হুমায়ূন আহমেদের যে হাসপাতালে চিকিৎসা by রনী মাহমুদ

মেমোরিয়াল স্লোন-ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারের ইন্টারন্যাশনাল অনকোলজি ডিপার্টমেন্টের ক্লিনিক্যাল পরিচালক, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ড. ভেচ স্টিফেন অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ একটু আগেই তার চেম্বারে প্রবেশ করেছেন। অন্যান্য দিন চেম্বারে ঢুকে তিনি খানিকটা বিশ্রাম নেন। কিন্তু আজ দেরি না করে পেশেন্ট দেখার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। এরই মধ্যে রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। সঙ্গে তার দুই


সন্তান নিশাত হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন আর তাদের মমতাময়ী মা মেহের আফরোজ শাওন। ডা. ভেচ তার প্রত্যাশিত মানুষটিকে দেখে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। তার এই নতুন রোগী কোলন ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
সৌজন্য আলাপ সেরে ডা. ভেচ আর দেরি করলেন না। হুমায়ূন আহমেদকে পাঠালেন রক্ত পরীক্ষার জন্য। এই ফাঁকে কোলন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসে পড়লেন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের সব রিপোর্ট পর্যালোচনা করতে। বিশ্বে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষ সাফল্য প্রদর্শনকারী ডা. ভেচের নেতৃত্বে দীর্ঘ পর্যালোচনার পর ঘোষণা করা হলো, যতটা মারাত্মক বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল বাস্তব পরিস্থিতি ততটা জটিল নয়। ক্যান্সার কোষগুলো তার টিউমারের ভেতরেই আছে, বাইরের কোনো অঙ্গে ছড়ায়নি। আর তাই অস্ত্রোপচার করে টিউমার অপসারণের কোনো প্রয়োজন নেই। ছয়টি কেমোথেরাপির মাধ্যমেই হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার সারিয়ে তোলা সম্ভব। এমনকি তাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ারও প্রয়োজন নেই। নির্ধারিত সময়ে হাসপাতালে এসে কেমো নিয়ে গেলেই হবে।
ড. ভেচ স্টিফেনের কথায় মেহের আফরোজ শাওনের চেহারায় খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল। তার শিশুসন্তানরা অন্তত বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে না ভেবে বুকের মধ্যে বয়ে গেল প্রশান্তির শীতল পরশ। ওদিকে বাংলাদেশে কোটি কোটি হুমায়ূন-ভক্ত তাদের প্রিয় লেখকের আনন্দময় খবরটি শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
আজও হুমায়ূন আহমেদ মেমোরিয়াল স্লোন-ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারের ইন্টারন্যাশনাল অনকোলজি ডিপার্টমেন্টের ক্লিনিক্যাল পরিচালক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ড. ভেচ স্টিফেনের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে চারটি কেমোথেরাপি নেওয়া হয়ে গেছে। আরও দুটি এখনও বাকি। আগামী এক মাসের মধ্যে সেগুলো দেওয়া সম্পন্ন হবে। এরপর ডাক্তাররা হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।
ক্যান্সার কী_এমন প্রশ্নের জবাবে মেমোরিয়াল স্লোন-ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারের জেনারেল রেডিওলজি বিভাগের ডিরেক্টর ডা. জেমস ক্যারাভেলি বলেন, বিশ্বের সব প্রাণীর শরীর অসংখ্য ছোট ছোট কোষের মাধ্যমে তৈরি। এই কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মারা যায়। মরে যাওয়া কোষগুলোর জায়গায় জন্ম নেয় নতুন কোষ। সাধারণভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়। কোনো কারণে যখন এই কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে তখনই সেখানে মাংসের চাকা দেখা যায়। এই চাকাগুলোকে টিউমার বলে। টিউমার দুই ধরনের হয়। একটি বেনাইন, অপরটি ম্যালিগন্যান্ট। বেনাইন টিউমার নিরীহ হলেও ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের মধ্যেই সৃষ্টি হতে পারে জীবননাশক ব্যাধি ক্যান্সার।
ক্যান্সার একটি প্রাণঘাতী রোগ। এখনও পর্যন্ত এই রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। এর কারণ হচ্ছে, প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার সহজে ধরা পড়ে না। ফলে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভালো কোনো চিকিৎসা দেওয়াও সম্ভব হয় না। বাস্তবিক অর্থে এখনও পর্যন্ত ক্যান্সারের চিকিৎসায় পুরোপুরি কার্যকর কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। ক্যান্সার সারানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে এই রোগ সারানোর সম্ভাবনা অনেকখানি বেড়ে যায়।
১৮৮৪ সাল। আমেরিকার নিউইয়র্ক। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য তখন আমেরিকায় ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো হাসপাতাল। এই ঘাটতি পোষাতে জন জে অ্যাস্টর ও তার স্ত্রী মিলে ম্যানহাটানের পশ্চিমে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি হাসপাতাল। নাম রাখা হলো নিউইয়র্ক ক্যান্সার হাসপাতাল। ১৮৯৯ সালে হাসপাতালটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো জেনারেল মেমোরিয়াল হসপিটাল ফর দ্য ট্রিটমেন্ট অব ক্যান্সার অ্যান্ড অ্যালাইড ডিজিজেস। ১৯১৬ সালে এই নাম থেকে 'জেনারেল' শব্দটা ফেলে দেওয়া হলো। ১৯৩৬ সালে জন ডি রকিফেলার নামের এক ভদ্রলোক ইয়র্ক অ্যাভিনিউতে কিছু জমি দান করলে হাসপাতালটি তার পুরনো জায়গা থেকে সেখানে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। স্থান পরিবর্তনের সময় হাসপাতালের নাম রাখা হয় শুধু মেমোরিয়াল হসপিটাল।
অন্যদিকে আমেরিকার গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটর্সের দুই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আলফ্রেড প্রিটচার্ড ক্লোনন এবং চার্লস ফ্রাংকলিন ক্যাটারিং যৌথভাবে চিকিৎসা গবেষণার জন্য স্লোন-ক্যাটারিং ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। দ্রুতই এই প্রতিষ্ঠান আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় বায়োমেডিক্যাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলে। ১৯৬০ সালে তারা মেমোরিয়াল স্লোন-ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টার নামে একটি ক্যান্সার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। ১৯৮০ সালে আসে সেই স্মরণীয় দিন; যখন মেমোরিয়াল হাসপাতাল, স্লোন-ক্যাটারিং ইনস্টিটিউট এবং মেমোরিয়াল স্লোন-ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টার একীভূত হয়ে গঠিত হয় মেমোরিয়াল স্লোন-ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টার।
মেমোরিয়াল স্লোন-ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টার আজ একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের নাম। হাসপাতালটিতে বর্তমানে এগারো হাজারের বেশি মানুষ কাজ করেন, যাদের মধ্যে ডাক্তার আছেন ৮০৪ জন। হাসপাতালটির ফিজিশিয়ান ইন চিফ ডা. রবার্ট উইটিস বলেন, 'আমরা প্রতিবছর চারশর বেশি ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসা করে থাকি। আমাদের চিকিৎসকরা ক্যান্সার চিকিৎসায় অভিজ্ঞ এবং সর্বশেষ প্রযুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সে কারণে যে কোনো জটিল রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পারি।' হ

No comments

Powered by Blogger.