিলে একটা অসহায় পরিস্থিতি।
কেশবপুর থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে এক দুর্বিষহ অবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে। ওই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গাছপালা কেটে ফেলার কারণে অসহায় হনুমানকুল এদিক-ওদিক চলে গিয়ে বরং নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পড়ছে। এদের কেউ কেউ পুরনো আবাস ছাড়তে না পেরে পাকা বাড়িঘরের ছাদে আশ্রয় নিচ্ছে। তাতে সমস্যার সমাধান হওয়া দূরে থাক, নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। অনাহারে মারাও যাচ্ছে দুর্বল ও বয়োবৃদ্ধ হনুমান।
এসব দেখেশুনে স্থানীয় কয়েকটি সংগঠন, এমনকি কেশবপুর প্রেসক্লাব ও বাংলাদেশ স্কাউটের মতো সংস্থা সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন করে চলেছে_যাতে হনুমানদের জন্য আবাস তৈরির ক্ষেত্রে সরকার সচেতন হয়। কেশবপুরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি, সেখানকার বিরল প্রজাতির হনুমানগোষ্ঠীর জন্য একটি অভয়াশ্রম গড়ে তোলা এবং পল্লী বিদ্যুতের তারগুলোতে ঢাকনা (কভার) দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এ দুটো ব্যবস্থা না নিলে দ্রুতই হারিয়ে যাবে উলি্লখিত প্রাণিকুল। (কালের কণ্ঠ, ১৬.১০.২০১১)
ওই প্রতিবেদনেই বন বিভাগের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বর্তমানে কেশবপুরে প্রায় ৩০০ হনুমানের বাস। এদের জন্য বরাদ্দ 'প্রতিদিন সাড়ে ৫১ কেজি কলা, তিন কেজি রুটি ও তিন কেজি বাদাম। চলতি অর্থবছরে এ প্রকল্প শেষ হয়ে যাবে।' এরপর চলবে হনুমানদের উপবাস, ক্রমে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া অথবা অন্যত্র এদের স্বেচ্ছা অভিবাসন।
যে কথা ওই কর্মকর্তা বলেননি তা হলো, ওই কয়েক কেজি খাদ্য কি ৩০০ হনুমানের জন্য যথেষ্ট? সরকার হয়তো ভাবতে পারে, যেখানে মানুষের জন্য প্রয়োজনমাফিক আহার্য সংস্থান করা কঠিন, সেখানে বন্য প্রাণীর জন্য আহার্যের ব্যবস্থা করা একধরনের বিলাসিতা। হয়তো তা-ই। সে ক্ষেত্রে আমাদের কথা হলো, বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে গাছপালা ও বন কেটে সাবাড় করা ঠেকানো হয়তো সম্ভব। তা ছাড়া এ কথাও ঠিক যে উলি্লখিত হিসাবের খাদ্যে কতই বা খরচ। একটা প্রজাতি রক্ষার জন্য এটুকু অর্থসংস্থান নিশ্চয়ই সরকারের সাধ্যের বাইরে নয়।
সেই সঙ্গে আমরা কেশবপুরবাসীর অভয়ারণ্যের প্রস্তাবটির প্রতিও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এই বলে যে এ ক্ষেত্রে অরণ্য আবাস তৈরিতে চেষ্টা করলে আন্তর্জাতিক পশুপ্রেমী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে সাহায্য মিলতে পারে। এখানে দরকার সদিচ্ছার, দরকার চেষ্টার। প্রয়োজনটা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলে সাহায্য না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। সাহায্য-সংস্কৃতি তো আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের এক বহু পরিচিত সত্য_তাই মানবপ্রাণীর আদি পূর্বপুরুষের নিকট-সম্পর্কের এক প্রাণীগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য না হয় একটু তৎপর হই।
পরিবেশদূষণ ও প্রকৃতি বিনাশ বেশ কিছুকাল ধরেই আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়ে গেছে; বাংলাদেশ হয়তো এদিক থেকে এক পা এগিয়ে। কিছুদিন আগে আমাজনের গভীর অরণ্যের ওপর আঘাত হানা সম্পর্কে খবরে দেখেছিলাম। সম্ভবত দীর্ঘ স্থলপথ নির্মাণ প্রকল্পের বিষয়ে। শেষ পর্যন্ত নানা প্রতিবাদে তা বোধ হয় স্থগিত হয়েছে।
