নারী নির্যাতন রোধে যেসব কাজ জরুরি by মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ

বাংলাদেশে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী নির্যাতনের ঘটনা বিস্তার লাভ করছে ব্যাধির মতো। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত কয়েক বছরে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর অন্যতম। নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা আজ সারা বিশ্বেরই একটি আলোচিত সমস্যা। সমাজে নারীকে সহ্য করতে হচ্ছে নিপীড়ন, নির্যাতন ও মৃত্যু যন্ত্রণার চিহ্ন। তবে আশার কথা, একই সঙ্গে চলেছে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও


প্রতিবাদ। এরই ধারাবাহিকতায় নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বছরে একটি দিন প্রতীকীভাবে পালিত হয়ে আসছে। আর এই দিনটি হলো ২৫ নভেম্বর 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস'। বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র তুলে ধরার জন্য ১৯৮১ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ দিবস পালন করা শুরু হয়। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ ২৫ নভেম্বরকে 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস' এবং ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ পক্ষ' হিসেবে ঘোষণা করে। তার পর থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে এই দিবস ও পক্ষটি পালিত হয়ে আসছে। এবারও 'সমাজের বিবেক জাগ্রত হোক নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে'_এই স্লোগান সামনে রেখে নারী নির্যাতন প্রতিবাদ পক্ষ পালন করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় একজন করে নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা, ধর্মীয় কুসংস্কার প্রভৃতি বিষয়কে এ অবস্থার জন্য দায়ী মনে করা হলেও নারী নির্যাতনের মূল কারণ আসলে নারী-পুরুষের মধ্যকার বিদ্যমান বৈষম্যমূলক সম্পর্কের কারণে নারীর অধস্তন অবস্থান। প্রবল পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের কারণে এ দেশে নারীর নিম্ন মর্যাদাই নারী নির্যাতনের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১ সালের জানুয়ারি-জুন ছয় মাসে নারী নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে তিন হাজার ৪৪৪টি। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১১ সালের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন ধরনের নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৩৭৮টি এবং মামলা হয়েছে ৪৭৫টি। সহিংসতার এই হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক হলেও এটাই কিন্তু চূড়ান্ত পরিসংখ্যান নয়। পারিবারিক সম্মান, লোকলজ্জা, ভয়ভীতি, বিদ্যমান বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি কারণে সংঘটিত নারী নির্যাতনের আংশিক চিত্র প্রকাশ পায়। আবার নারী নির্যাতন প্রতিরোধমূলক আইনগুলোর প্রয়োগও খুবই দুর্বল। পুলিশ ও প্রসিকিউশনের যথাযথ সহায়তা না পাওয়ার ফলেও অসংখ্য ভিকটিম ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নারী নির্যাতনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির দিক অনেক। যেসব পরিবারে নারীরা অধিক হারে নির্যাতিত, সেসব পরিবারের সন্তানদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে না। গবেষকরা বলছেন, নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশে নারীরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং দীর্ঘদিন ধরে সে রোগ বয়ে বেড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর-বি) এক গবেষণায় নারী নির্যাতনকে বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বলে মন্তব্য করা হয়েছে। নারী নির্যাতন, চরম বিষণ্নতা, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ, আন্ত্রিক ও যৌনরোগ, গর্ভধারণে জটিলতা ও গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু ইত্যাদির অন্যতম কারণ। এ ছাড়া নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি। নারী নির্যাতন কেবল নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক গতিকেই রুদ্ধ করছে না, এর কুফল ভোগ করছে সমাজের সব মানুষ। পুরুষতন্ত্রের চাপে তাকে দৌড়াতে হচ্ছে দ্বিগুণ, বহন করতে হচ্ছে বাড়তি কাজ, দায় ও চাপ। সমাজ চলছে অসম ভারসাম্যে। যুগ যুগ ধরে বেড়ে ওঠা পুরুষতান্ত্রিক ভ্রান্ত মনোভাব ও সংস্কার শুধু পুরুষ নয়, এমনকি নারীকেও তাদের সঠিক আত্মধারণা ও অবস্থান নির্ণয়ে অস্পষ্ট রাখছে। সমমর্যাদা ও অধিকারে পুরুষের সঙ্গী করে তোলা হয়নি নারীকে। নারী নির্যাতন রোধ করতে হলে সবার আগে তাই গুরুত্ব দিতে হবে এই নেতিবাচক মনোভাবের পরিবর্তনের ওপর। এ ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সচেতন ও সংবেদনশীল হয়ে ওঠা আজ প্রতিটি পুরুষের অনিবার্য প্রয়োজন। সেই সঙ্গে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারী ইস্যুকে গুরুত্ব না দিলে তা পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পরিণত হতে পারবে না। কেননা উন্নয়নের অর্ধেক অংশীদারই হলো নারী। এর পাশাপাশি নারী নির্যাতন প্রতিকারমূলক আইনকানুন ও প্রক্রিয়াকে আরো ত্রুটিমুক্ত করাটাও জরুরি। নারী নির্যাতনের আইনগত প্রতিকারের পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। সবার নাগরিক সচেতনতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমেই নারী নির্যাতন সমাজ থেকে ক্রমেই বিলুপ্ত হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী, স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টে কর্মরত


No comments

Powered by Blogger.