সরকার কার স্বার্থ দেখবে?-ধান ক্রয় by শরিফুজ্জামান শরিফ

কৃষকের ঘরে ধান ওঠা শুরু হয়েছে। এক সময় নতুন ধানের গন্ধে গ্রামের পরিবেশ আনন্দঘন হয়ে উঠত। কেননা, এই ধান বিক্রি করে প্রান্তিক কৃষক তার পরিবারের সদস্যদের নতুন কাপড় কিনে দিত, সন্তানের বিয়ের খরচ মেটাত, নানা সামাজিক উৎসবের ব্যয়ভার নির্বাহ করত। কিন্তু আজ সেই অবস্থা কি আছে? গত কয়েক দিনের পত্রপত্রিকায় যে খবর বের হচ্ছে তার মধ্যেই সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা ভালোভাবেই জানি, কৃষক এখন আর শুধু নিজের আহার


জোগাবার জন্য চাষাবাদ করে না। কৃষি আজ পুরোপুরি একটি বিনিয়োগ। আপনি কৃষিতে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলেন। এই বিনিয়োগের লক্ষ্য হলো এর মাধ্যমে আরও কিছু অর্থ উপার্জন করা। পত্রিকায় খবর এসেছে, এ বছর উত্তরাঞ্চলে ১ মণ ধান ফলাতে গড়ে ৫৫০-৫৭০ টাকা খরচ হয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলের চিত্র প্রায় একই রকম। এর মধ্যে কেবল বীজ, সার ও কীটনাশকের হিসাব রয়েছে। কৃষক তার শ্রম ও জমির ভাড়াকে খরচের মধ্যে ধরেন না। যাই হোক, পত্রিকায় দেখেছি সরকার এ বছর সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনবে কি-না তার সিদ্ধান্ত নেয়নি। গত ২২ নভেম্বর সচিবালয়ে খাদ্য, পরিকল্পনা ও পরিবীক্ষণ কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পেঁৗছানো যায়নি। আমাদের শঙ্কা এখানেই। কেননা, সুদীর্ঘকালের রীতি ভেঙে দিয়ে গত বছর সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছিল। আর এ কাজটি করার পেছনে দেশের কিছু গবেষকের পরামর্শ ছিল। গত বছর প্রথমে ৩০ টাকা কেজি দরে কৃষকের কাছ থেকে চাল ও ২১ টাকা কেজি দরে ধান কেনার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত থাকলেও পরে কিছু 'অর্থনৈতিক জার'-এর পরামর্শে সরকার সিদ্ধান্ত নিল তারা ধান-চাল কিনবে না। বিদেশ থেকে আমদানি করবে। যে কথা সেই কাজ। সরকার দেশি কৃষকের কাছ থেকে ২১ টাকার ধান বা ৩০ টাকার চাল না কিনে ভারত ও ভিয়েতনামের কৃষকদের কাছ থেকে (আমদানি ব্যয়সহ) ৩৫ টাকায় চাল আমদানি করল। সরকার ধান না কেনার ফলে বাজারে ক্রেতার মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল না। এতে চাতাল মালিকরা কম দামে ধান কিনে তা মজুদ করেছিল। কুষ্টিয়া, নওগাঁয় চাতাল মালিকদের সঙ্গে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদেরও একটি মৈত্রী গড়ে উঠেছিল। ক্ষুদ্র চাষিরা কম দামে তাদের ধান চাতাল মালিকদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আমাদের যুক্তি হলো, কৃষক যদি মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া, বেপারী অথবা চালকল মালিকের বদলে সরকারকে তার ফসলের ক্রেতা হিসেবে সামনে পান, তাহলে লাভজনক মূল্য পাওয়ার বিষয়ে কিছুটা নিশ্চিত হতে পারেন। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, গত দুই বছর ধরে সরকার নির্বাচনের আগে ধান-পাটসহ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য (কিন্তু আমাদের দাবি কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নয়, লাভজনক মূল্য) নিশ্চিত করতে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেখান থেকে সরে গেছে। আমলাচক্র সরকারকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। তার একটি উদাহরণ হলো, বিশ্বব্যাংক-এডিবির চাপিয়ে দেওয়া পিআরএসপি নানা মহলের সমালোচনার পর বর্তমান সরকার বাতিল করে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও সম্প্রতি যে খসড়া কৃষিনীতি তৈরি করেছে তা পিআরএসপির কার্বনকপি। সরকার মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক অর্থনীতিবিদের পরামর্শে জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে। এ বছরও কি তার পুনরাবৃত্তি হবে? এ গোত্রের অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, সরকার কেন বাজারে হস্তক্ষেপ করবে? সরকারের কাজ হলো, কেবল 'জানাজার ইমামতি' করা। এ ধরনের যুক্তি অল্পসংখ্যক মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে। আমরা দেখেছি, গত বছর আমন মৌসুমে সরকার কৃষককে মধ্যস্বত্বভোগী, দালাল, চাতাল মালিকের হাতে সঁপে দিয়েছিল। দুষ্টচক্রের প্ররোচনায় আমদানিকারকদের স্বার্থ দেখেছে। এ কাজগুলো একটি সামরিক বা অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে সম্ভব; নির্বাচিত সরকারের পক্ষে নয় ।
সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের গুদামে ১৫ লাখ টন চাল মজুদ রয়েছে। তাই চাল বা ধান রাখার জায়গার সংকট রয়েছে। আমাদের স্পষ্ট প্রশ্ন, সরকার গত দুই বছরে কয়টা গুদাম বাড়িয়েছে? আমাদের দেশে '৯০ সালের পর খালেদা জিয়ার শাসনামলে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে সরকারি পর্যায়ে খাদ্যগুদাম নির্মিত হয়নি। যেগুলো ছিল সেখানে পুলিশ ক্যাম্প, আনসার ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে সরকারের মজুদ করার ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী নতুন নতুন গুদাম নির্মাণের কথা ও তার জন্য অর্থ বরাদ্দের কথা বলেছিলেন। প্রশ্ন হলো, সেই গুদাম কেন হয়নি বা হতে আর কতদিন লাগবে? অন্যদিকে আমরা মনে করি, ধান কেনার সঙ্গে কম দাম বেশি দাম, সরকারের লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন তোলা ঠিক হবে না। কেননা, এর সঙ্গে কৃষক-প্রান্তিক চাষির উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্যের প্রশ্নটি জড়িত। আমাদের দেশের মানুষ যদি তার সংসদ সদস্যদের খাইয়ে-পরিয়ে, বিনাশুল্কে গাড়ি উপহার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, তাহলে সরকার কেন তার দেশের কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখতে ভর্তুকি দেবে না?
২০০৯ সালের কৃষিশুমারি অনুসারে দেশের কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ পরিবার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের। এসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬ কোটি। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা তাদের উৎপাদিত ধানের বেশিরভাগ বিক্রি করে দেন। দুই থেকে তিন মাস পর তারা আবার বেশি দামে চাল কিনে খেতে শুরু করেন। এতে তারা দু'ভাবেই ঠকে থাকেন। এখন সরকারকে ঠিক করতে হবে, সে তার দেশের কৃষক পরিবারের ছয় কোটি সদস্যের স্বার্থ দেখবে, নাকি 'অর্থনৈতিক জারদের' পরামর্শে কয়েকশ' চাতালকল মালিক ও দলীয় কর্মীদের স্বার্থ দেখবে?

সাধারণ সম্পাদক : নাগরিক সংহতি ও কলাম লেখক
citizen.solidarity@gamil.com

No comments

Powered by Blogger.