আমরা জানি, অরণ্য-প্রকৃতি আমাদের সুস্থ অস্তিত্বের অংশ। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সহাবস্থানের প্রয়োজন ও গুরুত্ব অনুধাবন করাতে একাধিক প্রবন্ধ লেখেন, বক্তব্যও রাখেন একাধিক সূত্রে। তাতে তথ্য ও তত্ত্ব দুয়েরই যুক্তিসংগত উপস্থাপন রয়েছে। বছর কয় ধরে বাংলাদেশে পরিবেশবাদী মানুষ ও সংগঠনের সংখ্যা বেড়েছে। তাদের দাবি, নানামাত্রিক পরিবেশদূষণ থেকে ঢাকা তথা বাংলাদেশকে রক্ষা করা। এর মধ্যে রয়েছে নদী, অরণ্য, খাল-বিল, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল সংরক্ষণের চেষ্টায় সচেতনতা বৃদ্ধি, সেই সঙ্গে প্রয়োজনে আন্দোলন গড়ে তোলা; যাতে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয়।
লেখাটা শুরু করেছিলাম কেশবপুরের হনুমানকুলের প্রসঙ্গ নিয়ে। 'তীব্র খাদ্য সংকটে' আক্রান্ত সেখানকার হনুমানদের যে ছবিটা ছোটখাটো প্রতিবেদনের ওপরাংশে ছাপা হয়েছে, তার মর্মবস্তু যে কত করুণ তা ওই হনুমানগুলোর অসহায় মুখের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালে বুঝতে কষ্ট হয় না। সত্যি, ছবিটা চিত্রশিল্পীর জন্য একটি ভালো আঁকার বিষয়বস্তু হতে পারে, যা আমাদের মানবীয় চেতনাকে স্পর্শ করতে পারবে।
নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদনটি পড়ে ভালো লাগছে এ কারণে যে স্থানীয় গ্রামীণ বয়োবৃদ্ধ থেকে নানা বয়সী মানুষ, এমনকি কেশবপুরের কর্মজীবীরা পর্যন্ত তাদের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী হনুমানকুলের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তৎপর হয়ে মানবিক আবেগের প্রকাশ ঘটিয়েছে। তারা সরকারের কাছে এ বিষয়ে সহৃদয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। আমরাও বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করছি।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন রাখছি এই বলে যে বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণিকুল রক্ষার জন্য নীতিগত দাবি উত্থাপন করা হচ্ছে প্রাণী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে গঠিত বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ এ বিষয়ে ভিন্নপথের অনুসারী হতে পারে না। আমরা তাই কেশবপুরের খাদ্যসংকটে আক্রান্ত হনুমান প্রজাতিকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাই, যাতে দ্রুত তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আর সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে কেশবপুরের স্থানীয় অধিবাসীদের দাবি মোতাবেক সেখানকার হনুমানদের রক্ষার জন্য স্থায়ী অভয়াশ্রম তৈরির ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও দেশের বড় বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানাই, যাতে তারা এ ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমরা জানি, যেকোনো সমস্যার সমাধানে স্থানীয় সাহায্য ও তৎপরতা বিদেশি সাহায্যের পক্ষে পথ তৈরি করে দেয়। কেশবপুরের উদ্যোগী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর উচিত, শুধু সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তি ও সেবাব্রতী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা। তাতে হয়তো কেউ না কেউ এ প্রশংসনীয় উদ্যোগে অংশ নিতে এগিয়ে আসবে। এ কাজে ঢাকার পরিবেশবাদী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে অনুরোধ জানাই। সেই সঙ্গে ছোট্ট খবর_'সড়ক ও জনপথের শতবর্ষী গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে', তাই পরিবেশবাদীদের প্রতি অনুরোধ, অন্তত এই মহীরুহদের বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। চলুন আন্দোলনে নামি, যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চোখ খোলে।

লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক
কবি ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.