সদরে অন্দরে-ঢাকা মহানগর দুই টুকরো কার স্বার্থে by মোস্তফা হোসেইন

যেন ছুরি দিয়ে আম কেটে দুই টুকরো করে নেওয়া। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার সরকারি সিদ্ধান্তকে এভাবেই বিবেচনা করা যায়। কোন কারণে দুই ভাগ হবে ঢাকা? কী উন্নয়ন নিশ্চিত হবে ঢাকা ভাগ হলে? সম্ভাব্য সুবিধার কোনো ইঙ্গিত কি দিতে পেরেছে সরকার? একটি কারণই তো উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে। জনসংখ্যাধিক্য। জনসংখ্যা বেশি হলে কি ভাগ করে দিয়ে সংখ্যা কমিয়ে আনা যাবে? এমন প্রশ্নের কোনো জবাব


এখনো দেয়নি সরকার। সরকার জানতে চায়নি নগরবাসী এ বিষয়ে কী চিন্তা করছে তাও; কিংবা সরকারের সিদ্ধান্তটি নগরবাসী আদৌ মেনে নিচ্ছে কি না, তা জানারও তাগিদ বোধ করছে না সরকার। নগরবাসী কি এমন সিদ্ধান্ত পছন্দ করছে? সুযোগ নেই জবাব পাওয়ার। এত বড় একটি সিদ্ধান্ত, অথচ সেখানে জনসম্পৃক্ততা নেই। সংসদে আইন পাস করিয়ে কার্যকর করে ফেলা হচ্ছে। সরকার বলতেই পারে, আইন মেনে কিংবা আইন করেই তা কার্যকর হবে। বেআইনি কোনো কিছু করা হবে না। সত্যিই তো। তার পরও প্রশ্ন আসে, আইনের দৃষ্টিতে নির্দোষ হলেই কি সবকিছু করা যায়?
আইনের বিধানকে এখানে দাঁড় করানো খুব কঠিন ব্যাপার হবে না। তার পরও প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসতি এই ঢাকাকে দুই টুকরো করার আগে সরকারের কি জনমত যাচাইয়ের প্রয়োজন ছিল না? আসলে সরকার জানে, জনমত সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে নেই। এটাও সরকার বুঝতে পেরেছে সাম্প্রতিক কিছু কার্যক্রম দেখে। ঢাকা সিটি করপোরেশনে সরকারদলীয় যেসব কাউন্সিলর আছেন তাঁরা একবাক্যে সরকারের এই সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য বলে মতামত দিয়েছেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকার মতামতকেই তাঁরা প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন। তাঁদেরও কথা, ঐতিহ্যকে দুই টুকরো করার যুক্তি থাকতে পারে না। ঢাকার সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ও আবেগ জড়িয়ে আছে। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত; ভাষা আন্দোলন হয়েছে এই মহানগরে। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে এই মহানগর থেকে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক কাজগুলোও হয়েছে এখান থেকে। এর উত্তরাধিকার হবে কোন ঢাকা? সংসার ভাগাভাগি হলে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ হয়। তেমন বিরোধ দেখানোর জন্যই কি তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? মেয়র বলছেন, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ঢাকাবাসীর কোনো কল্যাণ হবে না সরকারের এই সিদ্ধান্তে, বরং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই হবে বেশি। বর্তমান মেয়রের কথারই সুর বাজে সব কাউন্সিলরের মুখ থেকেও। না এমন বলার কারণ নেই যে মেয়রের দলের কাউন্সিলররাই মেয়রের কথায় সুর মিলিয়েছেন। তিরিশের বেশি কাউন্সিলর আছেন আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগের সমর্থক কাউন্সিলররাও কেউ সমর্থন করেননি সরকারের নেওয়া এই সিদ্ধান্ত। যদি গণতান্ত্রিক রীতির কথা বলা হয়, তাহলে বলতে হবে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের কোনো কাউন্সিলরই চান না ঢাকা ভাগ হোক। তাঁরা এই মহানগরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। সাধারণ মানুষের মতামত প্রতিফলিত হবে তাঁদের মাধ্যমে। এই স্বাভাবিক সত্যকে যদি আমরা স্বীকার করি, তাহলে বলতে হবে, সরকার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
ঢাকা ভাগের লক্ষ্যে সিটি করপোরেশন আইনে ব্যাপক রদবদল করতে যাচ্ছে সরকার। সে মোতাবেক প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে জাতীয় সংসদে। সরকারের এই প্রস্তাব নিয়েও প্রশ্ন করা যায়। মনে করা যায়, প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হবে। কারণ সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিত না থাকার সুযোগটি সরকার গ্রহণ করবে। প্রস্তাবটি পড়ে মনে হতেই পারে, রাজনৈতিক সুবিধাই এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ। বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশনে উপযুক্ত ব্যক্তি কিংবা প্রথম শ্রেণীর কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে। সরকারের নিযুক্ত ব্যক্তির যোগ্যতার মাপকাঠি কী? বলা হয়নি কিছুই। এই বিধান মেনে নিলে বলতে হবে, সরকার ইচ্ছা করলে তার দলীয় কোনো ওয়ার্ডের নেতাকেও সিটি করপোরেশনের প্রশাসক নিয়োগ করার সুযোগ পাবে, যা হবে আত্মঘাতী। আবার এই বিধান অনুযায়ী সরকারি দলের সম্ভাব্য কোনো মেয়র প্রার্থীকেও যদি প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। এটা আইনেরও পরিপন্থী হবে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে প্রতিরক্ষা বিভাগকে বাদ দেওয়ার যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা নিয়ে হয়তো আলোচনার সুযোগ আছে। এই আইন পাস হলে ভবিষ্যতে নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা জরুরি কোনো কাজে প্রতিরক্ষা বিভাগকে কাজে লাগানোর সুযোগ সীমিত হয়ে আসবে। এ নিয়ে হয়তো পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু নিযুক্ত প্রশাসকের মেয়াদ নিয়ে যে ধারা সংযোজিত হতে যাচ্ছে, তাকে সহজে মেনে নেওয়া যায় না। যদি ধরা হয় যে এই মুহূর্তে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেনকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক দুজনকে দুই ঢাকার প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলো, তাঁরা প্রশাসক হিসেবে কত দিন থাকবেন? নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি তাঁদের মেয়াদ। চলমান আইনে প্রশাসকের সর্বোচ্চ মেয়াদ থাকছে ১৮০ দিন। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে তা অনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এ গেল প্রস্তাবিত আইনের কিছু দিক। কিন্তু প্রস্তাবিত বিভাজন প্রক্রিয়ায় উত্তরে ৩৬ এবং দক্ষিণে ৫৬টি ওয়ার্ড রাখার বিধান থাকছে। প্রশ্ন আছে এখানেও। এক ঢাকার দুই ভাগ আকার-আয়তনে হবে একটি আরেকটির প্রায় দ্বিগুণ। দ্বিগুণ এই আয়তনের শহর দুটির আয় ও ব্যয় হবে কোন অনুপাতে? উত্তর ঢাকার আয় নিশ্চয়ই দক্ষিণ ঢাকার সমান হবে না। ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্রও কি তেমনি হবে? নাকি ভেদ থাকবে উন্নয়ন ধারায়। দুই ঢাকার অধিবাসীদের মধ্যে কি হতাশা তৈরি হবে না এ নিয়ে? এই হতাশা যদি খারাপ দিকে মোড় নেয়, তাহলে কি আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু হবে? অবকাঠামোগত সুবিধা তৈরি করতে হবে আরেকটি সিটি করপোরেশনের জন্য। আঞ্চলিক অফিস দিয়ে মূল সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পালন করানো সম্ভব হবে না_এটাই স্বাভাবিক। মামলা-মোকদ্দমাগুলো পড়বে কার ঘাড়ে? দায়দেনারই বা অবস্থা কী হবে? সম্পদ ভাগাভাগিরই বা কী হবে? জনবলের ব্যাপারটিও একইভাবে চলে আসবে। বর্তমান জনবল ভাগ হবে দুই ভাগে। এ নিয়েও বিপাকে পড়তে হবে সিটি করপোরেশনকে। সিটি করপোরেশনকে ভাগ করার জন্য সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। অপ্রয়োজনীয় এই কাজটি না করে যদি বর্তমান পৌরসুবিধাগুলো সম্প্রসারিত করা যেত, তাহলে বোধ করি কোনো অসুবিধাই তৈরি হতো না। এই মুহূর্তে এক হাজার টাকার সোডিয়াম বাতি তিন হাজার ৪০০ টাকায় কেনার যে দুর্নীতির পাহাড়, সেই পাহাড়কে সমতলে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা উচিত সবার আগে। নাগরিক সুবিধাগুলো যাতে নিশ্চিত হয় সেদিকে খেয়াল করতে পারে সরকার। যানজট থেকে শুরু করে সেবা খাতের দুরবস্থা চরমে ঢাকার। সেগুলো সম্পর্কে কিছু কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে কেন যে ভাগাভাগিতে নজর দিচ্ছে সরকার, তা বোঝা মুশকিল। সরকার যদি সাবেক মেয়র হানিফের প্রস্তাবিত এবং বর্তমান মেয়র সাদেক হোসেন খোকা সমর্থিত নগর সরকার গঠনের ব্যাপারে নতুন কিছু সিদ্ধান্ত নিত তাহলে বোধ করি সবচেয়ে ভালো হতো।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.